হানুফা বিবি বললেন, বৌয়ের অসুখ যাবে কি করে? বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে অসুখ ভালো হয়ে গেছে বুঝি?
হারুন মায়ের স্বভাব জানে, কিছু বরতে গেলেই তাকেও যাতা করে বলতে শুরু করবে। তাই মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে রোকেয়াকে নিয়ে একটা স্কুটারে করে রওয়ানা দিল।
শ্বশুর বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর হারুন রোকেয়াকে বলল, চল চাঁদপুর টাউন থেকে বেড়িয়ে আসি।
রোকেয়ার ছোট বোন জুলেখা সেখানে ছিল। বলল, দুলাভাই শুধু মেজ আপাকে নিয়ে যাবেন, আমাকে সাথে নেবেন না?
হারুন বলল, কেন নেব না। যাও তোমরা তৈরী হয়ে এস।
বদরপুর থেকে তারা রিক্সায় করে বাকিলাহ বাজার বাসস্ট্যাণ্ডে এল। তারপর প্রায় পনের মাইল বাসে করে এসে চাঁদপুর নামল। হারুন তাদেরকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কিছু মার্কেটিং করল। তারপর তিনজনে একটা হোটেলে ঢুকে হারুন জুলেখাকে বলল, কি। খাবে বল।
জুলেখা বলল, আপাকে জিজ্ঞেস করুন।
রোকেয়া বলল, পরোটা ও কাবাবের অর্ডার দাও। পরে কোকাকোলা।
হারুন বলল, দুপুর তো হয়েই গেছে, ভাত খেলে হত না? ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।
রোকেয়া বলল, তাহলে তাই অর্ডার দাও।
হারুন তিন প্লেট বিরানীর অর্ডার দিল। সেই সঙ্গে কাবাবও দিতে বলল। খাওয়ার পর তিনজনে তিনটে কো-কো খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসে উঠল।
তারা যখন বদরপুর ফিরে এল তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। হারুন রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে তার শাশুড়ী বাধা দিয়ে বললেন, আজ আর তোমাদের যেয়ে কাজ নেই; কাল সকালে যেও।
হারুন তার মাকে জানে। আজ না গেলে রোকেয়াকে যা তা করে বলবে। সেই কথা ভেবে বলল, আম্মাকে বলে এসেছি আজ ফিরে যাব। না গেলে খুব চিন্তা করবে।
মেহেরুন্নেসা বললেন,তা হলে খাওয়া দাওয়া করে যাও।
সেদিন খাওয়া দাওয়া করে রাত এগারটায় হারুন রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
হানুফা বিবি তখন দুতিনজন জায়ের সাথে গল্প করছিলেন। ছেলে বৌকে ফিরতে দেখে তাদেরকে বললেন, হারুন এই বৌকে নিয়ে ঘর করলে ওর সর্বনাশ হয়ে যাবে। অলক্ষুণে মেয়ে হারুনের শরীরটা নষ্ট করে দিয়েছে। কি সুন্দর শরীর ছিল আমার হারুনের। তারপর হারুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে আমি বারবার বলছি, এই বৌকে ছেড়ে দে। এই বৌয়ের দ্বারা তোর কোনোদিন সুখ শান্তি হবে না। পেত্নীকে নিয়ে তুই পাগল হলি কেন? যা বলছি তা করছিস না কেন? তুই একে ছেড়ে দিয়ে দেখ, আমি তোর জন্য কত সুন্দর বৌ এনে দিতে পারি কিনা।
হারুন ও রোকেয়া তখন নিজেদের রুমে। রোকেয়া যাতে মায়ের কথা শুনতে না পায়, সে জন্যে তার দুকানে হারুন নিজের আঙ্গুল দিয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও রোকেয়া শাশুড়ীর সব কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বলল, ওগো প্রিয়তম, যাতে তোমার সুখ শান্তি হয় তাই কর। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
হারুন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, তুমিও এই কথা বলে আমার মনে ব্যথা দেবে? জেনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন ব্যর্থ। তুমি আমার দিকে চেয়ে অন্তত সহ্য কর। আল্লাহপাক একদিন না একদিন তার প্রতিফল দেবেন। রোকা তুমি কেঁদ না। তোমার চোখের পানি আমাকে ব্যথা দেয়। যে কটাদিন আছি তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই। এবার একটু হাস দেখি।
রোকেয়া চোখ মুছে মুছে মৃদু হেসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি তো চলে যাবে, আর আমি এখানে কিভাবে থাকব বলে দাও প্রিয়তম। এই কথা বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
