হাবিব ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ উনি অবশ্য ঠিক কথাই বলেছেন। তবে অনেক বড় বড় ওলামায়ে কেরাম ও মুফতিগণ অনেক আগে থেকে এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বহু কিতাব লিখেছেন। তাদের মধ্যে বিংশ শতাব্দির মুজাহেদ হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবী (রঃ) ইসলাহুর রুসুম (কুসংস্কার সংশোধন) কিতাবে তিনি ইসলামে ঢুকে পড়া বহু কুসংস্কারের কথা উল্লেখ করে তার সংশোধনের পথও বাতলে দিয়েছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল, সে সব শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। মুসলমানদের ঈমান ও তাকওয়ার দুর্বলতার কারণে সমাজে বাস্তবায়ন হয় নি। বর্তমানে চট্টগ্রামের মেখল হামিউস সুন্নাহ মাদ্রাসার খাদেম মুফতি মুঃ ইবরাহীম খান কৃত “শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার ও কুমিল্লার মুফতি মুঃ মুহিবউদ্দিন (ফয়েজী) কৃত “শরয়ী মানদণ্ডে ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত” বই দুটির মধ্যে অকাট্য দলিলসহ এইসব কুসংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। উক্ত বই দুটির বহুল প্রচার আমি কামনা করি। এই বই দুটি আমাদের দেশের প্রত্যেক মুসলমানের পড়া একান্ত কর্তব্য। আপনি জানেন কিনা জানি না, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চট্টগ্রাম হাটহাজারীর জামিয়ে আহলিয়া মাদ্রাসা মসজিদসহ আরো কয়েকটা মসজিদে ও খুলনায় বিখ্যাত দারুল উলুম মাদ্রাসা মসজিদসহ আরো কয়েকটা মসজিদে এবং ইদানিং ঢাকায় কাঁটাবন মসজিদে ফরয নামাযের পর জামায়েতের সঙ্গে মোনাজাত করা হয় না।
এমন সময় চেয়ারম্যানের ছেলে হামিদুর রহমান এসে বলল, ঘাম দিয়ে হাবিবুর রহমানের জ্বর কমতে শুরু করেছে।
হাবিব ডাক্তার আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আর কোনো চিন্তা নেই। ওকে বাতাসই লেগেছিল। শুনলে অবাক হবেন, আমার বড় ভাইয়ের তিন ছেলে। ছোট ছেলে সেদিন দুপুরে বা সন্ধ্যেয় একা একা বাসার পিছনের গলিতে বা ছাদে কোনো কারণে যায়, যেদিনই তাকে বাতাস লেগে জ্বর হয়। আবার দুষ্টুমি করলে কেউ যদি বকাবকি করে বা দু’একটা চড়-চাপড় মারে, তা হলেও তার জ্বর হবে। আব্বা আল্লাহর কালাম পড়ে ফুক দিলে ভালো হয়ে যায়। এজন্য তাকে কেউ বকাবকি বা মারধর করে না। আপনার এই পোতাকেও দেখছি তার মতো। এবার তা হলে আসি?
চেয়ারম্যান বললেন, আরো কিছুক্ষণ বসুন। দু’একটা কথা আলাপ করব। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
হাবিব ডাক্তার বলল, আপত্তির কি আছে? কি আলাপ করতে চান বলুন।
আপনার সম্পর্কে ভালো মন্দ কথা অনেক কানে পড়ে। তাই খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, আপনি ঢাকার খুব ধনী ও মানিগুণী লোকের ছেলে। ডাক্তারি পাশ করে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন। তবু এই পাড়াগাঁয়ে এসেছেন কেন?
হাবিব ডাক্তার চিন্তা করল, আজরাফ স্যার ইনাকে কিছু বলেন নি তো? ওঁর মতো লোকও নিষেধ করা সত্ত্বেও কথাটা গোপন রাখতে পারলেন না?
তাকে চিন্তা করতে দেখে চেয়ারম্যান আবার বললেন, আপনার মৌনতাই কিন্তু বলে দিচ্ছে, এখানে আসার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে?
আপনাকে কেউ কি আমার সম্পর্কে কিছু বলেছেন?
না, আমি নিজে খোঁজ-খবর নিয়েছি।
এখানে আসার উদ্দেশ্যের কথা যে বললেন, তার খোঁজ নেন নি?
চেয়ারম্যান বুঝতে পারলেন, হাবিব ডাক্তার খুব বুদ্ধিমান। বললেন, খোঁজ যে নিই নি তা নয়, তবে সফল হতে পারি নি। তাই তো জিজ্ঞেস করলাম।
আজরাফ স্যারকে যা কিছু বলেছিল, হাবিব ডাক্তার সে সব বলে বলল। একটা অনুরোধ করছি, উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত এসব কথা গোপন রাখবেন।
চেয়ারম্যান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, এতদিনে সফলতার পথে অগ্রসর হতে পেরেছেন?
