ক্রমে রাস্তায় লোকারণ্য হয়েছে। চৌমাথার বেণের দোকান লোকে পুরে গেছে। নানা রকম রকম বেশ–কারুর কফ ও কলারওয়ালা কামিজ, রূপোর বগলেস আঁটা শাইনিং লেদর; কারো ইণ্ডিয়া রবর আর চায়না কোট; হাতে ইষ্টিক, ক্রেপের চাদর, চুলের গার্ডচেন গলায়; আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো। কলিকাতা সহর রত্নাকরবিশেষ, : না মেলে এমন জানোয়ারই নাই; রাস্তার দু পাশে অনেক আমোদগেলা মহাশয় দাঁড়িয়েছেন, ছোট আদালতে উকীল, সেক্সন রাইটার, টাকাওয়ালা গন্ধবেণে, তেলী, ঢাকাই কামার আর ফলারে যজমেনে বামুনই অধিক–কারু কোলে দুটি মেয়ে–কারু তিনটে ছেলে।
কোথাও পাদরী সাহেব ঝুড়ি ঝুড়ি বাইবেল বিলুচ্ছেন–কাছে ক্যাটিকৃষ্ট ভায়া—-সুবর্ব্ব চৌকীদারের মত পোষাক—পেনটুলেন, ট্যাংট্যাঙে চাপকান, মাথায় কালো রঙ্গের চোঙ্গাকাটা টুপী। আদালতী সুরে হাত-মুখ নেড়ে খ্রীষ্টধৰ্ম্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্চেন–হঠাৎ দেখল বোধ হয় যেন পুতুলনাচের নকীব। কতকগুলো ঝাঁকাওয়ালা মুটে, পাঠশালের ছেলে ও ফ্রিওয়ালা একমনে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছ। ক্যাটিকৃষ্ট কি বলচেন, কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না। পূর্ব্বে বওয়াটে ছেলেরা বাপ-মার সঙ্গে ঝগড়া করে পশ্চিমে পালিয়ে যেতো, না হয় খ্রীষ্টান হতো; কিন্তু রেলওয়ে হওয়াতে পশ্চিম পালাবার বড় ব্যাঘাত হয়েছে আর দিশী খ্রীষ্টানদের দুর্দশা দেখে খ্রীষ্টান হতে ও ভয় হয়।
চিৎপুরের বড় রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়—ধূলোয় ধূলো; তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েছে। প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশ বেঁধে কাঁধে করেছে–কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ী বাজাতে বাজাতে চলেছে—তার পেচোনে ‘এলোমেলো নিশানের শ্রেণী। মধ্যে হাড়ীরা দল বেঁধে ঢোলের সঙ্গতে “ভোলা বোম ভোলা বড় রঙ্গিলী, লেংটা ত্রিপুরারি শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা,” ভজন গাইতে গাইতে চলেছে! তার পেচনে বাবুর অবস্থামত তক্মাওয়ালা দরোয়ান, হরকরা সেপাই। মধ্যে সর্ব্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি-মাখা, টিনের সাপের ফণার টুপী মাথায়, শিব ও পার্বতী-সাজা সং। তার পেচনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে ধূনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেছে। পাশে বেণের জিবে হাতে বাণ ফুঁড়ে চলেছে। লম্বা লম্বা ছিপ, উপরে শোলার চিংড়িমাছ বাঁধা। সেটকে সেট ঢাকে ড্যানাক ড্যানাক করে রং বাজাচ্চে। পেচনে বাবুর ভাগ্নে, ছোট ভাই বা পিসতুতে ভেয়েরা গাড়ী চড়ে চলেছে—তারা রাত্রি তিনটার সময় উঠেছেন, চোক্ লাল টকটক কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে, কালীঘেটে ধূলোয় ভয়ে গিয়েছে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখছেন, মধ্যে মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া খেপচে–হুড়মড় করে কেউ দোকানে কেউ থানার উপর পোড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেঁটে যাচ্চে-তথাপি নড়চেন না।