হারুন তাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি তোমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি দেব। তুমিও তার উত্তর দিবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিক মত পড়বে। প্রতিদন ভোরে উঠে কুরআন তেলাওয়াৎ করবে।সময় করে তাজকেরাতুল আম্বিয়া ও তাজকেরাতুল আউলিয়া এবং কোরানের তফসির পড়বে। মা ফাতেমা, বিবি রহিমা ও উম্মেহাতুল মোমেনাদের জীবনী পড়বে। ঐ যে দেখছ আলমারী ওতে সব বই আছে। বেহেস্তী জেওর তুমি তো বিয়ের আগে পড়েছ। এখন আবার পড়ো। এই সমস্ত বই যদি পড়, তাহলে সংসারের দুঃখ কষ্ট অনুভব করতে পারবে না। মনে অনেক শান্তি পাবে। আর খুব সাবধানে চলাফেরা করবে। রাতে একা বাইরে যাবে না। শরীর খারাপ লাগলে ডাক্তারের কাছে যাবে। আব্বার সেবা যত্ন করো। আম্মা তোমার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, যা কিছু বলুক না কেন, সেসব মনে রাখবে না। তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করবে।
সে রাতে তারা ঘুমাল না। সারারাত আনন্দফুর্তি করে কাটাল। এর একদিন পর হারুন ঢাকায় এসে একদিন হোটেলে রইল। তারপরের দিনের ফ্লাইটে দুবাই চলে গেল।
৫-৬. একটা চিঠি
০৫.
হারুন বিদেশ চলে যাওয়ার দশ বার দিন পর একদিন রোকেয়ার সেজ দেবর হোসেন কয়েকখানা চিঠি নিয়ে এসে বলল, বড় ভাইয়া দিয়েছে। তারপর একটা চিঠি রোকেয়ার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার।
রোকেয়া তখন সংসারের কাজ করছিল। চিঠিটা বুকের কাছে ব্লাউজের ভিতর রেখে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ শেষ করল। তারপর নিজের রুমে এসে পড়তে শুরু করল।
ওগো আমার হৃদয়ের রানী,
পত্রের প্রারম্ভে তোমাকে জানাই আমার অন্তরের প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা। তারপর তোমার রঙ্গিন গোলাপি ঠোঁটে আমার চুমো দিলাম। এখন রাত একটা। বাইরে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ইচ্ছা করছে সেই বাতাসে ভর করে তোমার কাছে চলে যাই। কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে তোমাকে পাওয়ার জন্য মনের মধ্যে তুফান বইছে। প্রাণপ্রিয়া রোকা, এই সুদূর বিদেশে আমি নিঃসঙ্গ। তোমার স্মৃতি ও ভালবাসা আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে। প্রতি রাতে ঘুমোবার সময় তোমার মিষ্টি মধুর মুখের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর বুকের উপর চেপে ধরে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। আমার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে তোমার ভালবাসার গন্ধ পাই। তুমি আমার শরীরের রম্ভে রম্ভে মিশে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলে থাকতে পারি না। তোমার স্মৃতি আমাকে যেন অতল সাগরে ডুবিয়ে নিয়ে যায়। আবার তোমার ভালবাসা আমাকে সেখান থেকে তুলে এনে সবর করার সবক দেয়। তখন আমার মন শান্তিতে ভরে যায়। তোমাকে ছেড়ে এসে আমার দিন কাটতে চায় না। মনে হয় এক একটা দিন যেন এক একটা মাস। আমি যেমন তোমাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালবাসি, তুমিও তেমনি আমাকে ভালবাস। তাই এত বিরহ ব্যথার মধ্যেও বিশ্বজগৎ আমার কাছে পরম রমণীয় ও লোভনীয় বলে মনে হয়। তুমি আমার সার্থক সহধর্মিনী। প্রিয়তমা রোকা, কেমন আছ জানাবে। তুমি যে আমার জীবন মরণের সাথি। দোওয়া করি আল্লাহপাকের দরবারে, তিনি যেন তোমাকে সব কিছু সহ্য করার শক্তি দেন। সুখে থাক, ভাল থাক, সুস্থ থাক ও আনন্দে থাক, আল্লাহ পাকের কাছে এই কামনা করে শেষ করছি। তার আগে আর একবার তোমার রঙ্গিন ঠোঁটে চুমো দিলাম। পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় দিন গুনব।