নিশ্চিন্দিপুরের সহিত কাজলের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। অথচ কোথায় ছিল সে এক বৎসর আগে! দাদামশায়ের ভয়ে জুজু হইয়া থাকিতে হইত। প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ সে দাদামশায়ের কাছ হইতে পায় নাই কখনও—তাড়নাই জুটিত বেশি। কেবল দিদিমার কথা মনে পড়ে। বাবা যে তাহাকে মামাবাড়ি হইতে নিজের বাড়িতে লইয়া আসিল-দিদিমা পাইল না। তাহা দেখিতে। দিদিমাই যা-একটু বাবার গল্প করিত। আর কাহারও জন্য মন খারাপ করে না তত। এখানে সে ভালোই আছে। বাবা নাই বটে-কিন্তু বাবা তো আসিবে। পিসি তাহাকে ভালোবাসে। সবার উপর তাহকে আকর্ষণ করে গ্রামের একটা নীরব ভাষা। কেহ সঙ্গে থাকিলে অনেক সময় ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে যখন সে নিজেদের পুরাতন ভিটায় যায়-অন্তত তখন তো নয়ই। সম্পত্তির স্বত্ববোধ তাহার মধ্যে এখনও জন্মে নাই। কিন্তু নিজের পিতৃপুরুষের ভিটায় বসিয়া চিন্তা করার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি আছে-তোহা মনকে দোলা দেয়। দুপুরে গিয়া জঙ্গল ঠেলিয়া চুপি চুপি সে উঠানে বসিয়া থাকে। চুপি চুপি বসিবার বিশেষ কারণ আছে। এদিকে বিশেষ লোকজন আসে না-আসিবেই বা কী প্রয়োজনে? একমাত্র আকর্ষণ সজিনাগাছটাও কুড়া হইয়া গিয়াছে, ফল ভালো হয় না তত। কাজেই সেজন্য সতর্ক হইবার প্রয়োজন নাই। আসলে এই জায়গায় উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না একেবারে। অন্য জায়গা হইলে কাজল বটের ঝুরি ধরিয়া বুলিয়া, এখানে ওখানে লাফাইয়া এক তাণ্ডব বাধাইয়া তুলিত। কিন্তু এ ভিটায় আসিয়া বসিলে কে যেন তাহার ছোট্ট মনটাকে শান্ত করষ্পর্শে স্নিগ্ধ করিয়া দেয়। এখানে তাহার ঠাকুমা রান্না করিয়াছেপিসি পুতুল খেলিয়াছে-বাবা রাজা সাজিয়াছে আরশির সামনে-ঠাকুরদা বসিয়া বালি কাগজে পালা লিখিয়াছে। তাঁহাদের পুণ্যস্মৃতিমণ্ডিত স্থানে কি প্ৰগলভ হওয়া যায়? কেহ তাহাকে বলিয়া দেয় নাই। সে আপনি চুপ হইয়া থাকে। দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া যায়। কেমন একটা অদ্ভুত ছায়া নামিয়া আসিতে থাকে। কাজলের মনে হয়, এই বুঝি কেহ পিছন হইতে কথা বলিয়া উঠিবে। যেন সে আমলটা শেষ হইয়া যায় নাই। সে মিথ্যা বলিবে না-ভূতপেত্নীতে তাহার একটু ভয় আছে। কিন্তু এই সময় যদি তাহার ঠাকুমা কী পিসি আসিয়া তাহার সহিত কথা বলে, তবে সে একটুও ভয় পাইবে না। সে তো তাহদের একান্তু আপনার, কাহারও নাতি-কাহারও ভাইপো। কত আদর করিত সবাই বাঁচিয়া থাকিলে। একটু আগের রাঙা বাসন্তী রোদটার মতোই তাহারা কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিবার সময় গাছের মাথায় সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করিতে থাকে। বাবা তাহাকে চিনাইয়া দিয়াছিল সব। কালপুরুষ ঝুঁকিয়া থাকে। পশ্চিম দিগন্তের কাছাকাছি। বাবা একবার বলিয়াছিল কালপুরুষের ছোরাটা যে তিনটি নক্ষত্ৰ দিয়া তৈয়ারি-তাহার মধ্যে একটা দেখিতে নক্ষত্র বলিয়া মনে হইলেও আসলে নীহারিকা। সে একটা দূরবীন পাইলে দেখিবার চেষ্টা করিত। যাহা হউক, আপাতত আমবাগানটা তাড়াতাড়ি পার হইয়া যাওয়া ভালো। সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে।
বাড়ি ঢুকিলে রানি বলে-এতক্ষণ ছিলি কোথায়, হ্যারে-ও খোকন? এই রাতবিরেতে কি বাইরে বেড়াতে আছে বাবা? কোথায় ছিলি?
