তারপর শীত আসিয়া গেল। কাজল শীত ভালোবাসে, শীত পড়িলে তাহার মনের ভিতরে একটা বড়ো রকমের ওলটপালট হয়। যে মন লইয়া সে গ্রীষ্ম উপভোগ করে, তাহা লইয়া কখনই শীতের রিক্ত রূপ উপলব্ধি করা যায় না। শীত আসিবার আগে হইতেই সে মনে মনে প্রস্তুতি চালাইতে থাকে, মনের জানালা হইতে পুরাতন পর্দা খুলিয়া নূতন পর্দা লাগায়, ফ্রেম হইতে ছবি খুলিয়া দেয় সেখানে নূতন ছবি লাগাইবে বলিয়া। হেমন্তের মাঠে মাঠে হাঁটিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে শীতের জন্য মন তৈয়ারি হইয়া ওঠে। খাইতে বসিয়া রান্নায় ধনে পাতার গন্ধ পাইলেই বোঝা যায় আর দেরি নাই।
ঠাণ্ডার মধ্যে মাঠে ঘুরিতে আলাদা আমেজ। মৃদু রৌদ্রে পিঠ দিয়া দূরে তাকাইয়া থাকিলে ক্রমশ মনটা উদাস হইয়া যায়। কলিকাতার কলরবের ভিতর সে নিজেকে ঠিক মেলিয়া ধরিতে পারে না–নিজের মনে বসিয়া চিন্তা করিবার অবকাশও সেখানে নাই। সমস্ত সপ্তাহ নগর জীবনের কোলাহলের মধ্যে কাটাইয়া একটা দিন শীতের মাঠে কাটাইতে ভালো লাগে। আল ছাড়াইয়া মাঠে নামিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে পায়ের নিচে মাটির ঢেলা গুঁড়াইয়া যায়, রৌদ্রদগ্ধ মাটি হইতে কেমন গন্ধ আসিতে থাকে—যে গন্ধ নিশ্চিন্দিপুরে ছোটবেলায় সে পাইত।
একদিন হাতকাটা সোয়েটারটা লইয়া কাজল কাঠালিয়ার মাঠে বেড়াইতে গেল। রৌদ্র তখন পড়িয়া আসিয়াছে, ঠাণ্ডা কিছুক্ষণ বাদেই হাড়ের ভিতর উঁচ ফুটাইতে আরম্ভ করিবে।
কাঁঠালিয়ার বাঁশবনটায় ঢুকিতে মনে হইল সে যেন স্বপ্নের রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। উৎসবের দিনে বাড়ির ছাদে সামিয়ানা খাটাইলে তাহার নিচে দ্বিপ্রহরেও যেমন একটা নরম আলো থাকে, বাঁশবনের ভিতরও তেমনি। না নড়িয়া চুপ করিয়া থাকিলে বাঁশপাতা ঝরিয়া পড়ার হালকা শব্দ শোনা যায়। বাতাস ক্রমেই ঠাণ্ডা হইতেছে, কিন্তু শীতের আমেজ জমাইবার জন্য কাজল সোয়েটার পরে নাই। একটা বাঁশের গায়ে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া সে অনুভব করে এ সমস্ত ছাড়িয়া সে বাঁচিতে পারিবে না। কলিকাতা তাহাকে প্রিয় বস্তু হইতে দূরে লইয়া যাইতেছে।
পানাপুকুরের পাশ দিয়া কাজল আখের আলির বাড়ি গেল। আখের উঠানের কিছু অংশ লইয়া একটা মুদির দোকান দিয়াছে। জিনিসপত্র বেশি নাই, নুতন দোকান। ব্যস্ত হইয়া আখের তাহাকে একটা নড়বড়ে কাঠের টুলে বসিতে দিল। কাজল বসিয়া বলিল–কেমন আছ আখের ভাই?
—আমাদের আবার থাকা না থাকা, তুমি কেমন আছ সেইটেই বড়ো কথা। তুমি তো এখন কলেজে পড়ো, না?
-হ্যাঁ, আই-এ পড়ি।
—কবছর লাগে এটা পড়তে?
