-কেন, মেয়ে হলে কেমন সাজিয়ে মজা! ভালো ভালো ফ্রক, শাড়ি, ফিতে, স্নাে-পাউডার, গয়না সব কিনে দেব। ভালো করে লেখাপড়া শেখাব। তাছাড়া মেয়েরা বাপ-মায়ের যেমন সেবা করে ছেলেরা তেমন পারে না–
তুলি অবুঝ জেদের গলায় বলিল—না, মেয়ে না। আমি ছেলে চাই–
কাজল জিনিসটাকে মেয়েদের স্বাভাবিক পুত্রসন্তান কামনা মনে করিয়া কী একটা রসিকতা করিতে যাইতেছিল। হঠাৎ তাহার চোখ পড়িল স্ত্রীর দিকে। তুলি বিবর্ণমুখে কেমন যেন শক্ত হইয়া বসিয়া আছে। সচরাচর যে কোন বিষয়ে জেদ করে না, তাহার স্বভাবে তিক্ততাও নাই। সে এমন স্বরে কথা বলিতেছে কেন?
হঠাৎ সে বুঝিতে পারিল।
নিজের বঞ্চিতা মায়ের কষ্ট, অপমান আর পরাধীনতার কথা তুলির মনে পড়িয়াছে। সে নিজে মেয়ে, বিবাহিত জীবনে সে সুখীও বটে, কিন্তু তবু তুলি কন্যাসন্তান চায় না।
বাংলাদেশের চিরকালের অভিশাপ। তবে দিন বদলাইতেছে। বদল সব যেমন ভালো নয় আবার সব খারাপও নয়। নারী পূর্ণ মর্যাদা পাইবে এমন দিন আসিতেছে। সবটা সে দেখিয়া যাইতে পারিবে না। তাহার ছেলেরা দেখিবে।
অপুর খ্যাতি ক্রমে পাঠকদের মধ্যে সকালের আলোর মতো ছড়াইয়া পড়িতেছে। বড়ো বড়ো সমালোচক, সম্পাদক আর অধ্যাপকেরা তাহাকে চিরকালের ধ্রুপদী সাহিত্যিক বলিয়া প্রবন্ধ লিখিতেছেন, ক্লাসে বক্তৃতা দিতেছেন! স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় সাহিত্যের প্রচারের জন্য সংস্থা করিয়াছেন, সেখান হইতে অপুর বই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হইয়া বাহির হইতেছে। স্কুলের, কলেজের আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে উঠিয়াছে। স্টপ গ্যাপে কখনও স্কুলে বাংলার ক্লাস লইতে গেলে ছাত্ররা বলে-স্যার, আপনার বাবার পিসটা পড়ান। পড়ানো শেষ হইলে বলে—বাবার গল্প বলুন স্যার, আমরা শুনবো-কাহারও সঙ্গে নতুন আলাপ হইলে মানুষ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকায়।
কাজল মনে মনে হাসিয়া ভাবে আমি হলাম চাদের মতে, অন্য জ্যোতিষ্কের আলোয় উজ্জ্বল। লোকে আমাকে সম্মান দেয়, আমার বাবার খাতিরে। আমার বোধহয় আর কিছু হল না—
মনের মধ্যে একটু কষ্ট হয় কি? হয় বোধহয়। কিন্তু গৌরব আর আনন্দ তুলনায় এত বেশি। যে, বিষণ্ণতা সেখানে কোনো দাগ ফেলিতে পারে না।
বাবার প্রতি তাহার মনোভাব সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারিবে না। পারিবাহিক সম্পর্কের ঘনিষ্ট-মধুর অনুভূতি তো আছেই, কিন্তু তাহা অপেক্ষাও অনেক বড় কিছু মনকে পরিপূর্ণ করিয়া তোলে। বাবা কেবল শৈশবের জয়গান গায় নাই, কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিমগ্ন থাকে নাই—যেমন অনেক পাঠক মনে করে। অস্তিত্ব আর জীবনের গৃঢ়তম রহস্যের দিকে বাবা পুলকিত বিস্ময় লইয়া তাকাইয়াছে। চেষ্টা করিয়াছে, তাহার সঙ্গে সকলকে সেই আনন্দময় জগতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিতে। আগামী বহু শতাব্দীতেও তাহার বাবার মতো সাহিত্যিক আর আসিবে না।
