এদিকে রকমারি বাবু বুঝে বড়মানুষদের বৈঠকখানা সরগরম হচ্ছে। কেউ সিভিলিজেশনের অনুরোধে চড়ক হেট করেন; কেউ কেউ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও— “সাত পুরুষের ক্রিয়াকাণ্ড” বলেই চড়কে অমোদ করেন; বাস্তবিক তিনি এত বড় চটা। কি করেন, বড়দাদা সেজোপিসে বর্তমান– আবার ঠাকুরমার এখনও কাশীপ্রাপ্তি হয় নাই।
অনেকে চড়ক, বাণ ফোঁড়া তলোয়ার ফোঁড়া, দেখতে ভালোবাসেন। প্রতিমা বিসর্জনের দিন পৌত্তূর, ছোট ছেলে ও কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে ভাসান দেখতে বেরোন। অনেকে বুড়ো মিন্সে হয়েও হীবেবসান টুপী, বুকে জরীর কারচোপের কর্ম্মকরা কাবা ও গলায় মুক্তার মালা, হীরের কষ্ঠ, দু’হাতে দশটা আংটা পরে “খোকা” সেজে বেরুতে লজ্জিত হন না; হয়ত তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের বয়স ষাট বৎসর–ভাগ্নের চুল পেকে গেছে।
অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদার ও রাস্তার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় পদার্পণ করে থাকেন। নেজামত আদালতে নম্বরওয়ারী ও মৎফরেষ্কার তদ্বির কত্তে হলে, ভবানীপুরেই বাসার ঠিকানা হয়। কলিকাতার হাওয়া পাড়া-গাঁয়ের পক্ষে বড় গরম। পূর্ব্বে পাড়াগেঁয়ে কলিকাতায় এলে লোণা লাগত, এখন লোণা লাগার বদলে আর একটি বড় জিনিস লেগে থাকে—অনেকে তার দরুণ একেবারে আঁতকে পড়েন; ঘাগিগোছের পাল্লায় পড়ে শেষে সর্ব্বস্বান্ত হয়ে বাড়ী যেতে হয়। পাড়াগেঁয়ে দুই এক জন জমিদার প্রায় বারো মাস এইথাতেই কাটান; দুপুরবেলা ফেটিং গাড়ী চড়া, পাঁচালী বা চণ্ডীর গানের ছেলেদের মতন চেহারা, মাথায় ক্রেপের চাদর জড়ান, জন দশ-বারো মোসাহেব সঙ্গে, বাঈজানের ভেড়ুয়ার মত পোষাক, গলায় মুক্তার মালা; দেখলেই চেনা যায়, ইনি একজন বনগাঁর শিয়াল রাজা, বুদ্ধিতে, কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ–বিদ্যায় মূর্ত্তিমান মা! বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা-নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত। মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারী ও মহাজনের ডিক্রীর দরুণ গা-ঢাকা দেন। রবিবার, পাল-পার্ব্বণ, বিসর্জন আর স্নানযাত্রায় সেজে-গুজে গাড়ী চোড়ে বেড়ান।
পাড়াগেঁয়ে হলেই যে এই রকম উনাপঁজুরে হবে, এমন কোন কথা নাই। কারণ, দুই-একজন জমিদার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় এসে বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা ও প্রশংসা নিয়ে যান। তারা সোণাগাছিতে বাস করেও সে রঙ্গে বিব্রত হন না; তাঁদের চালচুল দেখে অনেক সহুরে তাক হয়ে থাকেন। আবার কেউ কাশীপুর, বোঁড়স্যা, ভবানীপুর ও কালীঘাটে বাসা করে চব্বিশ ঘণ্টা সোণাগাছিতেই কাটান! লোকের বাড়ী চড়োয়া হয়ে দাঙ্গা করেন; তার পরদিন প্রিয়তমার হাত ধরে যুগলবেশে জ্যেঠা খুড়া বাবার সঙ্গে পুলিসে হাজির হন, ধারে হাতী কেনেন। পেমেণ্টের সময় ঠ্যাঙ্গাঠাঙ্গী উপস্থিত হয়-পেড়াপীড়ি হলে দেশে সরে পড়েন–সেথায় রামরাজ্য!
