সুরপতির দৃঢ় বিশ্বাস কাজল বড়ো রকমেব একটা কিছু হইবে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট করিবার দিকে তাহার তেমন ইচ্ছা নাই, তিনি চান অপুর মতো কাজলও একটা স্থায়ী কিছু করুক। সন্ধ্যায় পড়াইতে পড়াইতে তিনি ডাক দেন-হৈম, একবার শুনে যা এদিকে।
হৈমন্তী আসিয়া বলে—কী বাবা?
–দেখ কাজল এই ইংরেজি এসেটা কী সুন্দর লিখেছে! বানান ভুল, ব্যাকরণের ভুল একটাও নেই। আমি বলে দিচ্ছি হৈম, এ ছেলে বংশের নাম উজ্জ্বল করবে।
—আশীর্বাদ করো বাবা, তাই যেন হয়।
হৈমন্তী নিজের ঘরে ফিরিয়া জানালার কাছে দাঁড়ায়। বাহিরে ঘন অন্ধকার। ওই অন্ধকারের ভিতর সুরপতি আলোর প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। কাজল মানুষ হইতেছে, সুরপতি বলিয়াছেন কাজল বড়ো হইবে।
ছেলেবেলা হইতে হৈমন্তী বাবাকে বড়ো বিশ্বাস করে।
১২. কাজল রিপন কলেজে ভর্তি হইল
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
স্কুল হইতে বাহির হইয়া কাজল রিপন কলেজে ভর্তি হইল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে খুব ভালো ফল করিয়াছিল—বিশেষত ইংরেজিতে। যে কোনো অধিকতর অভিজাত কলেজে সহজেই সে ভর্তি হইতে পারিত, কিন্তু একরকম জিদ করিয়াই রিপনে ভর্তি হইল।
কাজল একদিন আদিনাথবাবুকে প্রণাম করিতে গেল। আদিনাথবাবু আদর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন। কাজল বলিল—আশীর্বাদ করুন সার, যেন মানুষ হতে পারি। সবাই বলছে রিপনে ভর্তি না হয়ে প্রেসিডেন্সি বা অন্য কোথাও যাওয়া উচিত ছিল।
আদিনাথবাবু চশমা খুলিয়া কোঁচার প্রান্তে কাচ পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন—মানুষ হওয়া তোর কেউ আটকাতে পারবে না অমিতাভ। অনেকদিন ধরে শিক্ষকতা করছি, চুল পেকে গেছে-আমি মানুষ চিনি। তোর মধ্যে ক্ষমতা আছে, সেটা নষ্ট হতে দিস্ না। চশমা মুছিবার পর, না পরিয়া অনেকক্ষণ সেটা হাতে ধরিয়া রাখিলেন। অন্যদিকে তিনি তাকাইয়া আছেন। হঠাৎ তাহাকে যেন বেশি বৃদ্ধ দেখাইতে লাগিল। কাজল ভাবিল—বড্ড বুড়ো হয়ে গেছেন সার, বয়সের তুলনায়। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। একা মানুষ, কত আর খাটবেন!
