জামালপুর-টানেল পাহাড় ভেদ করে প্রস্তুত একটা রাস্তা; যেমন আমাদিগের দেশে মস্ত খিলানওয়ালা বাড়ীর নিচে দিয়ে অনেকদূর যেতে হয়, টানেল সেই প্রকার। তবে বাড়ীর লম্বা খিলেনপথে জল পড়ে না; এই টানেলের উপরিস্থিত নদ, নদী, বৃষ্টির জল এবং পাহাড়ের ঝরণা প্রভৃতির জল তাহার ভিতর চুয়াইয়া পড়ে, তাহাকেই টানেল কহে। ট্রেণ সেই টানেল অতিক্রম কবার সময়, জ্ঞানানন্দ বল্লেন, “দাঁদাঁ এ কি আশ্চর্য্যঁ দিঁনে রাতঁ। মেঁঘ নাঞি, বৃষ্টি নাঞি, এ অন্ধকারের ভিতর কোঁথায় যাঁচ্চিঞ?”
প্রেমানন্দ বল্লেন “ভাই, এটা আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছি না; তবে শুনেছিলাম যে, তিন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে। এটা তবে তাই বুঝি! আহা, ইংরাজ বাহাদুরদিগের কি অসীম ক্ষমতা! আমাদের পূর্ব্বেকার রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে কথিত আছে, পুষ্পকরথ, এবং নানাপ্রকার অদ্ভুত ব্যাপার, যেমন হনুমানের গন্ধমাদন পৰ্ব্বত আনা, সাগরবন্ধন ইত্যাদি মহা মহা ব্যাপার আছে, তাহা সত্য হইলেও হইতে পারে। কিন্তু এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার কদাচ কোথাও শোনাও যায় নাই, দেখাও যায় নাই, ধন্য ইংরাজের বলবুদ্ধি! প্রভু, সকলই তোমার ইচ্ছা। এই বলতে বলতে প্রেমানন্দ পুনরায় নিদ্রায় অভিভূত হলেন। গাড়ী মধ্যবর্ত্তী এষ্টেশনে মাঝে মাঝে থেমে, একেবারে মোগলসরাই এষ্টেশনে এসে পৌঁছুলো। পৌঁছবামাত্রই পুলিসম্যান, টিকিটকলেক্টর, ইঞ্জিনীয়ার প্রভৃতি, ম্যাথর, সুইপার এবং যাঁহারা গাড়ীর সমস্ত তদন্ত করেন, নিকটবর্ত্তী হয়ে, আপন আপা কাৰ্য্যে নিযুক্ত হলেন। বাবাজীরা নিজের পোটলা পুঁটলী নিয়ে, অতি যত্নের সহিত (হুঁকো কলকে ইত্যাদি কোন জিনিষের ভুল না হয়) সমস্ত দ্রব্য নিয়ে প্লাটফরমে নেমে ও রেখে হাঁপ ছাড়লেন। প্রেমানন্দ বল্লেন, “হা প্রভু বিশ্বনাথ! এইবার যদি অদৃষ্টক্রমে আপনার দর্শক পাই। এখনো বলতে পারি নে, যতক্ষণ কাশীধামে পৌঁছে আপনার মস্তকে গঙ্গাজল বিল্বপত্রাদি ছড়াইয়া প্রণিপাত না কত্তে পারি, ততক্ষণ বল্তে পারিনে।”
সেখানে নৌকার মাঝী, মুটে, গঙ্গাপুত্র, পাণ্ডা, পূজারী ইত্যাদি সকলে আপন আপন খাতা সঙ্গে নিয়ে, কলিকাতাবাসী এবং অপরাপর স্থানবাসী বাবুদিগের পিতৃপিতামহাদি চৌদ্দপুরুষের নামস্বাক্ষরিত উইকাটা খাতা (কোনখানা বা সাদা কাগজ, কোনখানা বা হলদে কাগজ, কাহার বা লেখা বোঝা যায়, কাহার বা পড়া যায় না) নিয়ে, বাপ পিতামহের নামধাম জিজ্ঞাসা করে, আপনাপন যজমান সংগ্রহ কচ্চেন।
