একদিন রাস্তায় আদিনাথবাবুর সহিত দেখা হইয়া গেল। সে প্রণাম করিয়া বলিল—ভালো আছেন সার?
আদিনাথবাবু কাজলকে জড়াইয়া ধরিলেন, বলিলেন—তুই কেমন আছিস অমিতাভ? তোর চেহারা বড় খারাপ হয়ে গেছে, অসুখবিসুখ করেছিল নাকি?
–না সার।
—তবে এমন চেহারা কেন?
কাজলের মনে হইল আদিনাথবাবু তাহার মনের কথা বুঝিবেন, তিনি তাহাকে সমাধানের পথ বলিয়া দিতে পারিবেন। কিন্তু বলিতে গিয়া দেখিল, জিনিসটা সে সহজে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না। জীবনের কোনো অর্থ নাই, একথা ভাবিয়া তাহার বয়সী একটি ছেলের রাত্রে ঘুম হইতেছে না, ইহা রীতিমত হাস্যকর। এই কথা ভাবিয়া শরীর খারাপ হওয়া নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে অবিশ্বাস্য। সে বলিল—আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না সার। ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি, তার সঙ্গে আমার মন যেন আর খাপ খাচ্ছে না।
–পরিষ্কার করে বল।
-সার, এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার মানে কী? এত কষ্ট করে পড়াশুনা করা, জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, জীবনকে ভালোবাসা-এর কী অর্থ? মৃত্যুর পর তো একটা ভয়ানক অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নেবেই।
মালতীনগর স্টেশনের লোকের ভিড়ে ব্যাগ হস্তে আদিনাথবাবুর সামনে দাঁড়াইয়া কথাটা ভীষণ নাটকীয় শোনাইল। কাজল বুঝিতে পারল, বিষয়টা সে পরিষ্কার করিতে পারে নাই কিছুটা ফঁকা আওয়াজ হইয়াছে।
কিন্তু আদিনাথবাবুর মুখ আস্তে আস্তে গম্ভীর হইল। কাজলের কাঁধে হাত দিয়া বলিলেন—চ, কোনো জায়গায় বসে কথা বলি।
স্টেশন ছাড়াইয়া নির্জন পথে পড়িয়া বাঁধানো কালভার্টের উপব আদিনাথবাবু বসিলেন। বলিলেন–বোস আমার পাশে।
কাজল বসিল।
কিছুক্ষণ আদিনাথবাবু কথা বলিলেন না, ব্যাগটা পায়ের কাছে নামাইয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। কাজলও পাশে বসিয়া রহিল। সময় কাটিতেছে, কাহারও যেন কথা বলিবার চাড় নাই।
আদিনাথবাবু হঠাৎ কাজলের দিকে তাকাইয়া গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পড়িবার মতো করিয়া বলিলেন—তোর জীবনের সুখ একেবারে চলে গেছে অমিতাভ, আর কখনও আসবে না।
কাজল চমকাইয়া উঠিল। কথাগুলি তাহার বুকের গভীরে যেন তীক্ষমুখ শলাকার মতো বিধিয়া গেল। মাস্টারমশাই ঠিকই বলিয়াছেন—তাহার মতো করিয়া আর কে বুঝিয়াছে যে সুখ আর কখনও আসিবে না? সঙ্গে সঙ্গে কাজলের মেরুদণ্ড বাহিয়া একটা ভায়ের স্রোত নিচে নামিয়া গেল। যে অসুখ শুরু হইয়াছে, তাহা কখনও সারে না।
—অমিতাভ।
—সার?
আদিনাথ বলিলেন-যে চিন্তা করে, তার জীবনে কখনও সুখ আসে না। তুই জীবনের একেবারে আসল জায়গায় ঘা দিয়েছিস। ভাবতে অবাক লাগছে, এত অল্প বয়সে তুই এই চিন্তা পেলি কোথা থেকে।
—একটা কথা বলব সার?
–বল্?
–কী মনে হয় আপনার জীবন সম্বন্ধে? আপনি কি বিশ্বাস করেন মৃত্যুতেই জীবনের শেষ?
–সত্যি উত্তর দেবো?
–তা নইলে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো কেন?
-আমার কিছুই মনে হয় না। অনেকদিন আছি পৃথিবীতে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই আমার চিন্তাশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। এখন আমি দেনায় জর্জরিত ভবিষ্যৎহীন বৃদ্ধ। আমার এই বর্তমানের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? তবুও অমিতাভ আমার মন চায়, একটা কিছু অর্থ থাকুক এ-সবের। কিন্তু আমি জানি, সমস্ত জিনিসটা signifies nothing কেবল sound অমিতাভ, কেবল fury, আর কিছু নয়।
অকস্মাৎ আদিনাথবাবু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন-ওসব চিন্তা একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি। এককালে খুব ভাবতাম, বুঝলি? এখন তোদর জন্যই বেঁচে আছি বলতে পারিস। তোরা মানুষ হবি, বড়ো হবি—বিশ্বাস কর, আমার খুব ভালো লাগবে দেখতে।
-আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন সার?
–তুই বিশ্বাস করিস?
–করতে ইচ্ছা হয়, পারি না।
–কেন?
–বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে দেখলে কোনো মানে হয় না বলে।
–বুদ্ধি দিয়ে যা বোঝা যায় না, তা মিথ্যে?
—তাকে হৃদয় দিয়ে মেনে নেওয়া যায়, বাস্তবে স্বীকার করা যায় না।
—স্বীকার না করায় বাহাদুরি কী অমিতাভ? তাতে তো শুধু কষ্ট—
–কষ্ট তো বটেই মাস্টারমশাই। স্বীকার না করায় কিছু বাহাদুরি নেই, আমি বিশ্বাস করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু বুদ্ধিতে বাধা দেয় যে।
–অমিতাভ, আমি তোকে আশীর্বাদ কবি, তোব জীবনে যেন বিশ্বাস আসে, তুই যেন কখনও পরাজিত না হোস।
–শুধু বিশ্বাস দিয়ে কী হবে সার, যদি আসলে কোনো অর্থ না থাকে? শূন্যতায় বিশ্বাস করা কি নিজেকে ঠকানো নয়?
আদিনাথবাবু কাজলের কাঁধে হাত দিয়া একটা ঝাকুনি দিলেন, তারপর বলিলেন—তবু সে নিছক sound আর fury থেকে ভালো। বড় হয়ে তোর মনে হবে, বিশ্বাসের একটা মূল্য আছে। মনে হবেই, দেখিস।
আদিনাথবাবুর সঙ্গে কাজলের এই শেষ দেখা। এর কিছুদিন বাদেই র্তাব মৃত্যু হয়। ব্যোমকেশ হঠাৎ আসিয়া খবরটা দিয়াই আবার চলিয়া গিয়াছিল।
রাত্রে বিছানায় শুইয়া পরদিন আদিনাথবাবু আর ঘুম হইতে ওঠেন নাই। ঘুমের ভিতরেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। সংসারের জন্য এক পয়সাও বাখিয়া যাইতে পারেন নাই, কিন্তু দেনা পাই পয়সা পর্যন্ত মিটাইয়া দিয়াছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের পয়লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। ৩রা সেপ্টেম্বর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুদ্ধে নামিল। ১৮ই সেপ্টেম্বরের ভিতর পোল্যান্ডের পতন হইল। ওয়ারশ-তে নাজী বাহিনীর এমুনিশন বুটের শব্দ শোনা যাইতে লাগিল।