- বইয়ের নামঃ তৃতীয় পুরুষ
- লেখকের নামঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. হেমন্তের পড়ন্ত হলুদ রৌদ্র বেলা
ভূমিকা
কাজল-এর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল উনিশশো সত্তর-এর জুলাই মাসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণীতে পড়ি। শুরু করেছিলাম আরো অনেক আগে, যখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ত্রিশ কী বত্রিশ পাতা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। এম.এ. পড়বার সময় সাহিত্যিক মনোজ বসুর প্রেরণায় গরমের ছুটিতে মাত্র দু মাসে লেখাঁটি শেষ করি।
তারপর সাতাশ বছর কেটেছে। এই দীর্ঘ আড়াই দশকেরও বেশি সময়ে অনেক চিঠি পেয়েছি, সভা-সমিতিতে বহু মানুষ জিজ্ঞাসা করেছেন–তারপরে কাজলের কী হল? সে কি ফিরে গেল নিশ্চিন্দিপুরে? কী পেশা গ্রহণ করল সে? কে কে তার জীবনে এল এবং গেল?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার একটা দায় অনুভব করেছি। তাই কাজলের এ দ্বিতীয় পর্ব। আমার জীবন, আমার উপলব্ধির প্রতিফলন কাজল। আমার বর্তমান বয়েস পর্যন্ত কাজলকে এনে বই শেষ করলাম। এর পরে কী হবে তা তো আর আমি জানি না।
প্রথম পর্বের ভূমিকা মা লিখেছিলেন। অনেক পাঠক বলেন ভূমিকাটি না কি মূল উপন্যাসের চেয়েও ভালো হয়েছিল। মা নেই, চলে গিয়েছেন গতবছর। আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কি বইটি পড়লেন? কেমন লাগল তার?
এই পর্বও সাধুভাষায় লিখলাম। ভাল কি মন্দ করলাম জানি না, কিন্তু চলিত বাংলায় লিখলে পূর্বের তিনটি উপন্যাসের সঙ্গে মেজাজের মিল হত না। দীর্ঘ ছ বছর লাগল এই বই লিখতে। শুরু করবার পর এসে গিয়েছিল বিভূতিভূষণ জন্মশতবর্ষ। প্রায় তিনবছর কিছুই লিখিনি।
গল্প জমাবার প্রলোভনে লুব্ধ হইনি, প্রকৃত জীবনকে মর্যাদা দিয়েছি। তবে লেখক লেখেন বটে, কিন্তু গ্রন্থ আসলে পাঠকদের। শেষ বিচারও তাদেরই।
কৃতজ্ঞতা মিত্র ও ঘোষ-এর সবার প্রতি। তাঁরা আজীবন আমার ওপর স্নেহবর্ষণের প্রতিশ্রুতিতে আরদ্ধ।
তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ
হেমন্তের পড়ন্ত হলুদ রৌদ্র বেলা যাইবার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব মায়াময় হইয়া উঠিলে চিরকালের অভ্যাসমতো কাজল একটা খাতা বা বই হাতে বাহির হইয়া পড়ে। জীবনে এমন কিছু শিক্ষা আছে যাহা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুমহাশয়রা দান করিতে পারেন না, অথচ যাহার উপর নির্ভর করিয়াই মানুষের জীবন আরর্তিত হয়। প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য হইতে কাজল সেই একান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করিতেছিল। সদ্যোজাত শিশুকে যেমন মাতৃস্তন্য পান করিবার কৌশল শিখাইয়া দিতে হয় না, আপন ক্ষুধার তাড়নায় এবং সহজাত প্রবৃত্তিবশত সে নিজেই জীবনদায়িনী পীযুষধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়—তেমনি কাজলের হৃদয়ের একেবারে গভীরে যে বিপুল ক্ষুধা জাগিয়া উঠিয়াছিল তাহারই নিবারণের জন্য সে ব্যগ্র দুই হাতে প্রকৃতির ভাণ্ডার হইতে বাঁচিবার উপাদান সংগ্রহ করিয়া লইতেছিল।
তার সহজাত প্রবৃত্তির দিকটা আসিয়াছিল বাবার কাছ হইতে। বাহিরে যতই আলো থাক, বন্ধ ঘরে সে আলো প্রবেশ করে না। বাবা তাহার মনের জানালাগুলি নিজের হাতে খুলিয়া দিয়া গিয়াছে।
