কাজল বলিল—আপনার মাধ্যমে না করে ওরা তো ডিরেকট ধার করতে পারে—
-না পারে না। কেউ দেবে না ওদের। আমার একটা গুডউইল আছে। তাছাড়া বিজনেসের চেন বলে একটা ব্যাপার আছে। বিজনেস চেন কেউ নষ্ট করবে না, সে বদনাম হয়ে যাবে–
-–চেনের মাঝখানে কেউ যদি টাকা মেরে পালিয়ে যায়? কী করবেন তখন?
শর্মা আবার মিটমিট করিয়া হাসিলেন, বলিলেন—সেদিকে নো রিসক, আমি কোল্যাটেরাল কিছু রেখে টাকা দিই, শুধু হাতে দিই না।
কাজল এ ব্যবসার কিছুই জানে না। সে জিজ্ঞাসা করিল—কোল্যাটেরাল কী?
–মানে সিকিউরিটি। গোল্ড। কিংবা বাড়ির বা জমির দলিল। কারখানা বা বিজনেসের মালিকানার কাগজ। সময়মতো টাকা না মেটালে বাড়ি জমি বিজনেস আমার–
—এমন হয়েছে?
—বেশি না? দুবার। টাকা ফেরত পেলে সাড়ে-ছয় কী সাত পার্সেন্ট কত, এতে থেকে গেল টুয়েন্টি সেভেন পার্সেন্ট। তবে কী জানেন, এ বিজনেসে পয়সা আছে, নাম নেই। সিনেমা করলে লোকে বলবে ওই দেখ শর্মা যাচ্ছে, ও একটা ভালো সিনেমা প্রোডিউস করেছে। নাম হবে, প্রেস্টিজ বাড়বে। তবে হাঁ, সিনেমায় রিস বেশি। যদি ফ্লপ করল, বাজারে চলল না, তাহলে তামাম ডুবল। সেইজন্যে তো মিঃ সেনকে বেছেছি, মিঃ সেনের সিনেমা বাজারে খুব চলে। লোকে খুব দেখে।
কাজের সময় কিন্তু দেখা গেল খ্যাতির অভিলাষী শর্মা লেখককে বেশি পয়সা দিতে একেবারে রাজি নহেন। অমায়িক হাসিয়া বলিলেন নিয়ে নিন। আপনার তো কোনো ইনভেস্টমেন্ট নেই, আটআনার কাগজ আর চারপয়সার কালি। ধরুন যদি পিকচার লেগে যায়, তাহলে আরও কত সিনেমা তৈরি হবে আপনার বাবার–
রাস্তায় বাহির হইয়া পরিচালক ভদ্রলোক লজ্জামিশ্রিত গলায় কাজলকে বলিলেন—কিছু মনে করবেন না, এরা শিল্প-সংস্কৃতির ধার ধারে না তো-নেহাত আমার লাস্ট ছবিটা বাজারে ভালো চলেছে, এক নাম হয়েছে, তাই আমাকে দিয়ে ছবি করাতে চাইছে। যাতে টাকা না ডোবে। নইলে ও কি আমাকেই পাত্তা দেবার লোক?
কাজলের মন কেমন সংকুচিত হইয়া গিয়াছিল। মনে পড়িতেছিল—তবু যেন হেসে যাই যেমন হেসেছি বারেবারে, পণ্ডিতেব মূঢ়তায় ধনীর দৈনন্যব অত্যাচাবে, সজ্জিতের রূপের বিদ্রূপে—
স্থূল বৈষয়িকতার কী নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ! কেমন হাসিয়া লোকটা বলিল—বিজনেস আর আমি কী করলাম বলুন, ও তো করলেন আপনি। সব মিলিয়ে আমি লাগাব আড়াই লাখ, তিন লাখ। ঝুঁকি নেব, ফিলম চলবে কী চলবে না ভগবান জানে। তারপর হল তো খুব বেশি বিশ-পঁচিশ পার্সেন্ট। আপনার ইনভেস্টমেন্ট আটআনা, প্রফিট টু থাউজ্যান্ড টাইমস্! হাঃ হাঃ হাঃ—
কাজল বলিল—আর ইনটেলেকচুয়াল ইনভেস্টমেন্ট? সেটাব দাম?
অবাক হইয়া শর্মা বলিলেন—সেটা কী?
