বাবাজী একটি ভাল দিন স্থির করে প্রত্যুষেই দৈনন্দিন কাৰ্য্য সমাপন কল্লেন ও তাড়াতাড়ি যথাকথঞ্চি বাড়ীর বিগ্রহের প্রসাদ পেয়ে, দুই শিষ্য ও তল্পিদার ও ছড়িদার সঙ্গে লয়ে, মঠ হতে বেরিয়ে গাড়ীর সন্ধানে চিৎপুররোডে উপস্থিত হলেন। পাঠকবর্গ মনে করুন, যেন স্কুল অফিস খোলবার এখনো বিলম্ব আছে, রামলীলার মেলার এখনো উপসংহার হয়নি। সুতরাং রাস্তায় গহনার কেরাঞ্চী থাকবার সম্ভাবনা কি। বাবাজী অনেক অনুসন্ধান করে শেষে এক গাড়ীর আড্ডায় প্রবেশ করে, অনেক কষা-মাজার পর একজনকে ভাড়া যেতে সম্মত কল্লেন। এদিকে গাড়ী প্রস্তুত হতে লাগলো, বাবাজী তারি অপেক্ষায় এক বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন।
শ্রীপাট কুমারনগরের জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীর পরম বন্ধু ছিলেন। তিনিও রেলগাড়ী চড়ে বারাণসী দর্শনে ইচ্ছুক হয়ে, কিছু পূর্ব্বেই বাবাজীর শ্রীপাটে উপস্থিত হয়ে, সেবাদাসীর কাছে শুনলেন যে, বাবাজীও সেই মানসে কিছু পূর্ব্বেই বেরিয়ে গেচেন। সুতরাং এরই অনুসন্ধান কত্তে কত্তে সেইখানেই উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। জ্ঞানানন্দ বাবাজী যার পর নাই কৃশ ছিলেন; দশবৎসরের জ্বর ও কাসী রোগ ভোগ করে শরীর শুকিয়ে কঞ্চি ও কাঠির মত পাকিয়ে গেছিল, চক্ষু দুটি কোটরে বসে গেছে, মাংস-মেদের লেশমাত্র শরীরে নাই, কেবল কখন কঙ্কালমাত্রে ঠেকেচে; তায় এক মাথা রুক্ষ তৈলহীন চুল, একখানা মোটা লুই দুপাট করে গায়ে জড়ানো, হাতে একগাছা বেঁউড় বাঁশের বাঁকা লাঠি ও পায়ে একজোড়া জগন্নাথি উড়ে জুতো। অনবরত কালচেন ও গয়ের ফেলচেন এবং মধ্যে মধ্যে শামুক হতে এক এক টিপ নস্য লওয়া হচ্ছে। অনবরত নস্য নিয়ে নাকের নলি এমনি অসাড় হয়ে গেছে যে, নাক দিয়ে অনবরত নস্য ও সর্দ্দিমিশ্রিত কফজল গড়াচ্ছে, কিন্তু তিনি তা টেরও পাচ্চেন না, এমন কি, এর দরুণ তাঁরে ক্রমে থোনা হয়ে পড়তে হয়েছিল এবং আলজিভও খারপ হয়ে যাওয়ায় সর্ব্বদাই ভেটকী মাছের মত হা করে থাকত্তেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দের সাক্ষাৎ পেয়ে বড়ই আদিত হলেন। প্রথমে পরস্পরে কোলাকুলি হলো, শেষে কুশল-প্রশ্নদির পর দুই বন্ধুতে দুই ভেয়ের মত একত্রে বারাণসী দর্শন কত্তে যাওয়াই স্থির কল্লেন!