বয়েস বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে কাজল লক্ষ করিল অশৈশব লালিত সহজ বিশ্বাসগুলি একে একে বিদায় লইতেছে। দেবমূর্তি দেখিলে অভ্যাসবশত এখনও দুই হাত প্রণামের ভঙ্গিতে কপালের দিকে ওঠে বটে, কিন্তু তাহার সহিত বিশ্বাস ও প্রাণের যোগ থাকে না। মানুষের সারল্য এবং ভালো দিকের ওপর যে গভীর আস্থা ছিল, দুনিয়ার রকমসকম দেখিয়া তাহাও অনেকখানি ক্ষয় পাইয়াছে। বস্তুত এখন তাহার মনে হয় পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক জীবনের গূঢ় রহস্য জানিবার জন্য বা সততার পরীক্ষা দিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া বসিয়া নাই, তাহারা বাঁচিয়া আছে জীবনযাপনের বেলায় মোটারকম লাভ করিয়া সুখে কাল কাটাইবার জন্য। কেহ অন্যরকম কিছু করিলে তাহারা অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকে।
প্রকৃতির অনাদ্যন্ত প্রসারের মধ্যে এই হীনতা নাই। সেখানে সব কিছুই বড়ো মাপের। আকাঙ্ক্ষা, বিস্ময়, আনন্দ এবং বেদনা যত বড়ো মাপেরই হোক, প্রকৃতির বিস্তারের ভিতব তাহা বেশ খাপ খাইয়া যায়। বোধহয় এই কারণেই তীব্র হর্ষ বা বেদনার মুহূর্তে মানুষ উধ্বমুখে আকাশের অসীমতার দিকে তাকায়। বোধহয় এইজন্যই কাজল জীবনের গঢ় প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজিবার জন্য বই হাতে মাঠের দিকে চলিয়া যাইবার অভাস করিয়াছিল।
কিছুই তুচ্ছ নয়, কিছুই ফেলিয়া দিবার মতো নয়। গ্রামের পথে চলিয়া যাইতে যাইতে বাশঝাড়ের পাশে কুড়াইয়া পাওয়া একটা পাখির পালক—তাই যেন কী অমূল্য সম্পদ। বহুদিন পরে পুরানো ডায়েরির পাতার ভাজ হইতে অকস্মাৎ বাহির হইয়া পালকটা মনোরাজ্যে কী ভয়ানক গোলযোগ উপস্থিত করে। কবেকার বিস্মৃত প্রথম যৌবনের আনন্দমাখা দিনের স্পর্শ এখনও উহার গায়ে লাগিয়া আছে। কী হইয়াছিল সেদিন? কেমন করিয়া সুর্য উঠিয়াছিল? দক্ষিণ হইতে বহিয়া আসা সুরভিত বাতাস কোন্ স্বপ্নরাজ্যের সন্ধান দিয়াছিল?
সমস্তটা মনে পড়ে না। পাখিটাও মরিয়া গিয়াছে হয়তো কবেই। তবু ফেলিয়া দেওয়া যায় না। রেলওয়ে স্টেশনের সামনে হইতে পরবর্তী মহকুমা শহরের দিকে যে পাকা সড়ক চলিয়া গিয়াছে তাহা ধরিয়া মাইলখানেক হটিলেই পথের দুইধারে ছোট ছোট সুন্দর গ্রাম পড়িতে থাকে। রঙ্গপুর, সাইবনা-ভারি মিষ্টি নাম গ্রামগুলির। এই সড়ক ধরিয়া মাইল তিনেক যাইবার পর বাঁদিকে নামিয়া গেলে একটা বিশাল বিলের প্রান্তে রাস্তা শেষ হইয়া যায়। গতবৎসর বসন্তকালে আমের বউল দেখিবার জন্য বাহির হইয়া কাজল জায়গাটা আবিষ্কার করিয়াছে। সেই প্রথম দিনটার কথা সে কখনও ভুলিবে না। পাকা সড়ক হইতে নামিয়া প্রথমে চাষিদের কয়েকটি বাড়ি-খড়ের চাল, গোবর দিয়া উঠান নিকানো। শালিক চড়ইয়ের দল মাটিতে ছড়ানো শস্যের দানা খুঁটিয়া খাইতেছে। উঠানের প্রান্তে মাচার উপর শসা, কুমড়া বা লাউয়ের লতা বাড়িয়া উঠিয়াছে। বাতাসে রৌদ্রদগ্ধ মাটির গন্ধ। সব মিলাইয়া চারদিকে কেমন একটা শান্তির ছবি। বাড়ি কয়খানা ছাড়াইলেই একটা বেশ বড়ো আমবাগান। সবগুলি গাছেই অসম্ভব বউল আসিয়াছে, পাতা দেখা যায় না। আশ্চর্য গভীর সুবাসে বসন্ত-অপরাহের বাতাস মদির হইয়া আছে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের লাইনস রিট ইন আর্লি সামার মনে পড়াইয়া দেয়। কবিরা ঠিকই বলেন, এইরূপ গন্ধে মাতাল হইয়া মৌমাছিরা ফুলের উপর ঘুমাইয়া পড়িতে পারে বটে।