বালি একটা বিখ্যাত স্থান! টেকচাঁদের বালির বেণীবাবুও বিখ্যাত লোক —“আলালের ঘরের দুলাল” মতিলাল বালি হতেই তরিবত পান; বিশেষতঃ বালির ব্রিজটাও বেশ! বালির যাত্রীরা বালিতে নাবলেন। ধোপা ও গঙ্গাভক্তির দলটা বালিতে নাবায়, প্রেমানন্দও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দলের ছোঁড়াগুলো নাব্বার সময় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে একটা করে চিমটি কেটে গেল। উত্তরপাড়া বালির লাগোয়া। আজকাল জয়কৃষ্ণের কল্যাণে উত্তরপাড়া বিলক্ষণ বিখ্যাত স্থান। বিশেষতঃ উত্তরপাড়ার মডেল জমিদারের নর্ম্ম্যাল স্কুল প্রায় স্কুলের কোর্সলেকচরের ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা-হোল্ডার; শুনতে পাই, গুরুজীর দু-একটি ছাত্র প্রকৃত বেয়াল্লিশকর্ম্মা হয়ে বেরিয়েছেন।
ক্রমে ষ্টেশনের রেলকাটা ঘণ্টা টুং টাং টাং আওয়াজ দিলে অরোহীরা টিকিটঘরের দরজা খুঁজে না পাওয়াতে কুলি, মজুর, চাপরাসী এবং আরোহীদের জিজ্ঞাসা কচ্চেন, “মশায়! টিকিট কোথায় পাওয়া যায়?” তার মধ্যে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, বোধহয় কলিকাতার সিঙ্গি মহাশয়দের বাড়ীতে পূজার বার্ষিক এবং একখানি পেতলের থালা মায় চিনি সমেত পাবার প্রত্যাশায়, কলকাতায় আসছিলেন। তিনি বল্লেন, “এই ঘরে টিকিট পাওয়া যায়, তা কি তুমি জান না?” তাদের মধ্যে একটি নব্যবয়স্ক বালক ঠাকুরমার গলার একগাছি দানা এবং দাদা মহাশয়ের আমলের রূপার পুরাতন পৈঁচে, কাণের একটি পাশা ও কতকগুলি টাকা, কাপড়চোপড়, প্রভৃতি খাবার-দাবার, শিশি বোতল ইত্যাদিতে পূর্ণিত একটি ব্যাগ হস্তে দৌড়ে বাড়াচ্ছেন। প্রতুদিগের গাড়ীতে কিঞ্চিৎ স্থান দেখে অতি কুষ্ঠিতভাবে বল্লেন, “দয়াময় যদি অনুগ্রহ করে এই গাড়ীতে আমাকে একটু স্থান দেন?” বেচারীর অবস্থা ও উৎকণ্ঠিত চেহারা দেখিয়া জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “বাবু, তুমি এই গাড়ীতে এস।” বালকটি অতি কুষ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “মহাশয়! আপনারা কে এবং কোন বংশ?” তাতে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ উত্তর কল্লেন, “বাবু, আমরা বৈষ্ণব—নিত্যানন্দবংশ।” এই কথা শ্রবণমাত্র বালকটি গোস্বামী জ্ঞান করে সাষ্টাব্দ হয়ে তাদের পদধূলি নিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু গলদেশে পৈতা দেখে বাবাজীরা নিষেধ করে বল্লেন, “হাঁ হাঁ, আমরা বৈষ্ণব, তুমি ব্রাহ্মণ দেখচি।” বালক বল্লে, “আপনারা বৈষ্ণব হউন, তাতে কোন ক্ষতি নেই, আপনাদের আচরণ দেখে আমার এতদূর পর্য্যন্ত ভক্তি জন্মেছিল যে, আপনাদের পদধূলি লই।”
প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ-হাঁ-হাঁ বাপু, স্থির হও; বাপু, তুমি কোথায় যাবে, কোন ষ্টেশনে তুমি নাব্বে?”
বালক। “আজ্ঞে আমি জামাই-ষ্টেশনে নাব্বো।”
প্রেমা। “বাপু, জামাই-ষ্টেশন কোন জেলায়?”
বালক। “প্রভু! আপনি এত বড় বিদ্যাদিগগজ, অদ্যাবধি জামাই-ষ্টেশন কাকে বলে জানেন না?”