এদিকে কেরাঞ্চী প্রস্তুত হয়ে বাবাজীদের নিকটস্থ হলে, তল্পিদার তল্পি নিয়ে ছাদে, ছড়িদার ও সেবায়েৎ পেছোনে ও দুই শিষ্য কোচ বক্সে উঠলো। বাবাজীরা দুজনে গাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কল্লেন। প্রেমানন্দ গাড়ীতে পদার্পণ করবামাত্র গাড়ীখানি মড় মড় করে উঠলো, সামনের দিকে জ্ঞানানন্দ বসে পড়লেন। উপরের বারাণ্ডায় কতকগুলি বেশ্যা দাঁড়িয়েছিল, তারা বাবাজীকে দেখে পরস্পর “ভাই একটা একগাড়ী গোঁসাই দেখেছিস! মিন্সে যেন কুম্ভকর্ণ!” প্রভৃতি বলাবলি করতে লাগলো। গাড়োয়ান গাড়ীতে উঠে সপাসপ করে চাবুক দিয়ে ঘোড়ায় বাস হ্যাঁচকাতে হ্যাঁচকাতে জিভে ট্যাক্ ট্যাক্ শব্দ করে চাবুক মাথার উপরে ঘোরাতে লাগলো, কিন্তু ঘোড়ার সাধ্য কি যে, এক পা নড়ে! কেবল অনবরত লাথি ছুড়তে লাগলো ও মধ্যে মধ্যে বাতকর্ম্ম করে আসোর জম্কিয়ে দিলে।
পাঠকবর্গের স্মরণ থাকতে পারে যে, আমরা পূর্ব্বেই বলে গেচি, কলিকাতা আজব শহর। ক্রমে রাস্তায় লোক জমে গেল। এই ভিড়ের মধ্যে একটা চীনের বাদামওয়ালা ছোঁড়া বলে উঠলো, ‘ওরে গাড়োয়ান। এক দিকে একটা ধূম্মলোচন ও আর এক দিকে একটা চিম্ড়ে সওয়ারি, আগে পাষাণ ভেঙ্গে নে, তবে চলবে।’ অমনি উপর থেকে বেশ্যারা বলে উঠলো, ‘ওরে এই রোগা মিন্সেটার গলায় গোটাকতক পাথর বেঁধে দে, তা হলে, পাষাণ ভাঙ্গা হবে।’ প্রেমানন্দ এই সকল কথাতে বিরক্ত হয়ে ঘৃণা ও ক্রোধে জ্বলে উঠে, খানিকক্ষণ ঘাড় গুঁজে রইলেন; শেষে ঈষৎ ঘাড় উঁচু করে জ্ঞানানন্দকে বল্লেন, ‘ভায়া! সহরের স্ত্রীলোকগুলা কি ব্যাপিকা দেখেচো’ ও শেষে ‘প্রভো! তোমার ইচ্ছা’ বলে হাই তুল্লেন! জ্ঞানানন্দও হাই তুল্লেন ও দুবার তুড়ি দিয়ে একটিপ নস্য নিয়ে বল্লেন, “ঠিক বলেঁচো দা দাঁ, ওরাঁ ভঁর্তার কাঁছে উঁপদেশ পাঁঞি নাঁঞি, ওঁঞাদের রাঁমা রঁঞ্জিকার পাঁঠ দেঁওঞা উঁচিত।”
প্রেমানন্দ রামারঞ্জিকার নাম শুনে বড়ই পুলকিত হয়ে বল্লেন, ‘ভায়া না হলে মনের কথা কে বলে? রামারঞ্জিকার মত পুঁথি ত্রিজগতে নাই। প্রভো তোমার ইচ্ছা জ্ঞানানন্দ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটিপ নস্য নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথাটা চুল্কে বল্লেন, দাঁ দাঁ, শুঁনেছি বিবিরাঁ নাঁকি রাঁমারঁঞ্জিকা পঁড়ছেঁ। প্রেমানন্দ অমনি আহ্লাদে “আরে ভায়া, রামারঞ্জিকা পুঁথির মত ত্রিজগতে হান পুঁথি নাঞি! প্রভো, তোমার ইচ্ছা।”