জাহাজ থেকে নূতন সেলার নামলেই যেমন পাইকরে ছেঁকে ধরে, সেই রকম পাড়াগেঁয়ে বড়মানুষ সহরে এলেই প্রথমে দালাল-পেস হন। দালাল বাবুর সদর মোক্তারের অনুগ্রহে বাড়ী ভাড়া করা, খ্যামটা নাচের বায়না করা প্রভৃতি রকমওয়ারি কাজের ভার পান ও পলিটীকেল এজেন্টের কাজ করেন। বাবুকে সাতপুকুরের বাগান, এসিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ম- বালির ব্রিজ,–বাগবাজারের থালের কলের দরজা–রকমওয়ারি বাবুর সাজানো বৈঠকখানা—ও দুইএক নামজাদা বেশ্যার বাড়ী দেখিয়ে বেড়ান। ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে পারলে দালালের বাবুর কাছে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি হয়ে পড়ে। কিছুকাল বড় আমোদ যায়, শেষে বাবু টাকার টানাটানিতে বা কৰ্ম্মান্তরে দেশে গেলে দালাল এজেন্টি কৰ্ম্মে মক্রর হয়।
আজকাল সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দু’টি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকেতা সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় “ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ”; প্রথম দলের সকলি ইংরাজী কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ডিকাণ্টরে ব্রাণ্ডি ও কাচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালু মোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেষ্ট নিউস অব দি ডে’ নিয়েই সর্ব্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পোঁছেন! এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সদগুণে ভূষিত, কেবল সর্ব্বদাই রোগ, মদ খেয়ে খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস–উৎসাহ, একতা, উন্নতীচ্ছা একেবার হৃদয় হতে নির্ব্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।।
দ্বিতীয়ের মধ্যে—বাগাম্বর মিত্র প্রভৃতি সাপ হতেও ভয়ানক, বাঘের চেয়ে হিংস্র; বলতে গেলে এরা একরকম ভয়ানক জানোয়ার। চোরেরা যেমন চুরি কত্তে গেলে মদ ঠোঁটে দিয়ে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এরা সেইরূপ স্বার্থসাধনাৰ্থ স্বদেশের ভাল চেষ্টা করেন। “কেমন করে আপনি বড়লোক হব,” “কেমন করে সকলে পায়ের নীচে থাকবে,” এই এঁদের নিয়ত চেষ্টা—পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে আপনার গোঁফে তেল দেওয়াই এঁদের পলিসী, এঁদের কাছে দাতব্য দূর পরিহার- চার অনার বেশী দান নাই।
সকালবেলা সহরের বড়মানুষদের বৈঠকথানা বড় সরগরম থাকে। কোথাও উকীসের বাড়ীর হেড কেরাণী তীর্থের কাকের মত বসে আছেন। তিন-চারিটি “ইকুটী, দুটি “কমন লা” আদালতে ঝুলচে। কোথাও পাওনাদীর বিল- সরকার উটুনোওয়ালা মহাজন খাত, বিল ও হাতচিঠে নিয়ে তিন-চার মাস হাঁটচে, দেওয়ানজী কেবল আজ না কাল কচ্চেন। ‘শমন’, ‘ওয়ারিন’ ‘উকিলের চিঠি’ ও ‘সফিনে’ বাবুর অলঙ্কার হয়েছে। নিন্দা অপমান তৃণজ্ঞান, প্রত্যেক লোকের চাতুরী, ছলনা মনে করে অন্তর্দ্দাহ হচ্চে। “র্যায়সা দিন নেহি রহেগা” অঙ্কিত আঙ্গটী আঙ্গুলে পরেচেন; কিন্তু কিছুতেই শান্তিলাভ করতে পাচ্চেন না। কোথাও একজন বড়মানুষের ছেলে অল্পবয়সে বিষয় পেয়ে, কান্নেখেকো ঘুঁড়ীর মত ঘুরচেন। পরশুদিন “বউ বউ,” “লুকোচুরি” “ঘোড়ঘোড়া” খেলেচেন, আজ তাঁকে দেওয়ানজীর কূটকচালে খতেনের গোঁজা মিলন ধত্তে হবে, উকীলের বাড়ীর বাবুর পাকা চালে নজর রেখে সরে বসতে হবে, নইলে ওঠসার কিস্তিতেই মাত! ছেলের হাতে ফল দেখলে কাকেরাও ছোঁ মারে, মানুষ তো কোন ছার;—কেউ “স্বর্গীয় কৰ্ত্তার পরম বন্ধু”, কেউ স্বর্গীয় কৰ্ত্তার “মেজোপিসের মামার খুড়োর পিসতুতো ভায়ের মামাতো ভাই” পরিচয় দিয়ে পেস হচ্চেন। “উমেদার”, কন্যাদায় (হয়ত কন্যাদায়ের বিবাহ হয় নাই) নানা রকম লোক এসে জুটেছে, আসল মতলব দ্বৈপয়ানহ্যদে ডোবা রয়েছে, সময়ে আমলে আসবে।