হুজুর অনেক কষ্টেসৃষ্টে বেড়ার দ্বার পার হয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে বানরের দলে মিশলেন। রণক্ষেত্রের অন্যদিকে লঙ্কা। মনে করুন, সেথায় সাজা রাক্ষসেরা ঘুরে বেড়াচ্চে ও বেড়ার নিকটস্থ মালা গাড়ীর দিকে মুখ নেড়ে হিঁ হিঁ করে ভয় দেখাচ্ছে। সাজা বানরেরা লাফাচ্ছে ও গাছপাথরের বদলে ছেঁড়াকুঁপো ও পাকাটি নিয়ে ছোঁড়াছুড়ি কচ্চে। বাবু এই সকল অদৃষ্টচর ব্যাপার দেখে যার পর নাই পরিতুষ্ট হয়ে বেড়ার পাশে পাশে হাঁ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন; আরো দু-চার জন বেণে বড়মানুষ ও ব্যাদড়ী বনেদীবাবুরা ভিতরে এসে বাবুর সঙ্গে জুটে গেলেন। মধ্যে মধ্যে দালাল ও তুলোওয়ালা ইনফুলুয়েনশল রিফর্মড খোট্টার দলের সঙ্গেও বাবুর সেখানে সাক্ষাৎ হতে লাগলো। কেউ ‘রাম রাম’ কেউ ‘আদাব’ কেউ ‘বন্দীগি’ প্রভৃতি সেলীমাল্কির সঙ্গে পানের দোনা উপহার দিয়ে, বাবুর অভ্যর্থনা কত্তে লাগলো; এঁরা অনেকে দুই প্রহরের সময়ে এসেছেন, রাত্রি দশটার পর ভরপেট রামলীলে গিলে বাড়ী ফিরবেন।
রণক্ষেত্রের মধ্যে বাবু ও দু-চার সবস্স্ক্রাইবর বড়মানুষের ছেলেদের বেড়াতে দেখে, ম্যানেজার বা তার আসিষ্টেট দৌড়ে নিকটস্থ হয়ে, পানের দোনা উপহার দিয়ে রণক্ষেত্রের মধ্যস্থ দু-চার কাগজের সঙের তরজমা করে বোঝাতে লাগলেন। কত গাড়ী ও আন্দাজ কত লোক এসেছে, তার একটা মনগড়া মিমো করে দিলেন ও প্রত্যেক বানর ভালুক ও রাক্ষসের সাজগোজের প্রশংসা কত্তেও বিস্মৃত হলেন না। বাবু ও অন্যান্য সকলে “এ দফে বড়ি আচ্ছা হুয়া, আর বরস্ এসি নেহি হুয়া থা” প্রভৃতি কমপ্লিমেণ্ট দিয়ে ম্যানেজারদের আপ্যায়িত কত্তে লাগলেন। এ দিকে বাজীতে আগুন দেওয়া আরম্ভ হলো, ক্রমে চার পাঁচ রকম বাজে কেতার বাজি পুড়ে সেদিন রামলীলা বরখাস্ত হলো। রাম-লক্ষণকে আরতি করে ও ফুলের মালা দিয়ে প্রণাম করে, বাজে লোকেরা জন্ম সফল বিবেচনা করে ঘরমুখো হলো। কেরাঞ্চীর ঘোড়ারা বাতকৰ্ম্ম কত্তে কত্তে বহু কষ্টে গাড়ী নিয়ে প্রস্থান কল্লে। বাবু সেই ভিড়ের ভিতর হতে অতিকষ্টে গাড়ী চিনে নিয়ে সওয়ার হলেন–সেদিনের রামলীলা এই রকমে উপসংহার হলো।
আমাদের এ সকল বিষয়ে বড় সখ, সুতরাং আমরাও একখানি ছ্যাক্ড়াগাড়ীর পিছনে বসে, রামলীলা দেখতে যাচ্চিলাম। গাড়ীখানির ভিতরে একজন ছুতোরবাবু গুটি দুই গেরম্বারী মেয়েমানুষ ও তাঁয় চার পাঁচ জন দোস্ত ছিল; খানিক দূরে যেতে না যেতেই একটা জন্মজেঠা ফচ্কে ছোঁড়া রাস্তা থেকে “গাড়োয়ান পিছু ভারি। গাড়োয়ান পিছু ভারি।” বলে চেঁচিয়ে ওঠায় গাড়োয়ান্ “কে রে শালা।” বলে সপাৎ করে এক চাবুক ঝাড়লে। ভিতর থেকে ‘আরে কে রে, ল্যে বে যাঁ, ল্যে বে যা, চৎকার হতে লাগলো। অগত্যা সেদিন আর যাওয়া হলো না; মনের সখ মনেই রইলো।
শরতের শশধর স্বচ্ছ শ্যামগগনমাঝে নক্ষত্রসমাজে বিরাজ কচ্চেন দেখে, প্রণয়িনী বৃী মনভরে অবগুণ্ঠনবতী হয়ে রয়েছেন। চক্ৰবাদম্পতী কত প্রকার সাধ্যসাধনা কচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে, সপত্নার দুর্দশা দর্শন করে স্বচ্ছ সলিলে কুমুদিনী হাসচে। চাঁদের চির অনুগত চকোর-চকোরী শর্বরীর দুঃখে ঐধিত হয়ে তারে তুড়ে ভৎসনা কচ্চে, ঝিঁঝিপোকা উইচিংড়ারাও চীৎকার করে চকোর-চকোরীর সঙ্গে যোগ দিতেছে; লম্পটশিরোমণির ব্যবহার দেখে প্রকৃতি সতী বিস্মিত হয়ে রয়েছেন; এ সময়ে নিকটস্থ রজনীরঞ্জন বড় অপ্রস্তুত হবেন বলেই যেন পবন বড় বড় গাছতলায় ও ঝোপ-ঝাপের আশে পাশে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলেচেন। অভিমানিনী মানবতী রজনীর বিন্দু বিন্দু নয়নজল শিশিরচ্ছলে বনরাজী ও ফুলদামে অভিষিক্ত কচ্চে।
