হৈমন্তী তাহাকে কাছে টানিয়া বলিল–ওমা বুড়ো, তুই কাঁদছিস? তুই না বি. এ. পড়িস? বই পড়ে কান্না!
–আমি মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য একটা কিছু করবো, দেখে নিয়ো। সারাজীবন যারা কষ্ট পায়, চোখের জলে ডুবে থাকে, আমি তাদের নতুন পৃথিবী তৈরি করে দেবো।
-আমি জানি বাবা, তুই পারবি।
–বি. এ.-টা দিয়ে আমি চাকরি নিয়ে চলে যাবো কোনো নির্জন জায়গায়। মৌপাহাড়ি স্কুলে মাস্টারি করবে হয়তো। তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো মা?
–তোকে ছেড়ে কোথায় থাকব বুড়ো? তুই তো আমার সব।
-আমি বেশি টাকাপয়সা দিতে পাবো না মা, কিন্তু তোমাকে শাস্তি দিতে পারবো। তাতে তুমি তৃপ্তি পাবে না?
–আমার কিছু চাই নে। কীর্তিমান স্বামী পেয়েছি, পুত্র যদি বিদ্বান হয়, তবে আমার সমস্ত পাওয়া হবে।
কাজল আবার শুইল বটে, কিন্তু ঘুম আসিল না। বলিল—মা, আমার একদম ভালো লাগছেন এই জীবন। পড়াশুনো হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়ব যেখানে হোক। এই তো আর কদিন পর থেকে মাঠে শিশির পড়তে শুরু করবে। বাত্তিবের পরিষ্কার আকাশে ঝকঝক করবে নক্ষত্র। পৃথিবীটা আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি বাইরে বেরুব মা, আমি কিছুতেই ঘরের কোণে সারাজীবন কাটাব না।
—তোর বাবার রক্ত রয়েছে যে তোর শরীরে, কে তোকে আটকাবে খোকন?
–বাঁচতে গেলে বিশ্বাস লাগে, তা কেন পাই না?
–ঈশ্বরে বিশ্বাস?
–শুধু ঈশ্বরের নয়, জীবনের বিশ্বাস।
—বিশ্বাস আসবে, দেখতে পাবি। মনটা খুব উদার খুব বড়ো করে রাখিস, যাতে সুখ-দুঃখ সবই সেখানে ধরে। দেখবি, দুঃখ আর সুখ তুল্যমূল্য হয়ে গেছে-দুঃখের জন্য আর কষ্ট নেই।
কাজলের মনে হইল, মা এইভাবে দুঃখকে জয় করিয়াছে। সুখ আর দুঃখের বিরাট ভার মনের ভিতর জমা করিয়া দুইটাকে এক করিয়া দেখিতে সক্ষম হইয়াছে মা। এইটাই মায়ের স্থৈর্যের মূল কথা।
পরমেশ বলিল—কী অমিতাভ, চুপ করে আছ যে?
কাজল মুখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকাইতে সে অবাক হইল। পূর্বের সে আশাহত পাণ্ডুর ভাবটা কাটিয়া গিয়া নূতন একটা উদ্যমের আলো কাজলের মুখে প্রতিফলিত হইয়াছে। চোখ দুইটা চকচক করিতেছে।
-তোমাকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছে।
—পরমেশ, আমি বোধহয় ভুল করছিলাম। জীবনের অর্থ হয়তো সত্যিই নেই—আমার এক মাস্টারমশাই বলতেন, জীবন শুধুই sound আর fury, আর কিছু নয়। শেকপীয়রই হয়তো ঠিক, তবু বেঁচে থাকার মানে একটা খুঁজে বের করবোই পরমেশ। লোক ভুলোনো দর্শন নয়, বাস্তব একটা কিছু দিয়ে যাবো–
পরমেশ কাজলের হাত চাপিয়া ধরিল।
–আমি বিশ্বাস করি অমিতাভ, তা তুমি পারবে
-আমাকে দূরে চলে যেতে হবে মানুষের থেকে, আরও বেশি করে মানুষের ভেতরে ফিরে আসার জন্য। আমি পেছনে হাঁটবো পরমেশ।
দুইজনে হাঁটিয়া মিউজিয়ামে গেল। পরমেশ জানে, কাজল সঙ্গে থাকিলে মিউজিয়াম দেখার আনন্দ আলাদা। বেলা গড়াইয়া বিকালের দিকে ঝুঁকিয়াছে। মিউজিয়ামে লোক প্রায় নাই বলিলেই হয়। বড়ো বড়ো মূর্তি এবং দুষ্প্রাপ্য অনেক বস্তু বোমার ভয়ে মাটির নিচে পুঁতিয়া ফেলা হইয়াছে। ঘরগুলি কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে।
পরমেশ বলিল—অনেক কিছু নেই, রিপ্লেসড লেখা টিকিট পড়ে আছে।
–ইউনিভার্সিটিও বহরমপুরে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে, জান না?
