অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ
স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…। গানটা এইমাত্র শেষ হল। টিভির অ্যানাউন্সার পরের গানটার প্রথম কলি ঘোষণা করার ভিতরেই শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, উদাস। হুড়মুড় করে ছোটবেলাটা উঠে আসছিল? নাকি তিনি নিজেই দুড়দাড় করে ছোটবেলায় ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন?
মা! চেতলার সেই বিশাল ছাদ-এর ওপর তিন কামরার ফ্ল্যাট! সারা ছাদ ভরে মা কেমন বাগান করেছিল। বাবা হাসতে হাসতে মাকে কতবার যে বলত—এত ছাদ নয়। এ আমার গিন্নির ফুলছাদ। সন্ধেবেলায় আশ্চর্য একটা সোনালি রোদ্দুর মাখা থাকত আকাশে। গুঁড়ো গুঁড়ো বাতাস। কঁক বেঁধে চড়ুইপাখি নামত মায়ের ফুলছাদে। বাবা তখনও ফেরেনি। আমরা দু’বোন চুপটি করে মায়ের গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত সবই তো মায়ের ওই গুনগুনানি শুনেশুনেই শেখা।
পুরনো ছাদ, পুরনো ফুলের গন্ধ, পুরনো সন্ধেবেলার গানের স্মৃতি এই পুড়ে যাওয়া দুপুরকে ঠেলে ঠেলে দিয়ে কেমন করে যে এগিয়ে এল শ্রাবণী জানেন না।
শ্রাবণীর চোখ বোজা। বোজা দু’চোখের ওপর গোল গোল করে কাটা শশার টুকরো। দেওয়াল ঘড়িটা একটুক্ষণ সর সর একটা শব্দ করল—ঢং। তার মানে দেওয়াল ঘড়ির—একটা। আসলে এখন একটা সাত। পুরনো এই ঘড়িটা ঠিক টাইমই দেয়। তবে সাত মিনিট পিছিয়ে থেকে।
—আমরা এমনিই ভেসে যাই…। পরের গানটা শুরু হয়েছে। এই দুপুর বেলায় এমন গান। কে শোনে? ভাবতে ভাবতেই শ্রাবণীর মনে হল, আমি তো শুনছি। আমার মতো হাজারটা লোক নিশ্চয়ই শুনছে। কিন্তু…? টিভি চালিয়ে কেউ কি শুধু শোনে? দেখতে তো হবেই। কিন্তু আমি?
শ্রাবণীর হাসি পেল। তাকে এখন আধঘণ্টা দু’চোখের ওপর গোল করে কাটা শশার টুকরো রাখতেই হবে। ‘চোখের দু’পাশের কালিমা শশার ছোঁয়ায় উধাও’—পড়েছে। সেই বিখ্যাত রূপচর্চার বইতে।
—এ বড় কষ্টের। শ্রাবণী নিজেকে বললেন।—টিভি শুনব। দেখব না? এ হয় নাকি? রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…যখন শুনছিলাম তখনও শশা দিয়ে চোখ ঢেকে ছিলাম। কিন্তু এখন? এখন তো মায়ের গুনগুন করে গাওয়া সেই গানটা হচ্ছে। আলোর মতো হাসির মতো কুসুমগন্ধ রাশির মতো শুনতে শুনতে বোজা চোখেই পুরনো দিনের ছাদ থেকে নেমে এসে জানলার পর্দা ফেলা তার এই বেডরুমে ঢুকে পড়লেন।
শ্রাবণী জেগে জেগে চোখ বুজে রয়েছেন। তাই কোনও স্বপ্ন আসছে না। বোজা চোখের ভিতর অনেক ছবি উঠে আসছিল। অসংলগ্ন। পরম্পরাবিহীন সে সব ছবি। মা। ছাদ। ঝকবাঁধা চড়ুই-এর দল। তারপরই আবার শ্রবণা। মেয়ের কথা মনে আসতেই একপেশে এক হাসি ঠোঁটের কোণায় উঠে এল। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই নিজের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিলেন। সেদিনের ন্যাপিতে জড়ানো শ্রবণা আজ আঠারো বছরের অনার্স পড়া লেডি। কি তরতর করে বছগুলো বয়ে গেল।
