- বইয়ের নামঃ সে কোন বনের হরিণ
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. আপু তোর ফোন
সে কোন বনের হরিণ
কাসেম বিন আবুবাকার
(১) “সৎ দ্বারা অসৎ দূর কর”, এই আয়াত সম্বন্ধে (হযরত মুহাম্মদ (দঃ)) বলিয়াছেন, “ক্রোধে ধৈর্য এবং অসদ্ব্যবহারের সময় ক্ষমা কর। যখন তাহারা ইহা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাহাদিগকে রক্ষা করিবেন এবং তাহাদের শত্রুগণকে হেয় করিবেন, যেন তাহারা পরম সুহৃদ হয়।” –বর্ণনায় : হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বুখারী
(২) “হে নফস, কথা বলাটা রূপার মতো হলেও চুপ থাকাটা স্বর্ণের ন্যায়।”–হযরত আলি (রাঃ)
(৩) নীরবতা মঙ্গল না করতে পারে, কিন্তু ক্ষতি করে না।——জর্জ রিচার্ড
০১.
আপু তোর ফোন।
রূপা রাত দশটায় খেয়ে এসে পড়ছিল। ছোট বোন সায়মার কথা শুনে ঘড়ির দিকে তাকাল, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটা।
তাই দেখে সায়মা বলল, ছেলেটা রোজ রোজ তোকে ডিস্টার্ব করে, তুই কিছু বলিস নি কেন?
রূপা তার কথার জওয়াব না দিয়ে বলল, বলে দে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
সায়মা অবাককণ্ঠে বলল, আমাকে মিথ্যে বলতে বলছ? তুমিই তো বলেছ কোনো কারণেই মিথ্যে বলা হারাম।
একটা পড়া তৈরি করছিলাম, তাই বেখেয়ালে বলে ফেলেছি। তারপর ড্রইংরুমে এসে রিসিভার তুলে বিরক্তকণ্ঠে বলল, কেন প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে। ফোন করেন? কতদিন আপনাকে বলেছি, এ সময়ে পড়াশোনা করি।
অন্য সময়ে আপনাকে নিরিবিলি পাওয়া যায় না। তাই এই সময়ে করি। রূপা রাগের সঙ্গে বলল, কিন্তু এখন তো সবাই জেগে। তা ছাড়া ফোনটা তো আমার ঘরে নেই। ছোট বোন প্রতিদিন ফোন ধরে আমাকে ডেকে দেয়। আচ্ছা, কে আপনি?
আমি একজন মানুষ।
আমার তো মনে হয় অমানুষ।
তা হতে পারি। তবে অমানুষ হলেও খুব খারাপ অমানুষ নই।
আমার ধারণা, আপনি খুব খারাপ অমানুষই। নচেৎ প্রত্যেকদিন একজন ছাত্রীর পড়ার ডিস্টার্ব করতেন না।
আপনার কথা কতটা সত্য জানি না। তবে কী জানেন, আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হয়। খেয়ে এসে এই সময়ে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারি না। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর পড়ায় মন বসে। তাই একটু ডিস্টার্ব করি।
কিন্তু আপনার ফোন আসার পর আমি যে পড়ায় মন বসাতেপারি না। প্লীজ, আর কোনো দিন এ সময়ে ফোন করবেন না।
তা হলে বলুন, কখন ফোন করলে আপনার ডিস্টার্ব হবে না?
কোনো সময়েই ফোন না করলে খুশী হব।
কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা না বললে যে আমার পড়াশোনা একটুও হবে না। সারারাত একটু ঘুমও হবে না। পরীক্ষায় নির্ঘাৎ ডাব্বা মারব।
আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না। আমিও আপনাকে চিনি না, জানি না, তবু এরকম কথা বলছেন কেন?
আপনি আমাকে না চিনলেও, না জানলেও আমি আপনার সব কিছু জানি। কী জানেন বলুন তো?
আপনার ভালো নাম যাবিন তাসনিম। ডাক নাম রূপা। বাবা রোকন উদ্দিন সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী। বর্তমানে মন্ত্রী। দেশের বাড়ি নীলফামারী জেলার পলাশবাড়ি। ঢাকায় দু’টা বাড়ি, দু’টা গাড়ি। একটা আপনার বাবার। অন্যটা আপনাদের দু’বোনের। গাড়ি নিয়ে দু’বোন মাঝে মধ্যে ঝগড়া করেন। আপনি ইডেনে বাংলায় অনার্স করছেন। ছোট বোন সায়মা ঐ কলেজেই ইন্টারে পড়ছেন। আপনারা দু’বোনই সুন্দরী। তবে আপনি একটু বেশি।
সবকিছু মিলে যাচ্ছে দেখে রূপা খুব অবাক হয়ে ভাবল, ছেলেটা আমাদের সবকিছু জানে। কে হতে পারে চিন্তা করে না পেয়ে অধৈর্য গলায় বলল, হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। এবার আপনার পরিচয়টা বলুন।
বলা যাবে না।
কেন?
সময় হলে বলব।
আপনি শুধু অমানুষ নন, কাপুরুষও। এই কথা বলে রূপা রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে ফিরে এসে পড়তে বসল। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারল না। বই বন্ধ করে চিন্তা করতে লাগল, ছেলেটা কে হতে পারে? আমার পেছনেই বা লেগেছে কেন? ব্যাপারটা আব্বাকে জানালে কেমন হয়? আবার চিন্তা করল, ছেলেটার গলার আওয়াজ বেশ মিষ্টি। দেখতে কেমন কে জানে? অনেকের গলার আওয়াজ মিষ্টি হলেও দেখতে রোগা পেঁচকা, বেঁটে, চোখ ছোট ছোট, গায়ের রং মিশমিশে কালো। আবার কোনো গরিবের দেখতে শুনতে ভালো ছেলে নিজেকে বড়লোকের ছেলের পরিচয় দিয়ে ধন-সম্পত্তির লোভে বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করতে চায়। এই ছেলেটা সেরকম নয়তো? তা না হলে পরিচয় দিতে চায় না কেন? এদিকে তলে তলে আমাদের সব খবর জেনে নিয়েছে। আজ তিন মাস ধরে ছেলেটা পিছনে লেগেছে। যদি সত্যিই তার কোনো বদ মতলব থাকে, তা হলে আব্বাকে। বলে বাছাধনকে জেলের ভাত না খাইয়েছি তো আমার নাম রূপা নয়।
রূপা ও সায়মা রিডিংরুমে দুটো আলাদা টেবিলে পড়ে। দু’বোন একই বেডরুমে আলাদা খাটে ঘুমায়। সেখানেও পড়ার জন্য দু’টো চেয়ার টেবিল আছে। রাত দশটায় খাওয়ার পর দু’জনে বেডরুমে পড়ে। পড়তে পড়তে ঘুম পেলে সায়মা প্রায় প্রতিদিন চোখে মুখে পানি দিয়ে বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। তাই ড্রইংরুমে ফোন বাজলে সে-ই ধরে।
সায়মা এতক্ষণ একটা নোট করছিল। নোটটা শেষ করে রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, আপু, এই বন্ধ করে চুপচাপ কী ভাবছিস?
রূপা জানে কথা বললেই সায়মা ঐ ছেলেটাকে নিয়ে নানান কমেন্ট করবে। উপদেশ দিতেও ছাড়বে না। তাই তার কথার উত্তর না দিয়ে হাই তুলে বলল, আজ আর পড়তে ভালো লাগছে না, ঘুমাব বলে খাটে শুয়ে পড়ল।