দশটা বেজে গেছে। ছেলেরা বই হাতে ক’রে রাস্তায় হো হো কত্তে কত্তে স্কুলে চলেছে। মৌভাতি বুড়োরা তেল মেখে গাছ কাঁধে করে অফিমের দোকান ও গুলীর আড্ডায় জলে। হেটো ব্যাপারীরা বাজারে বেচা-কেনা শেষ করে খালি বাজরা নিয়ে ফিরে যাচ্চে। কলকেতা সহর বড়ই গুলজার—গাড়ীর হরুবা, সহিসের পয়িস পরিস শব্দ, কেঁদো কেঁদো ওয়েলার ও নরম্যাণ্ডির টাপেতে রাস্তা কেঁপে উঠচে—বিনা বাঘাতে রাস্তায় চলা বড় সোজা কৰ্ম্ম নয়।
বীরকৃষ্ণ দার ম্যানেজার কানাইধর দত্ত এক নিমখাসা রকমের ছক্কর ভাড়া করে বারোইয়ারি পূজার বার্ষিক সাধতে বেরিয়েছেন।
বীরকৃষ্ণ দাঁ কেবলচাদ দার পুষ্যিপুত্তর, হাটখোলায় গদী, দশ-বাবোটা খন্দ মালের আড়ত, বেলেঘাটায় কাঠের ও চুণের পাঁচখানা গোলা, নগদ দশ বারো লাখ টাকা দাদন ও চোটায় খাটে। কোম্পানীর কাগজের মধ্যে মধ্যে লেন-দেন হয়ে থাকে; বারো মাস প্রায় সহরেই বাস, কেবল পুজোর সময় দশ-বারো দিনের জন্য বাড়ী যেতে হয়। একখানি বগী, একটি লাল ওয়েলার, একটি রাঁড়, দুটি তেলী মোসাহেব, গড়পারে বাগান ও ছ-ডেড়ে একু ভাউলে ব্যাভার, আয়েস ও উপাসনার জন্যে নিয়ত হাজির।
বীরকৃষ্ণ দাঁ শ্যামবর্ণ, বেটেখেঁটে রকমের মানুষ, নেয়াপাতি রকমের ভুঁড়ি, হাতে সোনার তাগা, কোমরে মোটা সোনার গোট, গলায় একছড়া সোনার দু-নরী হার, আহ্নিকের সময়, খেলবার তাসের মত চ্যাটালো সোনার ইষ্টিকবচ পরে থাকেন, গঙ্গাস্নানটি প্রত্যহ হয়ে থাকে, কপালে কণ্ঠায় ও কানে ফোঁটাও ফাঁক যায় না। দাঁ মহাশয় বাঙ্গালা ও ইংরাজী নামসই কত্তে পারেন ও ইংরেজ খদ্দের আসা যাওয়ায় দু-চারটে ইংরাজী কোম্পানীর কনট্যাক্টে ‘কম’ আইস, ‘গো’ যাও প্রভূতি দুই-একটা ইংরজী কথাও আসে; কিন্তু দাঁ মহাশয়কে বড় কাজকর্ম্ম দেখতে হয় না, কানাইধন দত্তই তার সব কাজকর্ম্ম দেখেন, দাঁ মশায় টানা-পাখায় বাতাস খেয়ে, বগী চড়ে, আর এসরাজ বাজিয়েই কাল কাটান।
বারো জনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মড়ক হতেই সৃষ্টি হয়—ক্রমে সেই অবধি “মা” ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন। মহাজন, গোলদার, দোকানদার ও হেটোরাই বারোইয়ারি-পূজোর প্রধান উদযোগী। সংবৎসর যার যত মাল বিক্রী ও চালান হয়, মণ পিছু এক কড়া দু কড়া বা পাঁচ কড়ার হিসাবে বারোইয়ারি খাতে জমা হয়ে থাকে, ক্রমে দু-এক বৎসরের দস্তুরি বারোইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ারগোচের সৌখীন লোকের কাছেই ঐ টাকা জমা হয়। তিনি বারোইয়ারি-পূজের অধ্যক্ষ হন—অন্য চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং-তামাসার বন্দোবস্ত করা তাঁরই ভার হয়।