এদিকে অনেক কসলতের পর কেরাঞ্চি গুড়িগুড়ি চলতে লাগলেন; তল্পিদারেরা গাড়ীর ছাদে বসে গাঁজা টিপতে লাগলো! মধ্যে শরতের মেঘে এক পসলা ভারি বৃষ্টি আরম্ভ হলো, বাবাজীর গাড়ীর দরজা ঠেলে দিয়ে অন্ধকারে বারোইয়ারির গুদম্জাত সংগুলির মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন। খানিকক্ষণ এইরূপে নিস্তব্ধ হয়ে থেকে জ্ঞানানন্দ বাবাজী একবার গাড়ীর ফাটলে চক্ষু দিয়ে বৃষ্টি কিরূপ পড়চে তা দেখে নিয়ে একটিপ নস্য নিলেন ও বারদুই কেসে বল্লেন, “দাঁ, দাঁ, এঁকটা সংকীৰ্ত্তন হঁক শুঁধু শুঁধু বসে কাল কাঁটান হচ্ছে ঞন্না।” প্রেমানন্দ সঙ্গীতবিদ্যার বড় ভক্ত ছিলেন, নিজে ভাল গাইতে পারুন আর নাই পারুন, আড়ালে ও নিজ্জনে সৰ্ব্বদা গলাবাজী কত্তেন ও দিবারাত্র গুগুণোনির কামাই ছিল না। এ ছাড়া বাবাজী সঙ্গীতবিষয়ক একখানা বইও ছাপিয়েছেন এবং ঐ সকল গান প্রথম প্রথম দু-এক গোড়ার বাড়ী মজলিস করে গায়ক দিয়ে গাওয়ানো হয়, সুতরাং জ্ঞানানন্দের কথাতে বই প্রফুল্লিত হয়ে মল্লার ভেজে গান ধনে পাঠশালার ছেলেরা যেমন ঘোষবার সময়ে সম্বার পোড়োর সঙ্গে গোলে হরিবোল দিয়ে গণ্ডায় এ বলে সায় দিয়ে যায়, সেই প্রকার জ্ঞানানন্দ প্রেমানন্দের সঙ্গীত শুনে উৎসাহিত হয়ে মধ্যে মধ্যে দুই একটা তান মারতে লাগলেন। ভাঙ্গা ও খোন, আওয়াজের একত্র চাকারে গাড়োয়ান গাড়ী থামিয়ে ফেলে, তল্পিদার তড়াক করে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে দরজা খুলে দেখে যে, বাবাজীর প্রেমোন্মত্ত হয়ে চৎকার করে গান ধরেচেন। রাস্তার ধারে পাহারাওয়ালারা তামাক খেতে খেতে ঢুলতেছিল, গাড়ীর ভেতরের বেতরে আওয়াজে চমকে উঠে কলকে ফেলে দৌড়ে গাড়ীর কাছে উপস্থিত হলো; দোকানদারেরা দোকান থেকে গলা বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো কিন্তু বাবাজীরা প্রভুপ্রেমগানে এমনি মেতে গিয়েছেন যে, তখনো তান মারা থামে নি। শেষে সহসা গাড়ী থামায় ও লোকের গোলে চৈতন্য হলো ও পাহারাওয়ালাকে দেখে কিঞ্চিং অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সেই সময় ব্লাস্তা দিয়ে একটা নগদ মুটে ঝাঁকি। কাঁধে করে বেকার চলে যাচ্চিল, এই ব্যাপার দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে ‘পুঙ্গির ভাই গাড়িমদ্দি ক্যালাবতী লাগাইচেন’ বলে চলে গেল। পাহারাওয়ালাকে কল্কে পরিত্যাগ করে আসতে হয়েছিল বলে সেও বাবাজীদের বিচক্ষণ লাঞ্ছনা করে পুনরায় দোকানে গিয়ে বসলো; রেলওয়ে ব্যাগ হাতে একজন সহুরে বাবু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত গাড়ীর অপেক্ষায় এক দোকানে বসেছিলে, বৃষ্টিতে তার রেলওয়ে টমিসে উপস্থিত হবার বিলক্ষণ ব্যাঘাত কতেছিল, এক্ষণে বাবাদের গাড়োয়ানের সঙ্গে ঐ অবকাশে ভাড়া-চুক্তি করে, হুড়মুড় করে গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়লেন! এদিকে গাড়োয়ানও গাড়ী হাঁকিয়ে দিলে। তল্পিদার খানিক দৌড়ে দৌড়ে শেষে গাড়ীর পিছনে উঠে পড়লে।