রাখাল উৎসাহ পাইয়া বলিল—ভালো না? তুই বন্ধু মানুষ তাই অ্যাপ্রিসিয়েট করলি। পাড়ার লোক আমাকে পাগল বলে। অন্তত পনেরো কুড়িটা ভালো গল্প লেখা হয়ে গিয়েছে। এবার সেগুলো এক এক করে কাগজে পাঠাতে আরম্ভ করব। ওরা গল্প ছাপলে টাকা দেয়, জানিস? টাকাটা জমিয়ে রাখব, বিপদের সময় হ্যান্ডস ফাইভ থাকবে।
হা ঈশ্বর! সরল বন্ধুকে সে বাস্তব পৃথিবীর জটিলতা কী বোঝাইবে? লেখা ছাপানো কি অত সহজ? নাকি লিখিয়া উপার্জন করা কেবলমাত্র লেখকের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে? কিন্তু যুক্তির আঘাতে রাখালের স্বপ্নের স্বর্গ ভাঙিয়া দিতে তাহার ইচ্ছা করিল না।
সে বলিল–চল, কিছু খাওয়া যাক। অনেকদিন একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়নি–
বন্ধুকে লইয়া কাজল মির্জাপুর স্ট্রীটের পুঁটিরামের দোকানে ঢুকিল। ভিতরের রান্নাঘর হইতে রাধাবল্পভি ভাজিবার সুঘ্রাণ ভাসিয়া আসিতেছে। কাজল চারখানা করিয়া রাধাবল্লভি দিতে বলিযা কোণের একটা টেবিলে বসিল। রাখাল হুসহাস্ শব্দ করিয়া গরম রাধাবল্পভি নিমেষে খাইয়া ফেলিল, দুইবার বাড়তি ডাল চাহিয়া লইল।
কাজল বলিল—তোকে আর চারখানা দিক?
রাখাল সাগ্রহে সম্মতি জানাইল। বলিল—একেবারে হাতে গরম, যাকে বলে খোলা টু নোেলা। বেশ লাগছে খেতে। আসলে এ সময়ে কোনোদিন এত জমিয়ে খাওয়া হয় না, বুঝলি? কাজ থেকে ফেরবার সময় সামান্য মুড়ি আর সস্কুইটো-ব্যস!
কাজল অবাক হইয়া বলিল—সকুইটো আবার কী?
–বাঃ, তুই যেন কী! মশা মসকুইটো হলে শশা সসকুইটো নয়?
এ যুক্তিও কাজল বিনা আপত্তিতে মানিয়া লইল।
পুঁটিরাম হইতে বাহির হইয়া রাখাল বলিল—তুই এত ভালো খাওয়ালি, আমার তো কিছু প্রতিদান দেওয়া উচিত। চল, গোলদীঘির বেঞ্চিতে বসে, তোকে কবিতা শোনাই–
সর্বনাশ! কাজল ব্যস্ত হইয়া রাখালকে বোঝাইতে লাগিল যে, বন্ধুত্বের নিঃস্বার্থ শুভ্রতার মধ্যে দান-প্রতিদানের কালিমা ডাকিয়া আনা কোনো কাজের কথা নহে, রাখালের কিছুমাত্র সংকোচের কারণ নাই। বিশেষ করিয়া তাহাকে পৌনে পাঁচটার লোকাল ধরিতেই হইবে।
দেখা গেল রাখাল সরল বাংলা বোঝে না। কাজলের আপত্তিতে কিছুমাত্র কান না দিয়া সে তাহার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে গোলদীঘিতে আনিয়া বসাইল। জীর্ণ ব্যাগ খুলিয়া মার্বেল কাগজ দিয়া বাঁধানো একটা খাতা বাহির করিয়া একের পর এক কবিতা পড়িয়া যাইতে লাগিল। কবিতাগুলির ভাব বাম্পবৎ, বিষয়ের মাথামুণ্ড কিছুই নাই, ছন্দ তদব। একটি কবিতা স্বদেশপ্রেম দিয়া শুরু হইয়া দুর্গাপূজা দিয়া শেষ হইয়াছে। পর্যদস্ত, হতাশ কাজল মুখে একধরনের স্থায়ী উদ্ভাস ফুটাইয়া মনে মনে অন্য কথা ভাবিতে লাগিল।
দশ-বারোটা কবিতা পড়িবার পর রাখাল থামিল। বলিল—আজ এই পর্যন্ত থাক। আজ সঙ্গে গল্প নেই বলে শোনাতে পারলাম না। তুই দুঃখ করিস না, একদিন তোর বাড়িতে গিয়ে সকাল থেকে—বেশ হবে, না?