–দু’ বছর। তারপর পাস করলে আবার দুবছর লাগে বি-এ পড়তে।
–বাব্বাঃ! তোমাদের দেখছি সারাজীবন ধরে পড়া আর পড়া! পড়া শেষ হতে হতে তো বুড়ো হয়ে যাবে।
–পড়াশুনো না শিখলে চলবে না আখের ভাই, চাকরি তো করতে হবে।
আখের একটা বড়ো রকমের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তা তো বটেই। আমার মতো নয়, সারাটা জীবন এখানেই কাটল–কিছুই শিখতে পারলাম না।
-কতদিন আছ তোমরা এখানে?
–অনেকদিন হয়ে গেল, আমার ঠাকুরদার বাবা প্রথমে এই জায়গায় এসে বসতি করেন। আমারও সারাজীবন এই গ্রামে কাটল বারকয়েক কলকাতায় গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু দেশ বেড়ানো যাকে বলে তা কিছুই হয়নি আমার কপালে।
এরপর আখের তাহাকে খাওয়াইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কাজল খাইবে না, সেও ছাড়িবে না। দোকানের টিন হইতে একটা ঠোঙায় করিয়া মুড়কি তাহার হাতে দিয়া বলিল—খাও, ভালো মুড়কি। নিজেদের খাবার জন্য রয়েছে, বিক্রির নয়।
আখেরের দোকান হইতে উঠিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। কিছুতেই সে ছাড়িতে চায় না। শীঘ্রই আসিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া কাজল মাঠের দিকে রওনা দিল। ঠাণ্ডা আর সহ্য করা যায় না, সোয়েটার গায়ে দিতে দিতে কাজল দেখিল, গোধূলির শেষ আলোকচ্ছটাও আকাশের গা হইতে মিলাইয়া গিয়াছে।
অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়া রোমাঞ্চকর যাত্রা। আকাশে চুমকির মতো অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। জীবনটা যেন হঠাৎ শরীরের সংকীর্ণ পরিসর হইতে বাহির হইয়া দিহীন মহাশূন্যে মিশিয়া যাইতে চাহিতেছে। কাজলের মনে হইল, জীবন পৃথিবীর গণ্ডীর মধ্যে আরদ্ধ নহে—পৃথিবীতে বাঁচিয়া আছে বটে, কিন্তু পৃথিবী শেষ কথা হইতে পারে না। আপন অস্তিত্বকে সে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া অনুভব করিতেছে—তাহা কি মিথ্যা?
কাজল আজকাল বুঝিতে পারিতেছে বাবার সহিত তাহার মানসিকতার একটা আশ্চর্য মিল আছে। বাবার উপন্যাসগুলি পড়িতে পড়িতে সে অবাক হইয়া ভাবে, এমন নির্ভুলভাবে তাহার মনের কথা বাবা লিখিল কী করিয়া? ছোটবেলায় সে যাহা ভাবিত, আকাশের দিকে তাকাইলে তাহার মনে যে ভাব হইত, সব বাবা হুবহু লিখিয়াছে।
কাজল জানে, জীবন সাধারণভাবেই কাটিয়াছে। বাবা দারিদ্র্যের সহিত যুদ্ধ করিয়া, প্রতিপদে সংগ্রাম করিয়া তবে মানুষ হইয়াছিল। সে কিন্তু জন্মের পরে খুব একটা অসচ্ছলতা দেখে নাই, দারিদ্রের ভিতর যে কল্যাণস্পর্শ আছে তাহা সে কখনও অনুভব করে নাই। মাঝে মাঝে কাজলের মনে হয়, কিছুই তাহার বলিবার নাই। ইট-কাঠ-পাথরের ভিতর বাস করিয়া কিছু বলিবার থাকিতে পারে না। তবু এ কথাও মিথ্যা নয় যে তাহার তীক্ষ অনুভূতি তাহাকে অনেক রহস্যের সম্মুখীন করিয়াছে। জীবনের ভিতরও আর একটা গভীরতর জীবন আছে, তাহা সে বুঝিতে পারে। কী করিয়া সে এসব কথা না বলিয়া পারিবে?