একদিন দেরিতে খেলে কিছু হবে না; তুমি বসতো বলে একটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল।
কী পাগল ছেলে? আরো দেরি করলে তো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে?
যাক ঠাণ্ডা হয়ে। জমিলা খালা গরম করে দেবে। আলাপটা সেরে নিই। আচ্ছা ফুফুআম্মা, তুমি কী তাসনিমের ব্যাপারে কিছু জান?
জানব না কেন? সব কিছু দেখছি, শুনছি। তোর মায়ের কাছেও সব কিছু জেনেছি।
ওকে তোমার পছন্দ হয়?
ওমা, পছন্দ হবে না কেন? ওর মতো সুন্দর মেয়ে আর কখনও দেখি নি।
ও যে আব্বুর বাল্যবন্ধু রোকন উদ্দিন সাহেবের মেয়ে, তা জান?
হ্যাঁ, তোর মা বলেছে। শোনার পর থেকে আমিও খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তোর আব্বা রাজি হলেও তাসনিমের আব্বা কিছুতেই রাজি হবেন না।
তাসনিম ওর আব্বাকে রাজি করাবে। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আল্লাহ যা করবেন তাই হবে। ও আব্বুর পরিচয় জানে না। আজ জানাব বলে আসতে বলেছি। এখনও আসছে কেন বুঝতে পারছি না। ওকে নিয়ে নাস্তা খাব বলে অপেক্ষা করছি। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ শুনে বলল, তুমি জমিলা খালাকে সবকিছু গরম করতে বল। আমি ওকে নিয়ে আসি। তারপর নিচে এসে গেট খুলে। সালাম বিনিময় করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল, কেমন আছ?
তাসনিম বলল, ভালো। তুমি?
ভালো না, মন খারাপ।
মন খারাপের আবার কী কারণ ঘটল?
এখনও ঘটে নি, একটু পরে ঘটবে। সেকথা ভেবেই মন খারাপ।
হেঁয়ালী করছ কেন? আমি তো বুঝতে পারছি না।
ততক্ষণে তারা ডাইনিংরুমে এসে গেল। আব্দুস সাত্তার বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিই এস, তারপর বুঝিয়ে বলব। একসঙ্গে খাব বলে এখনও খাই নি।
সে কী? সেকথা তো তুমি কাল বল নি।
ভেবেছিলাম, সকালে যখন আসতে বলেছি, তুমি বুঝবে। যাক গে, আমারই ভুল হয়েছে। চা বা কফি তো চলবে?
তা চলবে।
জমিলার হাতে নাস্তার ট্রেসহ রাইসা বেগমকে ঢুকতে দেখে তাসনিম সালাম বিনিময় করে বলল, ফুফুআম্মা কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি মা। তুমি ভালো আছ?
জ্বি ভালো।
তুমি এত দেরি করলে কেন? নাও নাস্তা খাও।
আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, শুধু কফি খাব।
রাইসা বেগম অবাক কণ্ঠে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই যে বললি, তাসনিম এখানে এসে নাস্তা করবে? তারপর তাসনিমকে বললেন, জান মা, সেই আটটা থেকে নাস্তা খেতে বলছি। বললেই বলে, তুমি এলে একসঙ্গে খাবে।
আব্দুস সাত্তার বলল, আমি ওকে শুধু আসতে বলেছিলাম। নাস্তা খাওয়ার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
রাইসা বেগম তাসনিমকে বললেন, তুমি দুপুরে এখানে খাবে। দরকার মনে করলে বাসায় ফোন করে দাও।
ঠিক আছে ফুফুআম্মা, তাই খাব।
নাস্তা খাওয়ার পর আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে নিয়ে বেডরুমে এসে দু’জন দু’টো সোফায় বসল।
তাসনিম বলল, উম্মে কুলসুমকে দেখছি না যে?
ওরা একটা ফ্লাটে ভাড়া নিয়ে দুদিন আগে চলে গেছে।
আজ নাস্তার টেবিলে আব্ব বললেন, তোর সেই অলরাউন্ডার ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসতে বলেছিলাম, আনলি না যে?
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, উনি আমাকে অলরাউন্ডার বললেন কেন?
যেদিন আল্লুকে তোমার কথা বলেছিলাম, সেদিন অনেকরকম গুণের কথাও বলেছিলাম। তাই বলেছেন।
কি কি গুণের কথা বলেছিলে বলতে শুনি।
তাসনিম আব্বুকে যা কিছু বলেছিল, সে সব বলে বলল, এত গুণের কথা শুনেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আজ বেরোবার আগে তোমাকে কাল নিয়ে আসব বলতে থাকবেন বলেছেন। এবার মন খারাপের ব্যাপারটা বল।
তার আগে দু’একটা প্রশ্ন করব।
বেশ তো কর।
তুমি আমাকে কতটা ভালবাস বলতে পার?
তাসনিম আহত স্বরে বলল, তা কী তুমি জান না?
জানি, তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।
ভালবাসার পরিমাণ বা পরিমাপ নেই, সেকথা তুমিও জান। তবু যখন শুনতে চাচ্ছ তখন বলব, সারা পৃথিবীর সাত সমুদ্রের জল রাশির যত পরিমাণ ও পরিমাপ তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি।
তুমি কী জান, “লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স?”
জানি।
কোনো কারণে তোমার আব্ব যদি আমাকে ঘৃণা করেন অথবা আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে না চান, তাহলে কী করবে?
জানি না, এরকম প্রশ্ন কেন করছ। তবু বলব, ঐ সাত সমুদ্রের জলরাশিতে আজীবন সঁতার কেটে তীরে উঠার চেষ্টা করব।
তাসনিমের ভালবাসার গভীরতা জেনে আনন্দে ও আতঙ্কে আব্দুস সাত্তারের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে বলল, শোন তা হলে, তোমার। আব্ব আমার আব্বুর বাল্যবন্ধু ছিলেন। তোমাদের দেশের বাড়ির পাশের গ্রামে। আমাদের বাড়ি। ক্লাস সিক্স থেকে এম.এ. পাশ করার পরও সেই বন্ধুত্ব ছিল। তারপর কিভাবে তাদের শত্রুতা হল সেসব বলে বলল, আব্ব কয়েকবার মিলমিশ করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু উনি প্রতিবারেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমি এক রাজাকারের ছেলে। রাজাকারের ছেলের সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে দেবেন কি? নিশ্চয় দেবেন না। কথা শেষ করে তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা জানার জন্য মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
তাসনিমও তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একসময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তা গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল।
আব্দুস সাত্তার বলল, জানতাম, একথা জানার পর তুমি প্রচণ্ড আঘাত পাবে এবং কাল যখন তোমার আব্ব আমার পরিচয় জানার পর তোমাকে জানিয়ে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলবেন তখন তুমি আমাকে ভুল বুঝতে। তাই এখন জানান উচিত ভেবে জানালাম। তোমাকে কয়েকদিন সময় দিলাম, চিন্তা ভাবনা করে জানাবে। আর এরপরও যদি কাল তোমাদের বাসায় নিতে চাও, তা হলে এস, যাব।