মুখ ফিরাইয়া আদিনাথবাবু বলিলেন-কত আশা ছিল বড়ো হবো, নাম করবো। সেই ভাবেই জীবনটাকে তৈরি করবার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর সংসারের ঘানিকলে বাঁধা পড়ে ঘুরছি তো ঘুরছিই। বিলেত যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। সে কথা মনে পড়ে হাসি পায়। কত চিন্তা করেছি, রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি পালিয়ে চলে যাই। কিন্তু ততদিনে বড় খোকা হয়েছে। আটকা পড়ে গেছি। আর যাওয়া হল না।
নিঃশ্বাস ফেলিয়া আদিনাথবাবু বলিলেন—জীবন তো প্রায় শেষ হয়ে এলো অমিতাভ।
কাজল জানে মাস্টারমশাই খুব দুঃস্থ–মেয়ের বিবাহে সব টাকা জোগাড় করিতে না পারিয়া চড়া সুদে ধার করিয়াছিলেন, এখনও তাহা শোধ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বামুনপাড়ার মতি মুখুজ্যে টাকাটা মাসিক দুই আনা সুদে ধার দিয়াছিল মওকা বুঝিয়া। আদিনাথবাবু অনুরোধ করিয়াছিলেন সুদের হার এক আনা করিতে-মতি মুখুজ্যে শোনে নাই। ইস্কুলে কে যেন তাহাকে বলিয়াছিল কথাটা। মতি মুখুজ্যের পাশাপাশি তাহার রামদাস বোষ্টমের কথা মনে পড়িল—দুইটি চরিত্রের অদ্ভুত বৈপরীত্যের জন্য।
আদিনাথবাবু কাজলের আপত্তি না শুনিয়া তাহাকে পেট ভরিয়া জলযোগ করাইয়া ছাড়িলেন।
কলেজ সম্বন্ধে কাজলের বিরাট ধারণা ছিল। স্কুলে সে ব্যোমকেশ ছাড়া মনের মতো সঙ্গী পায় নাই। ভাবিয়াছিল কলেজে তো কত ভালো ছাত্র পড়িতে আসে দূর দূরান্ত হইতে, একজনও কি তাহার পছন্দমত হইবে না? প্রতাপ বলিয়াছিল, এই মফঃস্বলে তোর বন্ধু হবে না কাজল কলকাতার কলেজে যখন পড়বি, দেখবি কত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আছে দেশে।
–ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র দিয়ে কী করবো মামা? আমি চাই এমন বন্ধু, যে আমার মনের কথা বুঝতে পারবে, আমার মতো যে চিন্তা করবে।
-হলে কলকাতাতেই হবে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখিল তাহা হইতেছে না। ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই নিরীহ, গোবেচারা। দুএকটি বড়লোকের ছেলে আছে—তাহারা গরমে আদ্দির পাঞ্জাবি, শীতে সার্জের কোট পরিয়া কলেজে আসে, কথায় কথায় সিগারেট খায় এবং পরস্পরের পিতার কাজকর্ম লইয়া আলোচনা করে। তাহাদের সহিত কথা বলিতে গিয়া কাজল বোকা বনিয়া ফিরিয়াছে, কাজলকে তাহারা গ্রাহের মধ্যে আনে নাই। মোটর উপর কাজল দেখিল গত কয়েক বৎসরে তাহার মানসিক বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে হইয়াছে, ফলে তাহার চারিধারে বহুদূর অবধি লোকজন নাই। অগত্যা সে লাইব্রেরিতে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ছেলেবেলায় বাবার কাছে রিপন কলেজের লাইব্রেরির গল্প শুনিয়াছিল। প্রত্যেকটা বইয়ে যেন বাবার স্পর্শ লাগিয়া আছে। নানা বিষয়ে কৌতূহল থাকার দরুন লাইব্রেরির ভিতর সে যেন দিশাহারা হইয়া ওঠে। কোন বইটা ছাড়িয়া কোটা পড়িবে ঠিক করিতে পারে না। কতকগুলি পছন্দসই বই-এর লিস্ট করিয়া ফেলিল সে, এক এক করিয়া পড়িবে। এই ব্যাপারে তাহার কিছু সুবিধা ছিল, এমন সব বইয়ের সে স্লিপ দিত, যাহা সাধারণত কেহ নেয় না। দপ্তরী তাক হইতে বই পাড়িয়া তাহার হাতে আনিয়া দিলে সে ফু দিতে দিতে বলে, বাব্বাঃ, বেজায় ধুলো জমে গেছে দেখছি।
দপ্তরী হাসিয়া বলিত-বহুকাল বাদে বেরুলো তো বাবু।
কাজল অবাক হইয়া যায়। এত ভালো বই কেহ পড়ে না কেন? তাহাকে যদি লাইব্রেরিতে থাকিতে দিত, দিনরাত সে মাদুর পাতিয়া বসিয়া বই নামাইয়া নামাইয়া পড়িত। চাকরি হইলে সে টাকা জমাইয়া ভালো লাইব্রেরি করিবে-বাড়িতে। মৌপাহাড়িতে গিয়া থাকিবে তখন, সেখানকার স্কুলে মাস্টারি কবিবে। কলিকাতা হইতে বই কিনিয়া একটা ঘর সে ভর্তি করিয়া ফেলিবে। দেওয়াল দেখা যাইবে না, শুধু আলমারি। সারাদিন বইয়ের মধ্যে কাটানোউঃ! এত বেশি আনন্দ আর কীসে পাওয়া যাইতে পারে?