প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়ম। ক্রমে একদিন তাহার পায়ে বাত ধরিবে, দৃষ্টি ক্ষীণ হইয়া আসিবে, আশৈশব স্মৃতির উজ্জ্বল শরীরকে জড়াইয়া ধরিবে বিস্মৃতির ধূসর জাল। কিন্তু মনের মধ্যে যে শিশু বাস করে সে মানিতে চায় না। জীবনের প্রথম চশমাখানি হাতে লইয়া কমলাকান্তের যেমন মনোভাব হইয়াছিল, তাহারও তেমন হয়। যৌবনের উৎসবে আর তাহার নিমন্ত্রণ নাই। সূর্য পশ্চিম দিগন্তের দিকে নামিতেছে।
নাঃ, সে খামোকাই ভাবিয়া মরিতেছে। মানুষের গড় আয়ু আশি ধরিলে অবশ্য সে মধ্যবয়স পার হইয়াছে, কিন্তু তেতাল্লিশ বছব এমন কিছু বয়েস নহে। বার্ধক্য আসিতে এখনও অনেক দেরি। তবে হ্যাঁ, সেইসব হারানো দিন আর ফিরিবে না।
খোকা বড়ো হইয়া উঠিতেছে। বাড়িতে তাহার লেখাপড়া শুরু হইয়া গিয়াছে, দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইবার মুখে। স্লেট পেনসিল ধারাপাত লইয়া সকাল-বিকাল সে গম্ভীর মুখে ঠাকুমার কাছে পড়িতে বসে। ঘণ্টাখানেক পাঠাভ্যাস চলিবার পর দেখা যায় বইপত্র বিছানার একদিকে পড়িয়া আছে, খোকা ঠাকুমার কোলে হেলান দিয়া পা ছড়াইয়া গল্প শুনিতেছে। গল্পই বা কতরকমের। রূপকথার কাহিনী তো আছেই, তাহার সঙ্গে আছে মধুসূদনদাদার দইয়ের হাঁড়ির গল্প, অমাবস্যার রাতে গ্রামের অন্ধকার পথে গোভভূতের গল্প-আর আছে খোকার ঠাকুরদার গল্প। সে গল্পই আসরের বেশিটা জুড়িয়া থাকে।
কাজল ছেলের নাম রাখিয়াছে সপ্তর্ষি। নামটা একটু প্রাচীন ভারতগন্ধী হইল বটে, কিন্তু কাজলের চিরদিনই ধ্রুপদী ব্যাপার পছন্দ। আজকাল সবাই কায়দা করিয়া নাম রাখা শুরু করিয়াছে— জয়, রাণা, কাবুল-এমন কী, এই নামই তাহাদের কর্মজীবনেও স্থায়ী হইতেছে। আলাদাভাবে পোশাকি নাম অনেক ক্ষেত্রেই আর ব্যবহৃত হয় না।
পরিবর্তন সর্বত্র আসিতেছে। বদল ভালো, স্থাণুত্ব জীবনের পরিপন্থী। কিন্তু সে কি এই বদল? মানুষ লঘু হইয়া যাইতেছে, অন্নময় হইয়া যাইতেছে। যদি আরও খারাপের দিকে অবস্থা যায়? অন্ধকার যদি আরও ঘনাইয়া আসে? তাহা হইলে এ কোন পৃথিবীতে সে তাহার সন্তানকে রাখিয়া যাইবে?
তাহার এবং তুলির দ্বিতীয় সন্তান আসিতেছে। অপুর নিঃসঙ্গ জীবন সংগ্রাম আর বঞ্চনা পরিপূর্ণতা লাভ করিতে চলিয়াছে উত্তবাধিকারীর সমাগমে। এখন নিজের কথা আর ততটা ভাবিতে ইচ্ছা করে না, কেবল মনে হয় যাহারা থাকিয়া যাইবে তাহাদের সমকাল সুগম হউক।
পৃথিবীটা কেমন যেন দুভাগ হইয়া গিয়াছে। একভাগে উজ্জ্বল আলো, নীল আকাশ, সৌরচরাচরে ব্যাপ্ত বাঁচিয়া থাকিবার সহজ আনন্দ। আর একদিকে অবকাশহীন, নীর পাষাণময় কারাকক্ষের শতাব্দী সঞ্চিত অন্ধকার, পরশ্রীকাতরতা, অশিক্ষা, ঈর্ষার বিষময় প্রকাশ। মৃদু পরিবেশে মানুষ হইয়া সে জগতের বাস্তব রূপ ততটা দেখে নাই, ভাবিয়াছিল জীবনের সবটাই গোলাপী রঙের আলোয় উদ্ভাসিত, সকলেই এখানে রবীন্দ্রনাথের গান গায, চাঁদ উঠিলে সকলেই বনে যাইবার জন্য ব্যস্ত হয়।
না, জীবন ঠিক তেমন নয়। অপুর একটি ছোটগল্প হইতে ফিলম কবিবার জন্য এক পরিচালক ভদ্রলোক কিছুদিন ঘোরাফেরা করিতেছিলেন। একদিন তিনি কাজলকে লইয়া প্রোডিউসারের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলেন। বড়োবাজারের কাছে দোতলায় একটা খুপরিমতো ঘর, টেবিল আর খানকতক চেয়ার ছাড়া ঘরে বিশেষ কোনো আসবাব নাই। ভদ্রলোকের কীসের ব্যবসা কাজল তাহা বুঝিতে পারিল না। ছবি তুলিতে অনেক টাকা লাগে, এইটুকু ঘরে কী ব্যবসা করিয়া অত টাকা রোজগার হয়?
