চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে, মোচ বেন্ধে মাথায় ঘি-কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েছে। ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো। সহরের বাবুরা বড় বড় জুড়ী, ফেটিং ও ষ্টেট ক্যারেজে নানা রকম পোষাক পরে চড়ক দেখতে বেরিয়েছেন; কেউ কাঁসারীদের সঙের মত পাল্কীগাড়ীর ছাদের উপর বসে চলেচেন! ছোটলোক, বড়মানুষ ও হঠাৎবাবুই অধিক।
অ্যাাং যায়, ব্যাং যায়, খলসে বলে আমিও খাই–বামুন-কায়েতরা ক্রমে সভ্য হয়ে উঠলো দেখে সহরে নবশাক, হাড়ীশাক, মুচিশাক মশায়েরাও হামা দিতে আরম্ভ কল্লেন; ক্রমে ছোট জেতের মধ্যেও দ্বিতীয় রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর ও কেশব সেন জন্মাতে লাগলো -সন্ধ্যার পর দু-খানি চাপাটি ও একটু ন্যাবড়ানোর বদলে-ফাউলকারী ও রোল রুটি ইণ্ট্রডিউস হলো। শ্বশুবাড়ী আহার করা মেয়েদের বাঁ-শাক বেঁধান চলিত হলো দেখে বোতলের দোকান, কড়ি গণা, মাকু ঠেলা ও ভালুকের লোমব্যাচা কোলকাতায় থাকতে লজ্জিত হতে লাগলো। সবকামান চৈতনফক্কার জায়গায় আলবার্ট ফেসান ভর্ত্তি হলো। চাবির থলে কাঁধে করে টেনা ধুতি পরে দোকানে যাওয়া আর ভাল দেখায় না; সুতরাং অবস্থাগত জুড়ী, বগী ও ব্রাউহাম বরাদ্দ হলো। এই সঙ্গে সঙ্গে বেকার ও উমেদারি হালোতের দু-একজন ভদ্রলোক, মোসাহেব, তকমা-আরদালী ও হরকরা লেখা যেতে লাগলো। ক্ৰমে কলে-কৌশলে, বেণেতা বেসাতে টাকা খাটিয়ে অতি অল্পদিন মধ্যে কলিকাতা সহরে কতকগুলি ছোটলোক বড় মানুষ হন। রামলীলে, স্নানযাত্রা, চড়ক, বেলুনওড়া, বাজি ও ঘোড়র নাচ এঁরাই রেখেছেন–প্রায় অনেকেরই এক-একটি পাশবালিশ আছে—“যে অজ্ঞে” ও “হুজুর আপনি যা বলচেন, তাই ঠিক” বলবার জন্য দুই এক গণ্ডমূর্খ ববাখুরে ভদ্রসন্তান মাইনে করা নিযুক্ত রয়েছে। শুভ-কর্মে দানের দফায় নবডঙ্কা! কিন্তু প্রতি বৎসরের গার্ডেন ফিষ্টের খরচে চার-পাঁচটা ইউনিভারসিটি ফাউণ্ড হয়।
কলকেতা সহরের অমোদ শীগগির ফুরায় না, বারোইয়ারি-পূজার প্রতিমা পূজা শেষ হলেও বারো দিন ফ্যালা হয় না। চড়কও বাসি, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে—সেসব বলতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায় ও ক্রমে তেতো হয়ে পড়ে, সুতরাং টাটকা–চড়ক টাটকা-টাটকাই শেষ করা গেল।
এদিকে চড়কতলায় টিনের ঘুরঘুরী, টিনের মুহুরী দেওয়া তল্তাবাশের বাঁশী, হলদে রং-করা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তইরি গুড়িয়া পুতুল, শোলার নানাপ্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির-করা হাড়ি বিক্রী কত্তে বসেছে; “ড্যানাক ডানাক ড্যাডাং ডাং চিংড়িমাছের দুটো ঠ্যাং” ঢাকের বোল বাজচে; গোলাপী খিলির দোনা বিক্রী হচ্ছে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে –মৈয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগলো। সকলেই আকাশ পানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন! চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখন ছেড়ে পা নেড়ে নেড়ে ঘুরতে লাগলো। কেবল “দে পাক দে পাক” শব্দ, কারু সৰ্ব্বনাশ, কারু পৌষমাস। একজনের পিঠ ফুঁড়ে ঘোরান হচ্ছে, হাজার লোক মজা দেখচেন।
পাঠক! চড়কের যথাকিঞ্চিৎ নক্মার সঙ্গে কলিকাতার বর্তমান সমাজের ইন্সাইড জানলে, ক্রমে আমাদের সঙ্গে যত পরিচিত হবে ততই তোমার বহুজ্ঞতার বৃদ্ধি হবে, তাতেই প্রথম কোট করা হয়েছে “সহর শিখাওয়ে কোতোয়ালি।”
১.০২ কলিকাতার বারোইয়ারি-পূজা
“And these what name or title e’er they bear,
—I speak of all–”
Beggars Bush.
