যুবাইদা খানম রাগের সঙ্গে বললেন, আমি বসতে আসিনি, একটা কথা বলতে এলাম। শুনুন আতাহারকে সাবধান করে দেবেন, সে যেন শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে। আমার মেয়ের দুর্নাম রটলে কি হবে ভেবে দেখেছেন? আপনি জানেন কি না। জানি না, সে শবনমকে বিয়ে করতে চায়। আপনিই বলুন, এটা কি সম্ভব?
রফিকা বেগম ছোটবেলায় তাদের দুজনের মিল দেখে ভাবতেন, আল্লাহ যদি রাজি থাকে, তা হলে শবনমকে বৌ করবেন। স্বামী মারা যাবার পর সে কথা ভুলে গেছেন। তারপর আতাহার যে এখনো তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে, তা জানতেন না। বললেন, আপা আপনি আমার উপর রাগ করবেন না। আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঠিক আছে আতাহারকে আমি শাসন করে শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে দেব। আপনি বসুন আপা, একটু কিছু মুখে দিয়ে যান।
যুবাইদা খানম বললেন, বসতে পারব না। হাতের কাজ ফেলে এসেছি। আর একটা কথা বলে যাই, ঘরে সেয়ানা মেয়েকে সেয়ানা ছেলের কাছে পড়াতে নেই। আশা করি আমার কথাগুলো মনে রাখবেন, নচেৎ এর পরিণাম ভালো হবে না। তারপর কলিম উদ্দিনকে নিয়ে ফিরে এলেন।
রফিকা বেগম ছেলের উপর রেগে রইলেন। একটু পরে আতাহর ঘরে এলে রাগের সঙ্গে বললেন, কিছুক্ষণ আগে শবনমের মা এসে বলে গেলেন, তুই নাকি শবনমের সঙ্গে এখনো মেলামেশা করিস? তাকে বিয়েও করতে চাস?
আতাহার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, উনি সত্যি কথাই বলেছেন।
রফিকা বেগম রাগতে গিয়েও পারলেন না। চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, না বাবা না, এটা কখনো সম্ভব নয়। শবনমের বাবার অবস্থা ভালো। তা ছাড়া সে তোর চেয়ে বেশি শিক্ষিত। শবনম চাইলেও তার মা-বাবা কিছুতেই তোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। তুই গরিবের ছেলে। এই অভাবের সংসারে এসে সে খুব অশান্তি ভোগ করবে। তোর এখন বিয়ের বয়সও হয়নি। আমাকে যদি আম্মা বলে ডেকে থাকিস, তা হলে শবনমের কথা ভুলে যা। তার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবি না। আর শবনমের ভাই নাসির উদ্দিনকে কুলসুমদের পড়াতে আসতে নিষেধ করে দিস।
আতাহার কোনোদিন মায়ের কোনো কথার প্রতিবাদ করেনি। আজও করল না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
রফিকা বেগমও জানেন, আতাহার কখনো তার কথার অবাধ্য হয়নি। তাই আর কিছু না বলে বললেন, আয় নাস্তা খাবি আয়।
পরের দিন মসজিদে মাগরিবের নামায পড়তে গিয়ে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আতাহারের দেখা হতে চিন্তা করল, ব্যাপারটা কতটা গড়িয়েছে জানা দরকার। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, আজ পড়াতে এলি না যে?
নাসির উদ্দিন বলল, আমি যে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে যাই তা আম্মা জানত না। পরশুদিন রাতে তুই আর শবনম যখন গুপ্তগঞ্জ বাজারের কাছে কথা বলছিলি, তখন মুনসুর দেখেছিল। কাল আমাদের বাড়িতে এসে সে কথা ও পড়াবার কথা আম্মাকে বলে গেছে। আর তোর সম্বন্ধে অনেক বদনামও করেছে। তারপর তার আম্মার বকাবকির কথা বলে বলল, আমি আর পড়াতে যাব না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। যত গণ্ডগোলের মূলে ঐ মুনসুর।
আতাহার বলল, খুন করতে যদি আল্লাহ নিষেধ না করতেন, তাহলে কবেই ওকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। আত্মীয় হয়ে যে আত্মীয়ের এত বড় দুশমন হয়, তা এই নরপিশাচকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
.
আজ পনের দিন হয়ে গেল আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে। কাল চলে যাবে। যাওয়ার আগে শবনমের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মন খুব ছটফট করছে; কিন্তু মায়ের নিষেধের কথা মনে করে তা পারছে না। মসজিদে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু তাকেও কিছু বলতে পারছে না। আজ আসরের নামায পড়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চৌধুরীদের বাগানে গেল। আলমাসকে কাজ করতে দেখে সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন আসনি কেন?
আতাহার বলল, ঢাকায় ছিলাম। সেখানে অসুখ করেছিল। কয়েকদিন হল এসেছি।
আলমাস বলল, চৌধুরী হুজুর এসেছেন, তিনি তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
আতাহার বলল, তাই নাকি? চলুন তা হলে ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
আলমাস বলল, আমি এখন কাজ করছি যেতে পারব না। তুমি যাও। আমাদের ঘরের পিছনের ঘরটায় চৌধুরী হুজুর থাকেন। উনি বারান্দায় বসে কেতাব পড়ছেন।
আতাহার সেখানে গিয়ে সালাম দিল।
চৌধুরী হুজুর কেতাব বন্ধ করে সালামের উত্তর দিয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি আতাহার না?
আতাহার বলল, জ্বি।
চৌধুরী হুজুর পাটির উপরে বসে ছিলেন। বললেন, আমার কাছে এসে বস।
আতাহার বসে বলল, কেমন আছেন হুজুর?
আল্লাহপাক ভালই রেখেছেন। তা তোমার মন খারাপ কেন? শরীরও খুব ভেঙ্গে গেছে দেখছি।
জ্বি, অনেক দিন অসুখে ভুগেছি।
অসুখ বিসুখ সবারই হয়, তাতে মন খারাপ করার কি আছে?
আতাহার চিন্তা করতে লাগল, হুজুরকে শবনমের ব্যাপারটা বলবে কিনা?
চৌধুরী হুজুর তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছ। লজ্জায় বলতে পারছ না? লজ্জার কি আছে? কোনো বিপদে পড়লে বল, ইনশাআল্লাহ। তা দূর করার চেষ্টা করব।
আতাহার ওঁর দুপা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চৌধুরী হুজুর পা থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, আহা কি হয়েছে বলবে তো।
আতাহার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার আব্বা মারা গেছেন, আপনি জানেন?