বহুদিন বাদে কাজলের মনে আবার পুরাতন আনন্দটা ফিরিয়াছে। মিউজিয়াম হইতে বাহির হইয়া দেখিল রৌদ্র পড়িয়া গিয়াছে, শীতকালের বেলা নাই বলিলেই চলে। গেটের সামনে ফুটপাতের উপর ইটের বেড় দিয়া ঘেরা কৃষ্ণচূড়া গাছ। তাহার ডালগুলি অস্তদিগন্তের পটে আঁকা বলিয়া মনে হইতেছে। বাতাস নাই, সব নিঝুম। সন্ধ্যার কেমন একটা বিষণ্ণতা–তাহাদের দিকে তাকাইয়া বুঝি ওষ্ঠে তর্জনী রাখিয়া চুপ করিতে সঙ্কেত করিতেছে।
পাতলা জামা গায়ে কাজলের শীত করিতেছিল। ফিরিতে এত দেরি হইবে, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। পরমেশকে বলিল—চলো, রাত হয়ে এলো।
ধর্মতলা মোড়ে একটা বাচ্চা মেয়ে, নোংরা জামা পরা, কাজলের গায়ে ধাক্কা খাইল। কাজলের হাত হইতে বইখাতা ধুলায় পড়িয়া গেল। পালায নাই মেয়েটি, ভয়ে পালাইতে পারে নাই। আতঙ্কে কেমন যেন হইয়া গিয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে। বয়স বেশি নহে, নয় কী দশ হইবে হতদরিদ্রের চেহারা, কিন্তু চোখ দুটি উজ্জ্বল। কাজলের হঠাৎ ওল্ড কিউরিওসিটি শপ-এর ডিক সইভেলারের ছোট্ট বান্ধবীটির কথা মনে পড়িল। কাজল ভাবিল-ও ভেবেছে, আমি ওকে বকবো। কী সুন্দর চোখ দুটো ওর!
মেয়েটির হাতে একখানি একআনা দামেব পাঁউরুটি, এইটি কিনিতেই সে আসিয়াছিল, রাস্তা পার হইয়া ফিরিবার সময় ধাক্কা লাগিয়াছে। পাঁউরুটি শক্ত করিয়া ধরিয়া মেয়েটি কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েটির চোখ, পাউরুটি আঁকড়াইয়া ধরিবার ভঙ্গি, সন্ধ্যাবেলার বিষণ্ণতা, সব মিলাইয়া কাজলের মনে একটা ঢেউ তুলিল—মেয়েটির চোখে চোখ রাখিয়া সে হাসিল। মেয়েটি হাসিল না।
কাজল বলিল–তোমার নাম কী খুকি? কোথায় থাকো?
উত্তর না দিয়া মেয়েটি রাস্তার ওপাবে তাকাইল, সেখানে এক অন্ধ ভিখারি ঘোড়ার জল খাইবার চৌবাচ্চার কিনারায় বসিয়া আছে। কাজল বলিল–ও কে হয় তোমার–বাবা?
মেয়েটি ঘাড় নাড়িল। কাজল পকেট হইতে একটা আনি বাহির করিয়া বলিল—এটা তুমি নাও।
মেয়েটি কিছুতেই লইবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর হাত হইতে আনিটা লইয়া সে সংকুচিতভাবে হাসিল, তারপর হঠাৎ ফিরিয়া লোহার চৌবাচ্চাটা লক্ষ করিয়া দৌড় দিল।