এদিকে নৌকাওয়ালারা পুটুলি নিয়ে টানাটানি কচ্চে; কাহার পুটুলি এ নৌকা হতে ওদিকে গেছে, কাহার বা অজ্ঞাতসারে কে নিয়ে গেলে টের পাওয়া গেল না। পরে ভাড়ার জন্য নৌকাওয়ালাদের সহিত গেলযোগ কত্তে কত্তে ব্যাসকাশীতে (অর্থাৎ যাকে রামনগর বলে থাকে, কাশীব্র ও-পার, হয় ত সেইখানেতেই) অবস্থিতি কত্ত হলো। অনেক আকিঞ্চন এবং টানাটানির পর একখানি ময়ূরমুখওয়ালা নৌকো পেয়ে, পরমানন্দে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ সমস্ত দ্রব্যাদি নিয়ে সেই নৌকায় উঠলেন।
নৌকায় আরোহণ করে গঙ্গার জল হস্তে নিয়ে, আপন আপন শিরে ছড়িয়ে, “সৰ্ব্বতীর্থময়ী গঙ্গা। সদ্যদুঃখবিনাশিনী, সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গজৈব পরম গতি। মাতঃ ভাগীরথি?” এই কথা বলে, কাশীর ওপারে প্রস্তরনির্ম্মিত অতি উচ্চ অট্টালিকা এবং ঘাটের সিঁড়ি সকল দর্শন করে, জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীকে বল্লেন, “দাঁদাঁ! উঃ কতঁ উঁচুঁ বাঁড়ী সকঁলঞ, আরঁ কতঁ প্রশস্তঁ ঘাঁট, কঁলিকাঁতায়ঞ কিঁম্বা অঁন্যান্য দেঁশে দ্যাখাঁ গেঁছে বঁটেঞ কিন্তু এঁরূপ নয়ঞ।”
প্রেমানন্দ বল্লেন, “ভায়া! দেখ পাহাড়ের দেশ, এ স্থলে মৃত্তিকা অতি বিরল; সুতরাং পাথরের বাড়ী, পাথরের ঘাট, পাথরময় কাশী, সমস্তই পাথরের।” এই কথা বলতে বলতে দশাশ্বমেধ ঘাটে নৌকা উত্তীর্ণ হলো; বাবাজীরা নৌকা থেকে অবতীর্ণ হতে না হতে, পুৰ্ব্বেকার মত পূজারী, পাণ্ডা কুলি ও যাত্ৰাওয়ালা প্রভৃতি সকলে নৌকোর নিকটে এসে কেউ পুটুলি টানছে, কেউ বা জিজ্ঞাসা কচ্চে, “মশাই, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, আপনি কার যজমান, কার ছেলে, নিবাস কোথায়, পরিচয় দিন, তা হলে আমরা সকলেই জাতে পারব যে, আপনি কার যজমান।”
প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “মহাশয়! আমি অতি অল্প বয়সে পিতৃহীন, সুতরাং আমি জ্ঞাত নই যে, আমার বাপ পিতামহ কখন কাশীতে এসেছিলেন কি না। কারণ, তখন নৌকোতে আসতে হতো এবং আমার কেউ নেই যে, আমাকে বলে দিয়ে থাকবে যে, ফলনা অমুক তুমুক। অতএব আমি আর কিছুই জানি না।”
এই কথা শুনে, দলমধ্যস্থ এক জন অতি বলবান পুরুষ, “তবে এ যজমান আমার, আমি একে সুফল দান করব।” এই কথা বলে, তিনি আপন ঝুলি হতে নারিকেল, আতপ চাল ইত্যাদি বাহির করে, বাবাজীদের হাতে দিয়ে বল্লেন, ‘আপনারা সমস্ত দ্রব্য এইখানে রাখুন’; এবং তাহার সঙ্গী গুণ্ডাদিগকে বল্লেন, “দেখ, খুব খবরদার।” অন্য অন্য পাণ্ডা প্রভৃতি ও পূজারিগণ যেন অতি দীন নেড়ি কুকুরের মত তফাৎ থেকে বিদ্রুপ টিটকিরি ইত্যাদি কত্তে লাগলো; পাণ্ডাজী নিজের গায়ের পাঞ্জাবী আস্তেন জামা এবং পাগড়ীটি গঙ্গাতীরে রেখে বাবাজীদিগকে জলে দাঁড় করিয়ে, যথাযোগ্য মন্ত্রপূত কল্লেন, এবং বল্লেন, “সুফলের দক্ষিণ দিয়ে মণিকর্ণিকার জল স্পর্শ কিম্বা অবগাহন করে চল বাবা বিশ্বনাথজীর পূজা করবে, ষোড়শোপচারে হইবে, না মধ্যবিত্ত?”