প্রেমা। “বাপু, আমাদের রেলে গতিবিধি অতি বিরল। কালে-ভদ্রে কখন কখন নবদ্বীপ অঞ্চলে গিয়া থাকি। কুলের মহাপ্রভু পাট এবং শ্রীপাট খড়দহে শ্যামসুন্দরের পাদপদ্ম দর্শন মানসে যাওয়া আসা হয়, এই মাত্র। তবে নূতন রেলগাড়ী খোলাতে বিশ্বনাথ এবং গোবিনজী গোপীনাথের শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করবার মনন করেছি। তা এখন কত দূর কি হয়, তা বলিতে পারি না।”
বালক রেলওয়ে হুইশিল ও গাজ মোশন কম দেখিয়া মনে মনে বিবেচনা কল্লে যে, এইবার আমার নিকটবর্ত্তী ষ্টেশনে নামিতে হইবে। পরে বাবাজীদের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে বলে, “জামাই-ষ্টেশন কাহাকে বলে এই দেখুন, যেখানে আমি নামিয়া যাইব, অর্থাৎ কোন্নগর ষ্টেশন। এই স্থানে অনেক ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থের পুত্রকন্যার বিবাহ হয় এবং সময়ে সময়ে অনেক অফিসের কর্ম্মচারী জামাইবাবুরা এই ষ্টেশনে অবতীর্ণ হন, সেই কারণে কোন্নগর ষ্টেশনকে জামাই ষ্টেশন বলা হয়।”
ক্রমে গাড়ী প্ল্যাটফরমে এসে পড়লো, চড়কগাছের মত মস্ত বাহাদুরী কাঠের উপরে ডান হাতে বাঁ হাতে তোলা দুখানি তক্তা এবং রেড, গ্রীন, হোয়াইট লাইটের প্ল্যাস দেওয়া ল্যাম্পগুলি যথাস্থানে রাখা হয়েচে। আরোহীরা নামিয়া গেল ও উঠিল। গার্ড একবার ব্রেকভ্যান থেকে নেমে এসে, ষ্টেশনমাষ্টার, বুকিং ক্লার্ক ও সিগনালারের সঙ্গে খানিক হাসি-মস্করা করে, রেলওয়ের চামড়ানির্ম্মিত লেটার ব্যাগ এবং পার্শ্বেল ইত্যাদি সমস্ত ব্রেকভানে তুলে নিয়ে বল্লেন, ‘ওয়েল হাউফার?’ কাল চাপকান পরা, মাথায় কাল টুপিতে “ই, আই, আর” লেখা, নিগুঁপো নাটাগড়ে আমদানী পাড়াগেঁয়ে বাবু ঈষৎ হাস্য করে বল্লেন, “চাপরাসি! ঠিক হয়, ঘণ্টা মারো।” ষ্টেশনমাষ্টারের অর্ডারে রেলকাটা তারে ঝোলান ঘণ্টা একটি লোহার হাতুড়ী দ্বারা আহত হয়ে টং টং টং করে আওয়াজ দিলে। ষ্টেশনমাষ্টার আপন গলার মালাগাছটি লজ্জাসহকারে আপন চাপকানের ভিতর গুঁজতে গুঁজতে অর্ডার দিলেন, ‘অলরাইট।’ সে অপ্রতিভ ভাবটি শুধু চাপানের প্রথমের বোতামটি ছিঁড়িয়া যাওয়ার জন্য ঘটেছিল, নচেৎ মালাগাছটি কেউ দেখতে পেত না। কাটা পোষাকের উপর দৃশ্যমান মালাগাছটি বাবুকে একটু লজ্জা দিচ্ছিল, তাইতে তিনি সেটি লুকোবার চেষ্টায় ছিলেন।
ক্রমে রেলগাড়ী হুস্ হুস্ করে চলতে লাগলো। জ্ঞানানন্দ এবং প্রেমানন্দ বাবাজীদের যেন দোলায় চড়া ছেলের মত নিদ্রা আকর্ষণ হলো; কখনো বা ঘোর, কখনো বা জাগ্রত। এই প্রকার অবস্থায় রেলগাড়ী বরাবর চলে গিয়ে মধ্যবর্ত্তী ছোট ষ্টেশনে অল্পক্ষণ দাঁড়াল; সুতরাং সেখানে বেশী কলরব নেই বলে বাবাজীদের নিদ্রাভঙ্গ হলো না। তারপর যখন গাড়ী বর্দ্ধমানে পৌঁছে, সেই সময় বাবাজীদের নিদ্রা ভাঙ্গে।