আমাদের নব্যবাবুকে একজন বিখ্যাত লোক বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ তিনি সহরের নিকটবর্ত্তী একটি প্রসিদ্ধ স্থলে একটি ব্রাহ্মসভা স্থাপন করে, স্বয়ং তার সম্পাদক হয়েছিলেন, এ সওয়ায় সেই গ্রামেই একটি ভারি মাইনের চাকরী ছিল। নববাবু “রিফৰ্ম্মড ক্লাসের টেক্কা ও সমাজের রঙ্গের গোলামহরূপ” ছিলেন। দিবারাত্রি “সামগ্রী” কত্তেন, ও সর্ব্বদাই ভরপূর থাকত্তেন–শনিবার ও রবিবার কিছু বেশী মাত্রায় “কারগো” নিতেন, মধ্যে মধ্যে “বানচাল হওয়ারও বাকি থাকতো না। প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের “ফরণিচর” ও “লাইব্রেরীর” বই কিনতে বাবু ছুটি নিয়ে শহরে এসেছিলেন। ক দিন খোঁড়া ব্রহ্মের সমাজেই প্রকৃতির প্রীতি ও প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করে, বিলক্ষণ ব্রহ্মানন্দ লাভ করা হয়। মাতাল বাবু গাড়ীর মধ্যে ঢুকে প্রথমে প্রেমানন্দ বাবাজীর ভুঁড়ির উপর টলে পড়লেন, আবার ধাক্কা পেয়ে জ্ঞানানন্দের মুখের উপর পড়ে পুনরায় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে টলে পড়লেন। বাবাজীরা উভয়ে তটস্থ হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি কত্তে লাগলেন। মাতাল কোথায় বসবেন, তা স্থির কত্তে না পেরে মোছলমানদের গাজীমিয়ার ধ্বজার মত, একবার এ পাশ একবার ও পাশ কত্তে লাগলেন।
বাবাজীরা যাতালবাবুর সঙ্গে, এক খাঁচায় পোয়া বাজ ও পায়রার মত বসবাস করুন ছক্কড়খানি ভরপুর বোঝাইয়ে নবাবী চালে চলুক; তল্পিদারেরা অনবরত গাঁজা ফুঁকতে থাক। এ দিকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায়, সহর আবার পূর্ব্বানুরূপ গুলজার হয়েচে। মধ্যাবস্থ গৃহস্থের বাজার কত্তে বেরিয়েচেন; সঙ্গে চাকর ও চাকরাণীরা ধামা ও চাঙ্গায়ী নিয়ে পেচু পেচু চলেছে, চিৎপুর রোডে মেঘ কল্লে কাদা হয়, সুতরাং কাদার জন্য পথিকদের চলবার বড়ই কষ্ট কচ্চে; কেউ পয়নালার উপর দিয়ে, কেউ খানার বার দিয়ে, জুতো হাতে করে কাপড় তুলে চলেছেন। আলু পটল! ঘি চাই! গুড় ও ঘোল! ফিরিওয়ালারা চীৎকার কত্তে কতে যাচ্চে; পাছে পাছে মেচুনীরা চুপড়ি মাথায় নিয়ে, হাত নেড়ে, হন হন করে ছুটেছে, কার সঙ্গে মেছোর কাঁধে বড় বড় ভেট্কী ও মৌলবীর মত চাঁপদাড়ী ও জামাজোড়া-পরা চিংড়িভরা বাজরা ও ভার। রাজার বাজার, লালাবাবুর বাজার, পোস্তা ও কাপুড়েপটি জনতায় পরিপূর্ণ। দোকানে বিবিধ সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে, দোকানদারেরা ব্যতিব্যস্ত, খদ্দেরদের বেজায় ভিড়। শীতলঠাকুর নিয়ে ডোমের পণ্ডিত মন্দিরার সঙ্গে গান করে ভিক্ষা কচ্চে, খঞ্জনী ও একতারা নিয়ে বষ্টম ও নেড়ানেড়িরা গান কচ্চে; চার পাচজন ‘তিন দিবস আহার হয় নাই’ ‘বিদেশী ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতালোক!’ বলে ঘুরচে। অনেকের মৌতাতের সময় উত্তীর্ণ হয়েচে; অন্য কোন উপায় নাই, কিছু উপার্জনও হয় নাই, মদওয়ালাও ধার দেওয়া বন্ধ করেচে, গত কল গায়ের চাদরখানিতে চলেচে–আজ আর সম্বলমাত্র নাই। ম্যাথরেরা ময়লা ফেলে এসে মদের দোকেনে ঢুকে কসে রম টানছে, ও মুদ্দাফরাসদের সঙ্গে উভয়ের অবলম্বিত পেশার কোন্টা উত্তম, তারি তক্বার হচ্ছে। শুঁড়ি মধ্যস্থ হয়ে কখন মুদ্দাফরাশের কাজটাকে ম্যাথরের পেশা হতে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করে, মুদ্দাফরাশকে সন্তুষ্ট কচ্চেন; কখন ম্যাথরের পেশাটাকে শ্রেষ্ঠ বলে মানচেন! ঢুলি, ডোম, কাওয়া ও দুলে বেহারারা কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ন্যায় উভয় দলের সহায়তা কচ্চে। হয় ত এমন সময়ে একদল ঝুমুর বা গদাইনাচ আসরে উপস্থিত হবামাত্র, তর্কাগ্নিতে একবারে জল দেওয়া হলো-মদের দোকান বড়ই সরগরম। সহরের দেবতারা পর্য্যন্ত রোজগেরে। কালী ও পঞ্চানন্দ প্রসাদী পাঁঠার ভাগা দিয়ে বসেছেন; অনেক ভদ্দরলোকের বাড়ী উঠনো বরাদ্দ করা আছে; কোথাও রসুই করা মাংসেরও সরবরাহ হয়; খদ্দের দলে মাতাল, বেণে ও বেশ্যাই বারো আনা। আজকাল পাঁঠা বড় দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হওয়ায় কোথাও কোথাও পাঁঠী পর্য্যন্ত বলি হয়; কোন স্থলে পোষা বিড়াল ও কুকুর পর্য্যন্ত কেটে মাংসের ভাগায় মিশাল দেওয়া হয়! যে মুখে বাজারের বসুইকরা মাংস অক্লেশে চলে যায়, সেথায় বিড়াল কুকুর ফেলবার সামগ্রী নয়। জলচর ও খেচরের মধ্যে নৌকা ও ঘুড়ি ও চতুম্পদের মধ্যে কেবল খাট খাওয়া নাই।
পাঠকগণ! এতক্ষণ আপনাদের প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দের গাড়ী রেলওয়ে টরমিনসে পৌঁছুলে প্রায় দেখুন! আপনাদের বৈঠকখানার ঘড়ী নটা বাজিয়ে দিয়ে, পুনরায় অবিশ্রান্ত টুকটাক করে চলছে, আপনারা নিয়মাতিরিক্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত হন, চন্দ্র ও সূর্য্য অস্তাচলে আরাম করেন, কিন্তু সময় এক পরিমাণে চলচে, ক্ষণকালের তরে অবসর, অবকাশ বা আরামের অপেক্ষা বা প্রার্থনা করে না। কিন্তু হায়! আমরা কখন কখন এই অমূল্য সময়ের এমনই অপব্যয় করে থাকি, শেষে ভেবে দেখে তার জন্য যে কত তীব্রতর পরিতাপ সহ্য কত্তে হয়, তার ইয়ত্তা করা যায় না।
এদিকে সেই ছক্কড়ের ভিতরে সেই ব্রাহ্মবাবুর শেষে থপ করে জ্ঞানানন্দের কোলে বসে পড়লেন; ব্রাহ্মবাবুর চাপনে জ্ঞানানন্দ মৃতপ্রায় হয়ে গুড়িশুড়ি মেরে গাড়ীর পেনেলসই হয়ে রইলেন; বাবু সরে সামলে বসে খানিক একদৃষ্টে প্রেমানন্দের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে, রেলওয়ে ব্যাগটি পায়দানে নাবিয়ে, জ্ঞানানন্দের দিকে একবার কটাক্ষ করে নিয়ে পকেট হতে প্রেসিডেন্সি মেডিকেল হল লেবেল দেওয়া একটি ফায়েল বার করে, শিশির সমুদার আরকটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে খানিক মুখ বিকৃত করে, রুমালে মুখ মুচে, জামার জেল হতে দু ডুমে সুপুরি বন্ধ করে চিবুতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মবাবুর গাড়ীতে ওঠাতে বড় বিরক্ত হয়েছিলেন এবং উভয়ে আড়ষ্ট হয়ে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কত্তেছিলেন, কারণ বাবুর একটি কালো বনাতের পেণ্টুলেন ও চাপকান পরা ছিল। তার উপর একটা নীল মেরিনের চায়নাকোট, মাথায় একটা বিভর হেয়ারের চোঙ্গাকাঁটা ট্যাসল লাগানো ক্যাটিকৃষ্ট ক্যাপ ও গলায় লাল ও হলদে জালবোনা কম্ফর্টার, হাতে একটা কার্পেটের ব্যাগ ও একটা বিলিতী ওকের গাঁট বাহির করা কেঁদো কোঁৎকা, এতদ্ভিন্ন বাবুর সঙ্গে একটা ওয়াচ ছিল, তার নিদর্শন স্বরূপ একটি চাবি ও দুটি শিল চুলের গার্ডচেনে ঝুলচে। হাতের আঙ্গুলে একটি আংটিও পরা