এমনিতে বেশ সুন্দর পরিচিত একটি গার্হস্থ্য দৃশ্য। একজন গৃহবধু আপনমনে বসিয়া ফুলের মালা গাঁথিতেছে। এই দৃশ্য লইয়া কত কবিতা লেখা হইয়াছে, কত শিল্পী ছবি আঁকিয়াছে, কত তরুণ এই দৃশ্য দেখিয়া অজানা নায়িকাকে প্রাণমন সমর্পণ করিযাছে।
কিন্তু রোম্যান্টিক অস্বচ্ছতা সরাইয়া ভিতরে তাকাও। সব মিথ্যা। অর্থহীন।
চরাচরব্যাপী কিছু না-র মধ্যে কেন বস্তুর আবির্ভাব? ঈশ্বরের পরিকল্পনা? বেশ, কে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা? কারণ অনুপস্থিত, কিন্তু কার্য ঘটিতেছে এমন তো মানা যায় না।
তুলি মুখ তুলিয়া কাজলকে দেখিতে পাইয়া বলিল—একটু এসো না, এইখানে বসে আমাকে একটা করে ফুল এগিয়ে দাও।
কাজল অন্যমনস্কভাবে খাটের একপাশে বসিল। একটি করিয়া বকুলফুল সে তুলির হাতে দেয়, তুলি সেটিকে ছুঁচে গাঁথিয়া আবার হাত বাড়ায়। দেখিতে দেখিতে সুন্দর একটি মালা গড়িয়া উঠিতে লাগিল।
একটু পরে কাজল অবাক হইয়া দেখিল বসিয়া বসিয়া ফুল হাতে তুলিয়া দেওয়ার মতো আপাত নীরস এবং একঘেয়ে কাজও তেমন খারাপ লাগিতেছে না। বরং মালাটি ক্রমে বড়ো হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নিবিড় তৃপ্তি চেতনার মধ্যে ছড়াইয়া পড়িতেছে। ফুল ছিল, ছুঁচ ও সূতা ছিল, কিন্তু মালাটি এই বিশ্বে কোথাও ছিল না। সেটি মানুষের নির্মাণ, রিক্তহস্ত মানুষের সবচেয়ে বড়ো গৌরব।
যখন আলো কমিয়া আসিয়াছে, তখনও দুজনে বসিয়া শেষ কয়েকটি ফুল সূতায় পরাইতেছে। দুজনের মাথা প্রায় এক হইয়া গিয়াছে।
অজস্র বকুলের বেশ বড়ো একটা মালা হইল। তুলি বলিল—চল তো, চেয়ারে দাঁড়িয়ে বাবার ছবিতে পরিয়ে দেবে। আমি হাত পাই নে—
রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়া মিটিলে হৈমন্তী খোকাকে তাহার কাছে লইয়া গেল। তুলি মশারির একটা কোণ খুলিয়া ওদিকে সরাইয়া দিয়া বলিল—আজ কিন্তু এখনি ঘুমোব না। এসো, দুজনে মিলে সুডো খেলি–
লুডো জিনিসটা কাজল মোটই ভালোবাসে না, কিন্তু তুলির আগ্রহ দেখিয়া সে রাজি হইল। তুলির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা তাহার পক্ষে কঠিন।
খেলা আরম্ভ হইল। তুলির লাল খুঁটি, তাহার সবুজ। কাজল তুলির হইয়া তাহার খুঁটি চালিয়া দিতে লাগিল। তুলি কৌটা নাড়িয়া চাল দেয়, কতর দান পড়িয়াছে দেখিয়া কাজল তুলির খুঁটি আগাইয়া দেয়। তুলি সরল ও সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, দান চালিয়া সে স্বামীর দিকে তাকাইয়া বসিয়া থাকে, কতক্ষণে সে খুঁটি চালিবে।
একবার কাজলের ছয় পড়িল, আর একবার চালিতেই দুই। মোট আট। কাজল দেখিল যে খুঁটি তাহার মধ্যপথে আছে তাহা আটঘর অগ্রসর হইলে তুলির প্রায় পাকা একটি খুঁটি মারা পড়ে। সে দ্রুত ভাবিয়া নতুন একটি খুঁটি ঘর হইতে ছযেব দানে বাহিব করিয়া মধ্যপথে থাকা খুঁটিখানা দুইঘর আগাইয়া দিল। তুলির খেলা কি নষ্ট করা যায়?