জি, চার ভাগের তিন ভাগ পথ অতিক্রম করেছি, তারপর নাদের আলি ও আতিকার বিয়ের সম্বন্ধে মুশতাক বিশ্বাসের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে বলল।
আপনি কী মনে করেন, পূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারবেন?
আল্লাহ ভরসা। তিনি বান্দাদের মনের নেক মাকসুদ পূরণ করে থাকেন।
তা আমিও জানি। কিন্তু আপনি তো প্রতিশোধ নিতে ও দাদার সম্পত্তি উদ্ধার করতে এসেছেন? এটাকে নেক মাকসুদ বলছেন কেন?
দু’টোই শরীয়ত সম্মত। তা ছাড়া দাদাজীর কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিই, বিবাদমান দু’দল মুসলমানদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করব। আপনিই বলুন না, এসব করা কি ন্যায় না অন্যায়?
আপনার উদ্দেশ্য শুধু ন্যায়ই নই মহৎও। প্রয়োজনে আমি আপনাকে সাহায্য করব।
হাবিব ডাক্তার মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, শুনে খুশি হলাম। সাহায্যের প্রয়োজন হলে জানাব। এখন শুধু দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে সফলতা দান করেন। এবার আমি একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
বেশ তো বলুন।
আমি বইরাপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার পাশে এমন একটা মাদ্রাসা করতে চাই, যেখানে হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা হাফেজ হওয়ার পর হাদিস কিতাব পড়ে পাক্কা ঈমানওয়ালা বড় বড় আলেম ও মুফতি হয়ে ইসলামে যে সমস্ত বেদায়াত (কুসংস্কার) প্রবেশ করেছে, সেসব দূর করতে পারেন। তাদের অনেকে এখানকার লেখাপড়া শেষ করে বিভিন্ন বিষয়ের উপর উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর বিধান মতো দেশ শাসন করতে পারেন। যারা বর্তমানে দেশের প্রশাসন বিভাগে আছেন, তারা আল্লাহর ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর বিধান সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ এবং তারা এইসব বিধান মেনে চলে মানুষও হন নি। তাই তারা মানুষের তৈরি বিধানমতো দেশ শাসন করছেন। ধর্মে বিশ্বাস রেখে ও ধর্মের বিধানমতো যারা নিজেদেরকে পরিচালিত করেন এবং অন্যদেরকেও ধর্মের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করেন, তারাই মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর ধর্মকে পরিত্যাগ করে কোনো মানুষই চরিত্রবান হতে পারে না। শুধু কিছু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়। ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ যা কিছু করবে আল্লাহ তার বিধান দিয়ে দিয়েছেন। সেই বিধানমতো করলে করণীয় সবকিছুই ইবাদত বলে গণ্য হবে। তাই যারা বলে ধর্মে রাজনীতি নেই, তারা ইসলাম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। সারা বিশ্বের মানুষের জানা উচিত কোনো আইন প্রয়োগ করে বিশ্ব থেকে অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ বন্ধ সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত, তা হলে উন্নতশীল দেশগুলোতে সবকিছু নির্মূল হয়ে যেত। কিন্তু হয়েছে কি? হয় নি। এসব নির্মূল করার একমাত্র হাতিয়ার ধর্ম। মানুষের যদি ধর্মের প্রতি বিশ্বাস থাকে, তবে মৃত্যু, কবর, হাশর ও জাহান্নাম ও বেহেস্ত সম্পর্কে জ্ঞান পাওয়ার পর কেউ-ই অন্যায়ের পথে পা বাড়াতে সাহস করত না। তবে শয়তানের অনুসারীরা কিছু থাকবেই। তারা আদিমকালেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বর্তমানের মতো মহামারি আকারে অন্যায়, অত্যাচার, খুন, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, ধর্ষণ দেখা দিত না। শুধু ধর্মের জ্ঞান থাকলে হবে না। জ্ঞানের অনুশীলন ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে, সমাজে, দেশে তথা সারা পৃথিবীতে থাকতে হবে। তা হলে দেশের তথা সারা পৃথিবীর মানুষ ইহকালে যেমন সুখ শান্তিতে বসবাস করতে পারত, তেমনি পরকালের অনন্তকাল জীবনেও বেহেস্তে সুখ-শান্তিতে থাকতে পারবে। আর একটা জিনিস, শিক্ষাঙ্গনই হচ্ছে ধার্মিক ও চরিত্রবান গড়ার কারখানা। তাই শিক্ষকদের ধার্মিক ও চরিত্রবান হওয়া অপরিহার্য। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে, দুঃখে চোখে পানি আসে। তাই আমি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে চাই, তার শিক্ষকমণ্ডলীকে হতে হবে সৎ ধার্মিক ও চরিত্রবান। এটা প্রতিষ্ঠিত করতে যত টাকার প্রয়োজন হবে, ইনশাআল্লাহ আমি দেব। আর আল্লাহ যদি দাদাজীর ওয়ারিশ সম্পত্তি পাইয়ে দেন, তা হলে সবটাই ঐ মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য ওয়াকফ করে দেব।