ছিল, জ্ঞানানন্দ ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন যে, সেটির ওপরে ওঁ তৎ সৎ’ খোদা রয়েছে। ব্রাহ্মবাবু আরকের ঝাঁজ সামলে প্রেসিডেন্সি ডাক্তারখানার লেবেল মারা ফায়েলটা গাড়ী হতে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেখলেন, প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ একদৃষ্টে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কচ্চেন। সুতরাং কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে একটু মুচকে হেসে জ্ঞানানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “প্রভু আপনার নাম?” জ্ঞানানন্দবাবুকে তার দিকে ফিরে কথা কবার উদ্যম দেখেই শঙ্কিত হয়েছিলেন, এখন প্রথম একবার একটিপ নস্য নিলেন, শামুকটা বার দুচ্চার টুকলেন, শেষে অতিকষ্টে বল্লেন, “আমার নাম পুঁচ করেচেন ঞ আমার নাম শ্রীজ্ঞানানন্দ দাস দেব, নিবাস শ্ৰীপাট কুমারনগর।” মাতালবাবু নাম শুনে পুনরায় একটু মুচকে হেসে জিজ্ঞাসা কল্লে, “দেব বাবাজীর গমন কোথায় হবে,” জ্ঞানানন্দ এ কথার কি উত্তর দিবেন তা স্থির কত্তে না পেরে প্রেমানন্দের মুখপানে চেয়ে রহিলেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দ হতে চালাক চোস্ত ও ধড়িবাজ লোক; অনেকস্থলে পোড়খাওয়া হয়েচে, সুতরাং এই অবসরে বল্লেন, “বাবু আমরা দুই জনেই গোঁসাইগগাবিন্দ মানুষ। ইচ্ছা, বারাণসী দর্শন করে বৃন্দাবন যাব, বাবুর নাম?” মাতালবাবু পুনরায় কিঞ্চিৎ হাসলেন ও পকেট হতে দু ডুমো সুপুরি মুখে দিয়ে বল্লেন, “আমার নাম কৈলাসমোহন, বাড়ী এইখানেই, কৰ্ম্মস্থানে যাওয়া হচ্ছে।” প্রেমানন্দবাবুর নাম শুনে কিঞ্চিৎ গম্ভীর ভাব ধারণ করে বল্লেন, “ভাল ভাল, উত্তম!” ব্রহ্মবাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা কল্লেন, “দেব বাবাজী কি আপনার ভ্রাতা?” এতে প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ বাপু, একপ্রকার ভ্রাতা বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ সহধর্মী; আরো জ্ঞানানন্দ ভায়া বিখ্যাত বংশীয়—পূজ্যপাদ জয়দেব গোস্বামী ওনার পূৰ্ব্বপিতামহ।” মাতালবাবু এই কথায় ফিক করে হাসলেন ও প্রেমানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “উনি তো জয়দেবের বংশ, প্রভু কার বংশ? বোধ হয়, নিতাই চৈতন্যের স্ববংশীয় হবেন!” এই কথায় রহস্য বিবেচনায় প্রেমানন্দ চুপ করে গোঁ হয়ে বসে রইলেন; মনে মনে যে যার পর নাই বিরক্ত হয়েছিলেন, তা তাঁর মুখ দেখে ব্রাহ্মবাবু জানতে পেরে, অপ্রস্তুত হবার পরিবর্তে বরং মনে মনে আল্লাদিত হয়ে, বাবাজীদের যথাসাধ্য বিরক্ত কত্তে কতনিশ্চয় হয়ে, প্রেমানন্দের দিকে ফিরে বল্লেন, “প্রভু! দিব্বি সেজেচেন। সহসা আপনারে দেখে আমার মনে হচ্ছে, যেন কোথাও যাত্রা হবে, আপনারা সেজে গুঁজে চলেছেন। প্রভু একটি গান করুন দেখি, মধ্যে আপনাদের ভানের ধমকে তো একবার রাস্তায় মহামারী ব্যাপার ঘটে উঠেছিল; দেখা যাক, আবার কি হয়। শুনেচি, প্রভু সাক্ষাৎ তানস্থান।” প্রেমানন্দের সঙ্গে বাবুর এই প্রকার যত কথাবার্ত্তা হচ্ছে, জ্ঞানানন্দ ততই ভয় পাচ্চেন ও মধ্যে মধ্যে গাড়ীর পার্শ্ব দিয়ে দেখছেন, রেলওয়ে টরমিনস কত দূর; শীঘ্র পৌঁছুলে উভয়ের এই ভয়ানক বেল্লিকের হাত হতে পরিত্রাণ হয়।