ছোট মেয়ের মনের খবর জানার জন্য তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, কীরে মা, তুই চুপ করে আছিস কেন? ছেলেটার সম্পর্কে তোর মতামতটা বলতো শুনি।
আপুর উচ্ছাসের বোকামী দেখে সায়মা মনে মনে হাসছিল। বলল, হ্যাঁ আব্বু, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। আপু যা বলল, একবর্ণ মিথ্যে নয়।
কি নাম ছেলেটার?
আব্দুস সাত্তার। জান আব্ব, উনি আপুর ডাক নাম রূপা বাদ দিতে বলে তাসনিম রেখেছেন এবং বাসার সবাইকে সেকথা জানাতে বলেছেন।
তাই নাকি?
তাসনিম ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, আব্দুস সাত্তারের ব্যাপারে আব্বুর সামনে এত উচ্ছাস প্রকাশ করা বোকামী হয়েছে। তাই এবার সায়মা কিছু বলার আগে বলল, হ্যাঁ আব্বু; উনি একদিন আমার ডাক নাম রূপা শুনে আসল নাম জানতে চাইলেন। আমি বললাম, যাবিন তাসনিম। তারপর নামের ব্যাপারে আব্বুর সাত্তার যা কিছু বলেছে সব বলে বলল, খুব ধার্মিক ছেলে বলে মনে হয়, তাই না আব্বু?
তোদের কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর বললেন, ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসিস, আলাপ করব।
তাসনিম বলল, সুস্থ হওয়ার পর নিয়ে আসব।
.
আব্দুস সাত্তার একমাস ক্লিনিকে থেকে বাসায় ফিরে এলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো একমাস সময় লাগল। তাসনিম দু’একদিন পরপর তাকে ক্লিনিকে দেখতে গেলেও বাসায় সপ্তাহে একবার করে যায়। আর প্রতিদিন রাতে দীর্ঘ সময় ফোনে। আলাপ করে। উম্মে হাফসা তাকে মতামত জিজ্ঞেস করেন নি। তবে তাদের গভীর সম্পর্কের কথা বুঝতে পেরেছেন। ক্লিনিক থেকে বাসায় আসার পর একদিন ছেলেকে বললেন, উম্মে কুলসুম তোর ও তাসনিমের সম্পর্ক ও তোর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেছে। কিন্তু কাজটা কত কঠিন ভেবে দেখেছিস?
আব্দুস সাত্তার বলল, যত কঠিনই হোক, আমি আমার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হব না। তুমি মা, তোমার কাছে কিছু লুকাব না। আমি তাসনিমকে ভীষণ ভালবাসি। তাসনিমও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ওকে ছাড়া আমি যেমন বাঁচব না, আমাকে ছাড়া তাসনিমও হয়তো বাঁচবে না। অবশ্য বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। হায়াত থাকলে বাচব ঠিক; কিন্তু সে বাচার থেকে না বাচাই ভালো। ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব কিনা জানি না, তবে একথা ঠিক, অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। তা ছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বিয়ের মাধ্যমে ওর আব্বুর সঙ্গে আমার আব্বুর পূর্ব সম্পর্ক ফিরিয়ে আনবই। তুমি সবকিছু বলে আব্বুকে রাজি করাবে। আন্ধু তোমার কথা না রেখে পারবে না। আমি জানি আব্ব তোমাকে কত ভালবাসে।
এই বয়সেও সেই প্রথম জীবনের মতো স্বামী যে তাকে পাগলের মতো ভালবাসে, তা উম্মে হাফসা জানেন। তাই ছেলের মুখে সেই কথা শুনে লজ্জা পেলেও অন্তর জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মৃদু হেসে বললেন, খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস না?
বারে সেয়ানা হব না? কত বয়স হল, মা হয়ে তাতো ভালো করেই জান।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তোর আব্বর সঙ্গে তাসনিমের আব্বার আগের ও এখনকার সম্পর্কের কথা তুই কী ওকে বলেছিস?
না বলি নি। ভাবছি, কয়েকদিনের মধ্যে জানাব।
আমি না-হয় তোর আব্বকে রাজি করাব; কিন্তু তাসনিম যখন জানবে তুই রাজাকারের ছেলে তখন যদি তোকে ঘৃণা করে সরে যায় তখন কী করবি?