প্রোডিউসার মাঝবয়েসী, পরনে শার্ট ও প্যান্ট। একটু শিথিল, থলথলে চেহারা। মুখে কুটিল বৈষয়িক বুদ্ধি এবং জীবনের অপরাপর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতার ছাপ। তিনি কাজলকে বলিলেন–বসুন, বসুন। মিঃ সেন বললেন আপনি আজ আসবেন—খুব ভালো হয়েছে। বাংলা গল্প আমি খুব ভালোবাসি। আপনার তো বয়স বেশি নয়, এত সুন্দর গল্প আপনি লিখেছেন? কতদিন লিখছেন আপনি?
একটু কাশিয়া মিঃ সেন, অর্থাৎ পরিচালক বলিলেন—শৰ্মাজী, গল্প এর নয়, এর বাবার লেখা। অবশ্য ইনিও ভালো লেখেন—
শৰ্মাজী বলিলেন—ও হো হো, সরি, আপনি অপূর্বচাঁদ বাবুর ছেলে?
কাজল বলিল—অপূর্বকুমার।
-সরি, সরি। কুমার। তা, উনি এলেন না? একটু আলাপ হয়ে যেত–
মিঃ সেনকে তাসের গোলামের মতো দেখাইতেছিল। বিবর্ণ হাসিয়া তিনি বলিলেন—শৰ্মাজী, অপূর্ববাবু মারা গিয়েছেন। আমি বলেছিলাম আপনাকে–
শর্মা একটুও বিব্রত হইলেন বলিয়া মনে হইল না। মুখে দুঃখসূচক চুক্ চুক্ শব্দ করিয়া বলিলেন—ও, মারা গিয়েছেন। হাঁ, শুনেছিলাম বটে। এত কাজের চাপ, কিছু আর মাথায় থাকে না। সরি।
কাজল অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়াইবার জন্য বলিল—কী কাজ আপনার?
শর্মা মিটমিট করিয়া হাসিলেন, বলিলেন—আপনি নিজের লোক, বলতে আপত্তি নেই। আমি একটু টাকাপয়সার কারবার করি—
কাজল ঠিক বুঝিল না। কারবারে টাকাপয়সা লাগে বটে, কিন্তু টাকাপয়সার কারবার কী?
কাজলের মুখের ভাব দেখিয়া শর্মা বলিলেন–বুঝলেন না? আমি যা করি তাকে বলে ফান্ড ম্যানেজমেন্ট। ধরুন রাম আমার কাছে মাসখানেকের জন্য দুলাখ টাকা চাইল, আমি শ্যামের কাছ থেকে টাকাটা ধার করে রামকে দিলাম। দশদিন পরে যদুর কাছ থেকে দুলাখ ধার করে শ্যামের টাকা মিটিয়ে দিলাম। সামান্য কিছু সুদ লাগল। পনেরো দিন পরে মধুর থেকে দুলাখ নিয়ে যদুর টাকা মিটিয়ে দিলাম। আবার সামান্য সুদ লাগল। একমাস পরে রাম সাড়ে বারো পার্সেন্ট সুদ আর টাকা ফেরত দিল। তার থেকে মধুর টাকা দিয়ে দিলাম। এই হাত ফেরতে আমার ছয় পার্সেন্ট সুদ অন্যদের দিতে হল, বাকি সাড়ে-ছয় আমার। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার এই যে, বিজনেসটায় আমার নিজের কোনো টাকা লগ্নী হল না। এর টাকা ওকে দিয়ে মুফতে প্রফিট–