তুলি এই সূক্ষ্ম আত্মদানের মহিমা কিছুই বুঝিল না, বলিল–যাক, তোমার একটা খুঁটি বের হল। তোমার এত কম ছয় পড়ে কেন বল তো?
কয়েকদান পরে তুলির পাঁচ পড়িল। ছয় পড়িলে একটি খুঁটি ঘবে উঠিতে পারিত। কাজল খুঁটি হাতে লইয়া একঘর আগাইয়া সুনিল-এক, দুই, দুই, তিন, চাব আর এই হল পাঁচ। বাঃ উঠে গেল।
তুলি ভারি খুশি হইল। পরক্ষণেই তাহার মনে হইল সে জিতিতেছে মানেই স্বামী হারিতেছে। স্বামীব পবাজয়ে এতটা খুশি হওয়া বোধহয় ভালো দেখাইতেছে না। সে বলিল—লুডো খুব সোজা খেলা। তুমি একটু মনোযোগ দিয়ে খেললেই জিততে পারবে—
গভীর রাত্রিতে একবার ঘুম ভাঙিযা কাজল দেখিল মাথাব কাছের জানালা দিযা বিছানায় মৃদু জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়াছে। খোকা ঘুমের মধ্যে একবার হাসিয়া উঠিল। তুলির নিঃশ্বাসের শব্দ।
বিশ্ব নিবৰ্থক, দেশ-কাল স্বপ্নমাত্র, বাঁচা মানে বুদ্ধিহীন কালযাপন। কিন্তু তাহারই ভিতর মানুষ খেলা করে। খেলাই আসল। মানুষের নিজস্ব নির্মাণ। বকুলফুলের মালাটির মতো।
মমতাহীন যান্ত্রিক বিশ্বের উদ্দেশে প্রতিস্পর্ধী মানুষের নান্দনিক উত্তর।
সেদিন কলিকাতায় কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে স্কুলজীবনের এক বন্ধুর সহিত কাজলের দেখা হইয়া গেল। বন্ধু সামনে ঝুঁকিয়া ফুটপাতের এক পুস্তক-বিক্রেতার সাজাইয়া রাখা বইয়ের স্তূপের মধ্যে কী খুঁজিতেছিল। কাজল তাহার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল—কী রে রাখাল, কী খবর? আর যাতায়াত করিস না, এক্কেবারে ডুব দিয়ে বসে আছিস কেন?
রাখাল চাপড় খাইয়া প্রথমে অবাক হইয়া পেছন ফিরিয়া তাকাইল, তাহার পর খুশি হইয়া বলিল—আরে অমিতাভ! কেমন আছিস? এখানে কী করছিস?
-বাবার পাবলিশারের কাছে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে আসি। তুই?
-ছেলের বই কিনছি রে ভাই। সব নতুন বই কেনার রেস্ত নেই, আমার উপার্জন তো জানিস।
–ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে?
—এইটে। আর মেয়ে থ্রি-তে।
–মেয়েও আছে বুঝি?
রাখাল অবাক হইয়া তাকাইল, বলিল—তুই তো শালা দেখছি বুধূই রয়ে গেলি। মেয়ে না থাকলে সে ক্লাস থ্রি-তে পড়ছে কী করে?
যুক্তির সারবত্তা কাজলকে স্বীকার করিতে হইল।
রাখালের চরিত্র বিশেষ বদলায় নাই। সে এখনও হৈ-হৈ করিয়া কথা বলে, অনর্গল ভুল ইংরাজিতে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল সে এখনও বড়ো লেখক হইবার আসা পোষণ করে, রোজ একটি করিয়া কবিতা লেখে এবং তিন-চারপাতা করিয়া গদ্যরচনা করে। একখানি উপন্যাস নাকি শেষ হইয়া আসিল বলিয়া।
কাজল বলিল—বাঃ, সাহিত্যসাধনা চালিয়ে যাচ্ছিস শুনে ভালো লাগছে–