সৌখীন চড়ক-পার্ব্বণ শেষ হলো বলেই যে দুঃখে সজনেখাঁড়া কেটে গেলেন। রাস্তার ধূলো ও কাঁকরেরা অস্থির হয়ে বেড়াতে লাগলো। ঢাকীরা ঢাক ফেলে জুতো গড়তে আরম্ভ কল্লে। বাজারে দুধ সস্তা (এতদিন গয়লাদের জল মেশবার অবকাশ ছিল না), গন্ধবেণে ভালুকের রোঁ বেচতে বসে গেলেন। ছুতরেরা গুলদার ঢাকাই-উড়ুনিতে কাঠের কুঁচো বাঁধতে আরম্ভ কল্লে। জন্ম-ফলারে যজমেনে বামুনেরা আদ্যশ্রাদ্ধ, বাৎসরিক সপিণ্ডীকরণ টাকতে লাগলেন—তাই দেখে গরমি আর থাকতে পাল্লেন না; “ঘরে আগুন”, “জল ডোবা” ও “ওলাউঠো” প্রভৃতি নানারকম বেশ ধরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন।
রাস্তার ধারের ফোড়ের দোকান, পচা নিচু ও আঁবে ভরে গেল। কোথাও একটা কাঁটালের ভুতুড়ির উপর মাছি ভ্যান ভ্যান কচ্চে, কোথাও কতকগুলো আঁবের আটি ছড়ান রয়েছে, ছেলেরা আঁটি ঘষে ভেপু করে বাজাচ্চে। মধ্যে একপলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় চিৎপুরের বড় রাস্তা চুলারের পাতের মত দেখাচ্ছে—কুঠিওয়ালারা জুতা হাতে করে, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে আর রাস্তার ধারের বেণের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে—আজ ছক্কড়মহলে পোহাবারো।
কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ী বেতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক, গ্যালবানিক শকের কাজ করে। সেকেলে আশমানী দোলদার ছক্কড় যেন হিন্দুধৰ্ম্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকেতা থেকে গা-ঢাকা হয়েছে— কেবল দুই একখান আজও খিদিরপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট অর বারাসতের মায়া ত্যাগ কত্তে পারেনি বলেই আমরা কখন কখন দেখতে পাই।
“চার অনা!” “চার অনা!” “লালদীঘি!” “তেরজরী!” “এস গো বাবু ছোট আদালত!” ব’লে গাড়োয়ানেরা সৌখীন সুরে চীৎকার কচ্চে; নববধ্বাগমনের বউয়ের মত দুই এক কুঠিওয়ালা গাড়ীর ভিতর বসে আছে।—সঙ্গী জুটচে না। দুই-একজন গবর্ণমেন্ট অফিসের কেরাণী গাড়োয়ানদের সঙ্গে দরের কষাকড়ি কচ্চেন। অনেকে চ’টে হেঁটেই চলেছেন—গাড়োয়ানের হাসি টিটকিরির সঙ্গে “তবে ঝাঁকামুটেয় যাও, তোমাদের গাড়ী চড়া কৰ্ম্ম নয়।” কমপ্লিমেন্ট দিচ্চে।