গেলই না হয় একটা জীবন বড়ো একজন লেখকের ছায়ায় ছায়ায়। সে তাহার বলিবাব কথা লিখিয়া রাখিয়া যাইবে, সে পাঠকেরা গ্রহণ করুক আর নাই বুক। কিন্তু একথা সত্য যে, শত বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও জীবন বড় সুন্দর। বড় আনন্দের।
একদিন স্কুল হইতে ফিরিয়া কাজল দ্বিজেনবাবুর একখানা চিঠি পাইল। তিনি অবিলম্বে একবার দেখা করিতে বলিযাছেন। জরুবি প্রয়োজন।
পরের দিনই কাজল কলকাতায় গেল। বসু ও গুহ পাবলিশার্সের ঘরে আরামকেদাবায আজ প্রমথবাবু আসীন। পাশেব চেয়ারে দ্বিজেনবাবু বসিয়া সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। কাজল ঢুকিতে ঢুকিতে শুনিল দ্বিজেনবাবু বলিতেছেন–যাও না প্রমথ, কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে কী কিনতে যাবে বলছিলে। দেরি না করে এইবেলা ঘুরে এস—
কথায় ভুলিয়া বন্ধু একবার বাহির হইলেই হয়! অমনি সন্ধ্যার মতো কেদারা দখল।
কিন্তু প্রমথবাবু বন্ধুকে আশৈশব চেনেন। তিনি উদাস গলায় বলিলেন—যাবখন। পবে যাব–
কৌশল বিফল হওয়ায় দ্বিজেনবাবু চটিয়া পা নাচাইতে লাগিলেন। ঠিক এই সমযেই কাজল ঘরে ঢুকিল। দ্বিজেনবাবু বলিলেন—এই যে তুমি এসেছ, আমার চিঠি পেয়েছ তো?
কাজল দুজনকে প্রণাম কবিযা বলিল—চিঠি পেয়েই তো আসছি। কী ব্যাপার কাকাবাবু?
–বোসো, বলছি। অপূর্ববাবুর দিনলিপির প্রোডাকশন কেমন লাগল?
–খুব ভালো কাকাবাবু। কভার, ছাপা সবই ভালো। কেমন চলছে বইখানা?
–ভালো। কিছুটা সেইজন্যই তোমাকে ডাকা। তোমার বাবাব ডায়েবি আমরা একটু দ্বিধা নিয়ে ছেপেছিলাম সেকথা স্বীকার করছি। প্রমথ ছাড়া সবাই ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে। অপূর্ববাবু সম্বন্ধে আমাদের ধারণাই সঠিক।
কাজল চুপ করিয়া রহিল।
মাথার উপরে পুরানো ডিসি পাখাটা শব্দ করিয়া ঘুরিতেছে।
দ্বিজেনবাবু বলিলেন—আমরা তোমার বাবার রচনাবলী প্রকাশ করতে চাই।
কাজল অবাক হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইল। সে ঠিক শুনিতেছে তো? রচনাবলী! তাহার বাবার! রচনাবলী তো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের বাহির হয়। মানে, যাঁদের ছবি ক্যালেন্ডারে থাকে। বাবা সেইখানে পৌঁছাইয়া গেল নাকি?
প্রমথবাবু বলিলেন—আমরা মোটামুটি একটা স্কীমও করে ফেলেছি। সমস্ত সেটটা দশ ভলমে কমপ্লিট হবে। তোমার মা রাজি হলেই আমরা গ্রাহকভুক্তির জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেব
কাজল বলিল—বাবার রচনাবলী! দশ ভলমে। খুব আনন্দের কথা কাকাবাবু, কিন্তু জিনিসটা কমার্সিয়ালি ভায়েবল হবে তো? বাবার বই এমনিতে ভালোই বিক্রি হয় জানি, পাঠকেরা বাবাকে ভালোবাসে। কিন্তু রচনাবলী অন্য জিনিস। আপনারা কিন্তু ভেবে দেখুন—