এবার ঢাকার বীরকৃষ্ণ দাঁ-ই বারোইয়ারির অধ্যক্ষ হয়েছিলেন, সুতরাং দাঁ মহাশয়ের আমমোক্তার কানাইবন দত্তই বারোইয়ারির বার্ষিক সাবা ও আর আর কাজের ভার পেয়েছিলেন।
দত্তবাবুর গাড়ী রুনু রুনু রুনু ছুনু ছুনু করে নুড়িঘাটা লেনের এক কায়স্থ বড়মানুষের বাড়ীর দরজায় লাগলো। দত্তবাবু তড়াক ক’রে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে দারোয়ানদের কাছে উপস্থিত হলেন। সহরের বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের খোদ হুজুর ভিন্ন নদের রাজা এলেও খবর নদারক! “হোরির বক্সিস”, “দুর্গোৎসবের পার্ব্বণী”, “রাখী পূর্ণিমার প্রণামী” দিয়েও মন পাওয়া ভার। দত্তবাবু অনেক ক্লেশের পর চার অন কবলে একজন দারোয়ানকে বাবুকে এংলা দিতে সম্মত কললেন। সহরের অনেক বড়মানুষের কাছে “কর্জ্জ দেওয়া টাকার সুদ” বা তাঁর “পৈতৃক জমিদারী” কিনতে গেলেও বাবুর কাছে এংলা হ’লে হজুরের হুকুম হ’লে, লোক যেতে পায়; কেবল দুই-এক জায়গায় অবারিতদ্বার! এতে বড়মানুষদেরো বড় দোষ নাই, ‘ব্রাহ্মণপণ্ডিত’, উমেদার’, ‘কন্যাদায়’, ‘আইবুড়ো’ ও ‘বিদেশী ব্রাহ্মণ’ ভিক্ষুকদের জ্বালায় সহরে বড়মানুষদের স্থির হওয়া ভার। এদের মধ্যে কে মৌতাতের টানাটানির জ্বালায় বিব্রত, কে যথার্থ দায়গ্রস্ত, এপিডেপিট করলেও তার সিদ্ধান্ত হয় না! দত্তবাবু আর ঘণ্টা দরজায় দাঁড়িয়ে বইলেন; এর মধ্যে দশ-বারোজনকে পরিচয় দিতে হলো, তিনি কিসের জন্য হজুরে এসেছেন। তিনি দুই একটা বেনাড়া রকমের দরোয়ানি ঠাট্টা খেয়ে গরম হচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর চার অলি দাদুনে দরোয়ান ঢিকুতে ঢিকুতে এসে তাঁরে সঙ্গে করে নিয়ে হজুরে পেশ কললে।
পাঠক। বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের কথায়, এইখানে আমাদের একটি গল্প মনে পড়ে গেল; সেটি না বলেও থাকা যায় না।
বছর দশ-বারো হলো, এই সংবের বাগবাজার অঞ্চলের একজন ভদ্রলোক তার জন্মতিথি উপলক্ষে গুটিকত ফ্রেণ্ডকে মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্তন্ন করেন। জন্মতিথিতে আমোদ করা হিন্দুদের পক্ষে ইংরেজদের কাপি করা প্রথা নয়; আমরা পুরুষপরম্পরা জন্মতিথিতে গুড়-দুধ খেয়ে তিল বুলে, মাছ ছেড়ে, (যার যেমন প্রথা) নতুন কাপড় পরে, প্রদীপ জ্বেলে, শাক্ বাজিয়ে, আইবুড়ো ভাত খাবার মত–কুটুম্ব-বন্ধু বান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে ভোজন করে থাকি। তবে আজকাল সহরের কেউ কেউ জন্মতিথিতে বেতর গোচের অমোদ করে থাকেন। কেউ যেটের কোলে ষাট বৎসরে পদার্পণ করে আপনার জন্মতিথির দিন গ্যাসের আলোর গেট, নাচ ও ইংরেজদের খানা দিয়ে চোহেলের খানা দিয়ে চোহেলের একশেষ করেন; অভিপ্রায়, আপনারা আশীৰ্বাদ করুন, আর ষাট