রোকেয়া বলল, দোয়া কর আম্মা, আমি যেন তোমাদের উপদেশ মেনে চলতে পারি। তোমরা আমার শাশুড়ীর কথা যাই শুনে থাক না কেন, তবু আল্লাহ আমাকে অনেক সুখে রেখেছেন। আমার শ্বশুর বাড়ির সব আত্মীয়-স্বজন আমাকে ভালবাসে। শুধু আমার শাশুড়ী আমাকে দেখতে পারে না। সবাইয়ের থেকে আমার নানা শ্বশুর আমাকে বেশি ভালবাসেন। মাঝে মাঝে উনি আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে যান।
মেহেরুন্নেসা বললেন, দোয়া করি মা, আল্লাহ তোকে সুখী করুক।
রোকেয়ার বান্ধবী লাকি রোকেয়া এসেছে শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। রোকেয়াকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর সাথে অনেক দিন পর দেখা হল। সত্যি তোর জন্য এতদিন আমার মন জ্বলছিল।
রোকেয়া বলল, লাকি, তুই আমাকে দেখে অভিনয় করছিস। যদি প্রাণ জ্বলত, তাহলে নিশ্চয় আমাকে দেখতে যেতিস। স্কুলে যাস, অথচ আমাদের বাড়িতে যাস না। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি মাত্র পনের বিশ মিনিটের রাস্তা।
লাকি বলল, সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর, যেতে খুব মন চায়। শুধু তোর বরের কথা চিন্তা করে যাইনি। তাছাড়া পরীক্ষার পর স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
স্কুলে যাওয়া না হয় শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার বরের কথা বললি কেন? সে কি তোকে খেয়ে ফেলত?
আহা তা কেন, ঐ যে বিয়ের আগে তোর সঙ্গে যে সব কথা বলেছিলাম, সে সব তুই যদি তোর বরকে বলে থাকিস? তাই লজ্জায় যেতে পারি নি।
রোকেয়া হেসে উঠে বলল, সেসব কথা বুঝি বরকে বলা যায়? ঐ যে লোকে বলে, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দেখছি তোর মনও তাই।
লাকিও হাসতে হাসতে বলল, তোর বরটা কেমন বলবি?
আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় মনের মত পেয়েছি। তবু খুব ভয় ভয় করে। কি করে ঐ বাড়িতে আজীবন কাটাব।
ভয় করবে কেন? মনের মত যখন স্বামী পেয়েছিস তখন আর চিন্তা কিসের?
তোর কথা ঠিক; কিন্তু আমার শাশুড়ী বড় কঠিন মেয়ে। তার মনে এতটুকু দয়া মায়া নেই। আর বিবেক বিবেচনা বলতেও এতটুকু নেই। দোয়া করিস, আল্লাহ যেন শাশুড়ীর বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করেন।
তাতো করবই। আচ্ছা রুকু, তোর দেবররা কেমন? তারা তোকে ভালবাসে?
রোকেয়া কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, হ্যাঁ তারা আমাকে খুব ভালবাসে। আমার মেজ দেবর বিদেশে থাকে। আমাকে চিঠি দেয়। টাকাও পাঠায়। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে বল, তার সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করি। আমরা দুজনে অনেক আগে সেই রকম তো ওয়াদা করেছিলাম।
লাকি বলল, তা করেছিলাম। কিন্তু তোর মেজ দেবর ভালো হলে কি হবে, তোর শাশুড়ীর কথা আমরা যা শুনেছি এবং তুইও যা বললি, তাতে করে সেই ওয়াদা রক্ষা করতে পারব না। জেনেশুনে কেউ আগুনে হাত দেয়? আচ্ছা, তোর শাশুড়ী যে তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, হারুন ভাই জানে না?
রোকেয়া বলল, জানবে না কেন? সে কি তার মাকে চিনে না? তবে শাশুড়ীর দুর্ব্যবহারের সব কথা আমি তাকে জানাই না। আমাকে কাঁদতে দেখলে অথবা আমার মন খারাপ দেখলে যখন জিজ্ঞেস করে তখন অল্পকিছু হলেও বলতে হয়। কারণ সে ঘরে এলেই তার মা তাকে আমার নামে মিথ্যে করে নানান কথা বলে। সেই সময়। জিজ্ঞেস করলে আমি সত্য ঘটনা বলি। তখন সে আমাকে বুঝিয়ে বলে, কি করব বল, হাজার হোক মা তো? তোমার হয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করলে লোকে ছিঃ ছিঃ করবে। সবকিছু সহ্য করে যাও। আল্লাহ একদিন না একদিন তার ফল দেবেন। তিনি কোরানপাকে বাবা মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।
লাকি বলল, হারুন ভাই অবশ্য ঠিক কথা বলেছে। দোয়া করি, আল্লাহ তোকে শাশুড়ীর অত্যাচার তেকে রেহাই দিক, সবকিছু সবর করার ক্ষমতা দিক। তারপর বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, পরে আবার আসব। তুইও যাস।
দিন পনের পর রোকেয়ার সেজ দেবর হোসেন এসে রোকেয়াকে নিয়ে গেল। কয়েকদিন পরে আনসার উদ্দিন মেয়ের বাড়ি এলেন।
রোকেয়া কদমবুসি করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল।
আনসার উদ্দিন দোয়া করে এবং ভালো-মন্দ খবরা-খবর বলে বললেন, আমার মন বলছে, তোমার মেয়ে হবে। আল্লাহ যদি মেয়ে দেন, তাহলে তার নাম রাখবে আশা।
তার কথা শুনে রোকেয়া ও সেখানে যারা ছিল, সবাই হাসতে লাগল। হোসেন বলল, নানা, এত নাম থাকতে এই নাম রাখতে বলছেন কেন?
আনসার উদ্দিন বললেন, কেন রাখতে বললাম শোন, আশা যখন বিয়ের লায়েক হবে তখন সব ছেলেরা আশা করবে আশাকে বিয়ে করব, বুঝেছ?
হোসেন হাসতে হাসতে বলল, নানা ভাইয়ের যেমন কথা; আশা নাম রাখলেই শুধু আশা করবে, আর অন্য নাম রাখলে করবে না বুঝি?
আনসার উদ্দিন বললেন, তুমি এখন ছোট। তাই আমার কথার মানে বুঝতে পারছ না। বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন শুধু এটুকু বলছি, ঐ নাম রাখলে বেশি আগ্রহী হবে।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত নানার সঙ্গে গল্প গুজব করে সবাই ঘুমাল। পরের দিন ফজরের সময় সবাই উঠে নামায পড়ল। হোসেন নানাকে নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে জাগাবার জন্য গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারল, শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা, আর হাত পা শিক হয়ে রয়েছে। ভয় পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে সে কথা জানাল।
হানুফা বিবি শুনে তাড়াতাড়ি করে এসে আব্বা আব্বা বলে কয়েকবার ডেকে গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন, মারা গেছেন। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে লাগলেন। ঐ অলক্ষণে বৌয়ের জন্য এরকম হল। নচেৎ বাবা আমার কাল একদম ভালো ছিল। অনেক দিন কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না। হঠাৎ কি করতে কি হয়ে গেল গো আল্লাহ।