হাসিয়া কাজল বলিল—কিছু না। ওটা একটা নন-কমার্শিয়াল টার্ম।
শর্মা নিশ্চিন্ত হইলেন।
কোথায় কাব্য-সাহিত্য, কোথায় তাহার দরিদ্র বাবাব চালভাজা খাইযা আনন্দ কবিবাব ইতিহাস। অর্থই সব। অর্থনীতিব নিয়মের ওপর ভিত্তি করিয়াই মানবসভ্যতার অধিষ্ঠান। বাকি সব কথার কথা। মূল্যহীন।
তখনই আবার কে মনের মধ্যে কথা বলিয়া ওঠে। আশার বাণী শোনায়, প্রলোভনে স্থিব থাকিতে বলে। যাঁর হাতে কাল অন্তহীন, সেই দেবতাব বিচাবে আস্থা বাখিতে বলে। সমসামযিকত্বে ঊর্ধ্বে শাশ্বত জীবন বিদ্যমান। তাহার ছবি আঁকে।
বাড়ি ফিরিতে সন্ধ্যা। বারান্দায় আলো জ্বলিতেছে, জানালায় তুলিব পছন্দ করা হালকা বঙেব পর্দা। ওই তাহার গৃহ। সারাদিন অচেনা, বিষয়োন্মত্ত পৃথিবীর সঙ্গে নিদাবুণ পবিচযেব পর ওইখানে তাহার শান্তির আশ্রয়।
দরজার কাছেই ছেলে বসিয়া কয়েকটা রঙ-চটা টিনেব খেলনা আর মাটিব পুতুল লইযা খেলা করিতেছে। সারাদিন পর বাবাকে দেখিয়া সে একগাল হাসিল।
কাজল বলিল—কী খেলছিস রে খোকা? ওঃ, সব খেলনা বেব কবেছিস।
খোকা বলিল—এটা জঙ্গল। এখানে–এই দেখ হাতি, বাঘ, হরিণ সব আছে। বাঘ আর হবিণ এদিকে থাকে, এদিকে থাকে হাতি আর জিরাফ
—সে কী রে! বাঘ আর হরিণ একসঙ্গে থাকবে। বাঘ হবিণকে খেয়ে ফেলবে তো
খোকা এতটা ভাবিয়া দেখে নাই। তাহার জগতে হিংসা থাকিবার কথা নয়। একটু ভাবিয়া সে বলিল—আচ্ছা, আমি বারণ করে দেব। ওরা লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।
কাজল মনে মনে বলিল—আশীর্বাদ কবি বাবা, তুই যেন তাই পাবিস। পৃথিবীর বড়ো কষ্ট, তোর বেঁধে দেওয়া নিয়মে যেন শান্তি নেমে আসে–
কাজলের গলা শুনিয়া হৈমন্তী আসিয়া দাঁড়াইল, পেছনে পেছনে তুলি।
কাজল কাঁধের ঝোলা ব্যাগ হইতে টাকাভবা খামটা বাহির করিয়া মায়ের হাতে দিয়া বলিল–আজ বাবার সিনেমার কনট্রাকটটা হয়ে গেল মা। টাকাটা রেখে দাও। একশো টাকা আমি নিয়েছি। বই কিনেছি, তোমার জন্য বালুসাই আর অমৃতি কিনেছি–
হৈমন্তী বলিল–বৌমার জন্য কিছু কিনিস নি?
কাজল একটু কাশিয়া বলিল–সে আছে। সে এমন কিছু না–ওকে পরে দেব এখন—
হৈমন্তীর পেছন হইতে তুলি মুখ টিপিয়া হাসিল।
হাতমুখ ধুইবার জন্য ঘরে ঢুকিতে গিয়া কাজল দেখিল খোকন তাহার সামান্য খেলনার ভাণ্ডার লইয়া তন্ময় হইয়া খেলা করিতেছে। তাহার মুখে সরল আনন্দ।
সার্থকতা আর আনন্দ পাইবার জন্য শর্মাকে লক্ষ টাকা নিয়োগ করিতে হয়। তাহার খোকার মূলধন মাটির পুতুল। মুনাফা শতকরা একশো ভাগ।
২৪. শ্রাবণমাসের প্রথম সপ্তাহে
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
শ্রাবণমাসের প্রথম সপ্তাহে তুলির দ্বিতীয় পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিল। কাজল আশা করিয়াছিল এবার মেয়ে হইবে। তুলির কাছে একদিন সেকথা বলিতে তুলি বলিল–না, আমার মেয়ে ভালো লাগে না। তুমি যেন কী!