আজ অনেকদিন পর শ্রাবণী নিজেকে একটু ঝাড়পোেছ করার সময় পেয়েছেন। শ্রবণার মর্নিং কলেজ। দুপুরগুলো সবটাই তো মেয়ের। আয়নার সামনে একটু যে দাঁড়াবেন, তেমন সুযোগ তো নেই। আজ বলল, বন্ধুর কাছে নোটস নিতে যাচ্ছে। এই সুযোগে নিজেকে নিয়ে একটু…।
-নোটস্-এর নাম করে এই ভর দুপুরে বেরোল। সত্যিই নোটস্ তো? যা! কি সব ভাবছি। প্রেম করলে ও আমাকে ঠিকই বলবে। আজকালকার মেয়েরা অনেক ম্যাচিওরড। আমাদের মতো হাবুডুবু খাওয়া নয়।
হাবুডুবু শব্দটা কেন যে হঠাৎ উঠে এল! বোজা চোখের শ্রাবণী শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হচ্ছিলেন। সত্যিই তো তিনি হাবুডুবু খেয়েছিলেন। তাঁর সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সে। চেতলার সেই ছাদভরা বাগানওয়ালা ফ্ল্যাট। মা। বাবা। দু-বোন। আশুতোষ কলেজের মর্নিং সেকশন। সব একেবারে নিখুঁত। নিখাদ। হঠাৎ কি যে হল পুজোর শাড়ি কিনতে গেল বেহালাতে। শখের বাজারে থাকে মৌসুমী। হিস্ট্রি অনার্সের বেস্ট ছাত্রী শ্রাবণীর গলায় গলায়। ফোন করে বলল, চলে আয়। গড়িয়াহাটকেও বিট করেছে। কী কালেকশন! ভাবতে পারবি না।
শ্রাবণী শাড়ি দেখবে কি! শাড়ি দেখছে তো মা। শ্রাবণী দেখল, একদম পুঁচকে একটা ছেলে। লজ্জা লজ্জা মুখ করে ক্যাশ কাউন্টারে বসে রয়েছে। ওই নাকি মালিক। প্রেমে পড়ে গেল। হাবুডুবু খাওয়া প্রেম।
বিয়ে হয়েছিল। বাবাই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন। সব নিয়ম মেনে। তারপর কিন্তু অনেকদিন আর কোন সম্পর্ক রাখেননি। শ্রাবণী মজুমদার যে নিজেকে শ্রাবণী সাহা বানিয়ে ফেলতে পারে এটা মা বাবার স্বপ্নে ছিল না।
শ্রাবণী তখন হাবুডুবুতে ডুবে আছে। একটা কথা বিয়ের রাত থেকেই বুঝতে পেরেছিল, অনিল সাহা খুব পোষমানা বর হবে। চাইতেই সব পাওয়াগুলো কেমন হাতের মুঠোয় উঠে উঠে এল। নিজের সংসার, নিজের বর, নিজের মেয়ে। সবটাই শুধু নিজের। নিজের ইচ্ছেমতো সবাইকে শুধু তৈরি করে নেওয়া।
বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেও খুব ঘন মুহূর্তে স্বামীর দৃষ্টি দেখে শ্রাবণী মনে মনে প্রীত হত। এমন মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়েছে যেন এটা কোনও অন্য গ্রহের বিস্ময়কর এক নারী শরীর। ভালো লাগত। খুব ভালো।
–কিন্তু এখন…? শ্রাবণী নিজেকে বললেন, এখন ও যেন কেমন অন্যমনস্ক। থেকেও যেন নেই। খ্যাক করে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু…। সেই পোষমানা ভাবটা কখন যেন মিইয়ে গেছে।