কাজলের মুখের ভাব অত্যন্ত করুণ হইয়া আসিয়াছিল, আরছা গলায় সে কী বলিল ভালো বোঝা গেল না। তাহাকেই সম্মতি ধরিয়া লইয়া রাখাল বলিল—তাহলে ওই কথাই ঠিক থাকল। যাব শিগগীরই, বিলম্বে আর দেরি কেন, বল? চলি ভাই, গিয়ে লিখতে বসব
যাইবার আগে হঠাৎ থামিয়া রাখাল কাজলের দিকে তাকাইয়া একটা অদ্ভুত কথা বলিল। রোগা, অনটনে ভোগা, সামান্য মানুষ রাখাল বলিল–জানিস অমিতাভ, খুব আনন্দে আছি, খুব মজায়। এমনিতে আমি কেমনভাবে বেঁচে আছি তা তো দেখছিস, টেনেটুনে সেলাই করে চালাই। সবার কাছে ছোট হয়ে থাকি। কিন্তু যখন লিখি, কিংবা লেখার কথা ভাবি—তখন মনের ভেতর কেমন যে একটা ভালো লাগা-সে তোকে বোেঝাতে পারব না। তখন কে মনে রাখে কাল বাজার খরচ কোথা থেকে আসবে। বাড়িওয়ালা ভাড়ার তাগাদায় এলে তাকে কী বলব, এসব লেখা সত্যিই কোনদিন ছাপা হবে কী না, হলেও নাম হবে কী না। দূর! তখন শুধু লিখতেই ভালো লাগে, কী লিখব তাই ভাবতে ভালো লাগে। নইলে কী করে যে বাঁচতাম!
পিছন ফিরিয়া রাখাল ওই হাঁটিয়া চলিয়া যাইতেছে। কাজল তাকাইয়া রহিল। অনেক তথাকথিত বড়োমানুষ অপেক্ষা, দাম্ভিক ধনী অপেক্ষা বড়ো তাহার বন্ধু। আহা, রাখাল ভালো থাকুক, তাহার স্বপ্ন আর শান্তি চিরজীবী হউক।
পৃথিবীতে মানুষ বড়ো কষ্টে আছে। বাসনার আগুনে ইন্ধন নিক্ষেপ করিয়া সে শান্তিব আশা করিতেছে। কাজল নিজের শরীরের ভিতর টের পায় নাই চারিদিকে দুনিয়া বদলাইয়া যাইতেছে। হাসিমুখে মানুষ বন্দীত্বের খাঁচার দিকে অগ্রসরমান। খাঁচাটা সোনার, তবু খাঁচাই।
আহা মানুষ! প্রিয় মানুষ, বোকা মানুষ!
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য শান্তি চিরজীবী হউক।
২৩. সেদিন স্নান করিয়া আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
সেদিন স্নান করিয়া আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া চুল আঁচড়াইতে গিয়া কাজলের চোখে পড়িল একটি রুপালি সূতা।
আশ্চর্য! পাকাচুল নাকি?
হ্যাঁ, তাই বটে। ডানদিকে, কানের একটু ওপরে। পাকা চুল।
কাজল প্রথমে একটু অবাক হইল। তাহার পর হাসি পাইল। একটু ভয়ও করিল।
বাবার সঙ্গে সেই জাদুঘর দেখিতে যাওয়া। কলিকাতার বাড়িতে বাবার জ্বর, বারান্দার কোণে ঝুড়িতে বাবার প্রিয় পালং শাকের গোড়া শুকাইয়া যাইতে দেখিয়া বুকের ভিতর হুঁ হুঁ করিয়া ওঠা। মামাবাড়ির ঘাটে বাবাকে নৌকা হইতে নামিতে দেখিয়া সে কেমন দৌড়াইয়া গিয়া বাবার কোমর জড়াইয়া ধরিয়াছিল। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের কত মায়াময় প্রভাত, প্রিয়জনের মুখ, কত হলুদ আলোয় ভরা অপরাই। সব তো এই সেদিনের কথা। সেসব আর ফিরিবে না বুঝি? সে প্রৌঢ়ত্বের প্রথম ধাপে পৌঁছাইল তবে?