কাজল আরক্ত মুখে আমতা আমতা করিয়া বলে-এই, একটু ওই পুরানো ভিটেয়—
রানি আর প্রশ্ন করে না। তাহার হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা কেমন সুন্দর লাগিতে থাকে। খোকন চিনিয়া লইয়াছে আপনার সঠিক স্থান। রক্তের ভিতরকার অমোঘ আকর্ষণ তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে পবিত্র তীর্থে। ঐতিহ্যের ধারার গতি ধীর-কিন্তু অনিবাৰ্য। এ ভিটাকে ছাড়িয়া তাহারা কেহ। কোথাও থাকিতে পারে নাই। অপু গিয়াছিল চলিয়া-সেও কি বেশিদিন পারিল দূরে থাকিতে? বংশের সন্তানের হাত ধরিয়া আবার তো সেই ফিরিয়া আসিতেই হইল। কী যেন টান রহিয়া যায়, তাহা রানি ব্যাখ্যা করিতে পারে না। হয়তো এতদিনে মণিকণিকার ঘাট হইতে হরিহরের দেহাবশেষ বাতাসে ভাসিয়া অন্ধ সংস্কারে ফিরিয়া আসিয়াছে নিশ্চিন্দিপুরে। সর্বজয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি হয়তো এখনও ভিটার অণুতে অণুতে। গোবৎস যেমন জন্মগ্রহণ করিয়াই ঠিক মাতৃস্তন্য খুঁজিয়া লয়তাহাকে চিনাইয়া দিতে হয় না, কাজলকেও তেমনি কোন নির্দেশ দিতে হয় না। সমস্ত বিশ্বজগৎটা একটা নিয়মের শৃঙ্খলে বাধা পড়িয়া গিয়াছে। কাহাকেও কিছু বলিতে হয় না-করাইয়া দিতে হয় না। সব ঠিক ঠিক চলে।
মাস দুই পরের কথা। গরম বেশ পড়িয়াছে। আজ আহার করিতে একটু বেলা হইয়াছিল। রানি এখনও কাজলকে বাহির হইতে দেয় নাই, বিশ্রামের জন্য নিজের কাছে শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কাজল কান্ত হইয়া শুইয়া পা দুইটা পিসির গায়ে তুলিয়া দিয়া গল্প শুনিতেছিল। রানির হইয়াছে বিপদ-যতই গল্প চলুক, কাজলও ঘুমায় না।–তাহারও ঘুম হয় না। এমন সময় বাহির হইতে কে ডাকিল-শ্ৰীমান অমিতাভ রায়, চিঠি আছে-অমিতাভ রায়! কাজল প্রথমটা বিশ্বাস করে নাইনিশ্চয়ই ভুল শুনিয়াছে। তাহাকে চিঠি লিখিবে কে?
দৌড়াইয়া চিঠিটা নিতে গেল সে। বেশ মোটা কাগজে রঙীন খামের চিঠি। রানিও উঠিয়া আসিয়াছিল কাজলের পিছু পিছু। সে বলিল–খোল তো খোকন, কার চিঠি-।