ক্রমে পুলিসের হুকুমত সব গাজন ফিরে গেল। সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট রাস্তায় ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেট-ঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গেছে, অমনি মার্শাল ল জারি হলো, “ঢাক বাজালে থানায় ধরে নিয়ে যাবে” ক্ৰমে দুই-একটা ঢাকে জমাদারের হেতে কোঁৎকা পড়বামাত্রেই সহর নিস্তব্ধ হলো। অনেকে ঢাক ঘাড়ে করে চুপে চুপে বাড়ী এলেন—দর্শকের কুইনের রাজ্যে অভিসম্পাত কত্তে কত্তে ফিরে গেলেন।
সহরটা কিছুকালের মত জুড়লো। বেণোরা বাণ খুলে মদের দোকানে ঢুকলো। সন্ন্যাসিরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে হাতপাখায় বাতাস ও হাঁড়ি হাঁড়ি আমানি খেয়ে ফেল্লে। গাজন তলায় শিবের ঘর বন্ধ হলো–এ বছরের মত বণিফোঁড়ার আমোদও ফুরালো। এই রকমে রবিবারটা খেতে দেখতে গেল।
আজ বৎসরের শেষ দিন। যুবত্বকালের এক বৎসর গেল দেখে যুবক-যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন। হতভাগ্য কয়েদীর নির্দিষ্ট কালের এক বৎসর কেটে গেল। দেখে আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। আজ বুড়োটি বিয়ে নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন। বুড়ো বৎসরের অধীনে আমরা যেসব কষ্ট ভোগ করেছি, যেসব ক্ষতি স্বীকার করেছি–আগামীর মুখ চেয়ে, আশার মন্ত্রণায়, আমরা সেসব মন থেকে তারই সঙ্গে বিসর্জ্জন দিলেম। ভূতকাল যেন আমাদের ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে গেলেন বর্তমান বংসর স্কুল মাষ্টারের মত গম্ভীর ভাবে এসে পড়লেন–আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত! জেলার পুরাণ হাকিম বদলা হলে নীল-প্রজাদের মন যেমন ধুকপুক করে, স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন মাষ্টারের মুখ দেখে ছেলেদের বুক যেমন গুরু গুরু করে—মড়ুঞ্চে পোয়াতীর বুড়ো বয়সে ছেলে হলে মনে যেমন মহান সংশয় উপস্থিত হয়, পুরাণর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়লেন।
ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আদর করেন। আসামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান–নেশার খোয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙ্গালীরা বছরটি ভাল রকমেই যা আর খারাবেই শেষ হোক, সজনেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে, পুরাণকে বিদায় দেন। কেবল কলসী উচ্ছুগ্গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতওলারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন!
আজ চড়ক। সকালে ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মরা একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিধিপূৰ্ব্বক উপাসনা করেচেন—আবার অনেক ব্রাহ্ম কলসী উচ্ছুগ্গু করবেন। এবারে উক্ত সমাজের কোন উপাচার্য্য বড় ধুম করে কালীপূজো করেছিলেন ও বিধবা বিবাহে যাবার প্রায়শ্চিত্ত উপলক্ষে জমিদারের বাড়ী শ্রীবিষ্ণু স্মরণ করে গোবর খেতেও ত্রুটি করেন নি। আজকাল ব্রাহ্মধর্মের মর্ম্ম বোঝা ভার, বাড়ীতে দুর্গোৎসবও হবে আবার ফি বুধবারে সমাজে গিয়ে চক্ষু মুদিত করে মড়াকান্না কাদতে হবে। পরমেশ্বর কি খোট্টা, না মহারাষ্ট্র ব্রাক্ষ্মণ যে, বেন ভাঙ্গা সংস্কৃত পদ ভিন্ন অন্য ভাষায় তারে ডাকূলে তিনি বুঝতে পারবেন না—অডিড় থেকে না ডাকূলে শুতে পাবো না? ক্ৰমে কৃশ্চানী ও ব্রাহ্মধৰ্ম্মের আড়ম্বর এক হবে, তারি যোগাড় হচ্চে।