বছর এমনি করে আমোদ কত্তে থাকুন, চুলে ও গোঁফে কলপ দিয়ে জরির জামা ও হীরের কণ্ঠী পরে নাচ দেখতে বসুন—প্রতিমা বির্জন–স্নানযাত্রা ও রথে বাহার দিন। অনেকের জন্মতিথিতে বাগান টের পান যে, আজ বাবুর জন্মতিথি, নেমন্তন্নেদের গা সারতে আফিসে একহপ্তা ছুটি নিতে হয়। আমাদের বাগবাজারের বাবু সে রকমের কোন দিকেই যান নি, কেবল গুটিকতক ফ্রেণ্ডকে ভাল করে খাওয়াবেন, এই তাঁর মতলব ছিল। এদিকে ভোজের দিন নেমন্তন্নেরে এসে একে একে জুটলেন, খাবার-দাবার সকলি প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু সেদিন সকালে বাদলা হওয়ায় মাছ পাওয়া যায় নি। বাঙ্গালীদের মাছটা প্রধান খাদ্য, সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা মাছের জন্য উড়ই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন; নানা স্থানে মাছের সন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কোন রকমেই মাছ পাওয়া গেল না।–শেষ একজন জেলে একটা সে দশ-বারো ওজনের রুইমাছ নিয়ে উপস্থিত হলো। মাছ দেখে কৰ্ম্মকর্ত্তার আর খুসীর সীমা রইলো না। জেলে যে দাম বলবে, তাই নিয়ে মাছটি নেওয়া যাবে মনে করে জেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লো, “বাপ, এটির দাম কি নেবে? ঠিক বল, তাই দেওয়া যাবে।” জেলে বল্লে, “মশাই! এর দাম বিশ ঘা জুতো।” কৰ্মকর্ত্তা বিশ ঘা জুতো শুনে অবাক হয়ে রইলেন। মনে কল্লেন, জেলে বাদলা পেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে, নয়ত পাগল। কিন্তু জেলে কোন ক্রমেই বিশ ঘা জুতো ভিন্ন মাছটি দিবে না, এই তার পণ হলো। নিমন্তুন্নে, বাড়ীর কর্তা ও চাকর-বাকরেরা জেলের এ আশ্চর্য্য দাম শুনে তারে কেউ পাগল, কেউ মাতাল বলে ঠাট্টা-মস্করা কত্তে লাগলো; কিন্তু কোন রকমেই জেলের গো ঘুচলো না। শেষে কর্ম্মকর্ত্তা কি করেন, মাছটি নিতেই হবে, আস্তে আস্তে জেলেকে বিশ ঘা জুতো মাত্তে রাজী হলেন, জেলেও অম্লানবদনে পিঠ পেতে দিলে। দশ ঘা জুতো জেলের পিঠে পড়বা মাত্র জেলে “মশাই! একটু থামুন, আমার একজন অংশীদার আছে, বাকী দশ ঘ সেই খাবে, আপনার দরোয়ান–দরজার বসে আছে, তারে ডেকে পাঠান। আমি যখন বাড়ীর ভিতরে মাছ নিয়ে আসছিলেম, তখন মাছের অর্ধেক দাম না দিলে আমারে ঢুকতে দিবে না বলেছিল, সুতরাং আমিও অর্ধেক বখরা দিতে রাজী হয়েছিলেম।” কর্ম্মকর্ত্তা তখন বুঝতে পাললেন, জেলে কিজন্য মাছের দাম বিশ ঘা জুতো চেয়েছিল। দরোয়াজীকে দরজায় বসে আর অধিকক্ষণ জেলের দামের বখরার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতে হলো না; কর্ম্মকর্ত্তা তখনি দরোয়ানজীকে জলের বিশ ঘার অংশ দিলেন। পাঠক বড়মানুষেরা! এই উপন্যাসটি মনে রাখবেন।