একথা যে ভাবিনি, তা নয়। এ ব্যাপারটা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। তিনি ভাগ্যে যা রেখেছেন, মুসলমান হিসাবে তা মেনে নিতেই হবে। তবু বান্দারা আল্লাহর কাছে মনের কামনা বাসনা জানায়। আমিও জানাচ্ছি। তুমি দোয়া করো আম্মু, আল্লাহ যেন আমার কামনা বাসনা পূরণ করেন।
উম্মে কুলসুমের মুখে তোর উদ্দেশ্যের কথা শোনার পর থেকেই প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর দোয়া করি। তারপর উম্মে কুলসুমের কাছে তাসনিমের বাবার কাছ থেকে যে বিপদ আসার কথা বলেছিলেন তা বললেন।
তুমি যে বিপদ আসার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছ, তা আমিও ভেবেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাসনিম আমার পরিচয় পাওয়ার পরেও দূরে সরে যাবে না। তারপর যখন আমার উদ্দেশ্যের কথা জানবে তখন আমাকে সাহায্য করবে। আর আমার অনুমান যদি সত্য না হয়, তা হলে ভাগ্যকে মেনে নেব। তুমি এসব নিয়ে এতটুকু দুশ্চিন্তা করো না।
.
আব্দুস সাত্তার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর আজ দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় উম্মে হাফসা ছেলেকে বললেন, তাসনিমকে সবকিছু জানাবার পর কি হয় না হয়, চিঠি দিয়ে জানাবি। কাল রাতে যে তুই বললি, বাড়ি চলে যাওয়ার কথা শুনে তাসনিম আজ আসবে। কই, এখনও তো এল না?
আব্দুস সাত্তার বলল, হয়তো কোনো কারণে লেট হচ্ছে।
এমন সময় তাসনিম পর্দা ঠেলে ঢুকে সালাম দিল।
উম্মে হাফসা সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বললেন, এসেছো না? তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নচেৎ অনেক আগেই রওয়ানা হয়ে যেতাম। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবকিছু গাড়িতে তোলা হয়েছে?
এমন সময় রাইসা বেগম এসে বললেন, কখন রওয়ানা হবে? আরো দেরি করলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে তো?
উম্মে হাফসা বললেন, এই তো এক্ষুনি রওয়ানা হব।
তাসনিম এগিয়ে এসে উম্মে হাফসাকে কদমবুসি করে রাইসা বেগমকেও করল।
দু’জনেই মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন। তারপর উম্মে হাফসা তার হাত ধরে নিচে এসে গাড়িতে উঠার সময় ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই দুরন্ত ছেলেটা কারো কথা শোনে না, তুমি একটু শাসন করে দিওতো মা। সবার অলক্ষ্যে আব্দুস সাত্তার ও তাসনিম একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
০৯. আব্দুল হামিদ ও রাইসা বেগম
আব্দুল হামিদ ও রাইসা বেগম ছাড়া তাদের আর কোনো ভাই বোন নেই। রাইসা বেগমের বিয়ে হয়েছিল একই জেলার খোকসাবাড়ীর বড় লোকের একমাত্র ছেলে আলি আশরাফের সঙ্গে। বিয়ের কয়েক বছর পর তার মা-বাবা মারা যান। আলি আশরাফ মা-বাবা মারা যাওয়ার পর জ্ঞাতী শত্রুর ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন। ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অর্ধেক সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তখন ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে আলি হোসেনকে নিয়ে থাকতেন। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবসায় উন্নতি করে রায়ের বাজারে জায়গা কিনে এই এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির কাজ শুরু করেন। টাকার প্রয়োজনে দেশের বাকি সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার পর একমাত্র সন্তান আলি হোসেন মারা যায়। ছেলের শোকে রাইসা বেগম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। পুরো পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ডাক্তারের পরামর্শ মতো আব্দুল হামিদ ও উম্মে হাফসা ছোট ছেলে আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে দেন। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স দশ বছর। বড় হয়ে তাদেরকে ছেড়ে মা-বাবার কাছে চলে না যায়, সেজন্য স্ত্রীর কথামতো আলি আশরাফ ব্যবসা ও এই বাড়ি আব্দুস সাত্তারের নামে উইল করে দেন। আলি আশরাফ ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে প্লেন এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে রাইসা বেগম ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।