এদিকে বাবুর ব্রিজকা ও বিলাতী জুড়ি টপাপট শব্দে রাস্তা কাঁপয়ে ভদ্রাসনে পৌঁছিল। বাবু ড্রেসিংরুমে কাপড় ছাড়তে গেলেন, সহচরেরা বৈঠকখানায় বসে তামাক খেতে খেতে রামলীলার জাওর কাটতে লাগলেন এবং সকলে মিলে প্রাণ খুলে দু-চার অপর বড়মানুষের নিন্দাবাদ জুড়ে দিলেন। বাবুও কিছু পরে কাপড় চোপড় ছেড়ে মজলিসে বার দিলেন; গুডুম করে নটার তোপ পড়ে গেল।
বোধ হয়, মহিমার্ণব পাঠকবর্গের স্মরণ থাকূতে পারে যে, বাবু রামভদ্দর হুজুরের সঙ্গে রামলীলা দেখতে গিয়েছিলেন। বর্ত্তমানে দু চার বাজে কথার পর বাবু রামভদ্দরবাবুকে দু একটা টপ্পা গাইতে অনুরোধ কল্লেন; রামভদ্দর বাবুর গান বাজনায় বিলক্ষণ সখ, গলাখানিও বড় চমৎকার! যদিও তিনি এ বিষয়ে পেশাদার নন, তথাপি সহরের বড়মানুষমহলে ঐ গুণেই পরিচিত। বিশেষতঃ বাবু রামভদ্দরের আজকাল সময় ভাল, কোম্পানীর কাগজের দালালী ও গাঁতের মাল কেনার দরুণ দশটাকা রোজগার কোচ্ছেন; বাড়ীর নিত্যনৈমিত্তিক দোল-দুর্গোৎসবও ফাঁক যায় না। বাপ-মার শ্রাদ্ধ ও ছেলে মেয়ের বিয়ের সময়ে দশজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত বলা আছে। গ্রামস্থ সমস্ত ব্রাহ্মণ প্রায় বাবুর দল, কায়স্থ ও নবশাক ও অনেকগুলি বাবুর অনুগত। কৰ্ম্মকাজের ভিডের দরুণ ভদ্দরবাবুর বারোমাস প্রায় সহরেই বাস; কেবল মধ্যে মধ্যে পাল-পার্ব্বণ ও ছুটিটা আসটায় বাড়ী যাওয়া আছে। ভদ্দরবাবুর সহরের বাদুড়বাগানের বাসাতেও অনেকগুলি ভদ্দরলোকের ছেলেকে অন্ন দেওয়া আছে ও দুচার জন বড়মানুষেও ভদ্দরবাবুরে বিলক্ষণ স্নেহ করে থাকেন। রামভদ্দরবাবু সিমলের রায়বাহাদুরের সোণার কাটি রূপোর কাটি ছিলেন ও অন্যান্য অনেক বড়মানুষেই এঁরে যথেষ্ট স্নেহ করে থাকেন। সুতরাং বাবু অনুরোধ করবামাত্র ভদ্দরবাবু। তানপুরা মিলিয়ে একটি নিজরচিত গান জুড়ে দিলেন, হলধর তবলা-বাঁয়া ঠুকে নিয়ে বোলওয়াট ও ফ্যালওয়াটের সঙ্গে সঙ্গত আরম্ভ কলেন। রামলীলার নক্সা এইখানেই ফুরালো।
২.৪ রেলওয়ে
দুর্গোৎসবের ছুটীতে হাওড়া হতে এলাহাবাদ পর্য্যন্ত রেলওয়ে খুলেছে; রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল কাল অক্ষরে ছাপানো ইংরাজী বাঙ্গালায় এস্তাহার মারা গেছে। অনেকেই আমোদ করে বেড়াতে যাচ্চেন-তীর্থযাত্রীও বিস্তর। শ্ৰীপাট নিমতলার প্রেমানন্দ দাস বাবাজীও এই অকাশে বারাণসী দর্শন কত্তে কৃতসঙ্কল্প হয়েছিলেন। প্রেমানন্দ বাবাজী শ্রীপাট জোড়াসাঁকোর প্রধান মঠের একজন কেষ্টবিষ্ণুর মধ্যে; বাবাজীর অনেক শিষ্য-সেবক ও বিষয়-আশয়ও প্রচুর ছিল; বাবাজীর শরীর স্কুল ভুঁড়িটি বড় তাকিয়ার মত প্রকাণ্ড; হাত পাগুলিও তদনুরূপ মাংসল ও মেদময়। বাবাজীর বর্ণ কষ্টিপাথরের মত, হুঁকোর খোলের মত ও ধানসিদ্ধ হাঁড়ির মত কুচকুচে কালো। মস্তক কেশহীন করে কামান, মধ্যস্থলে লম্বাচুলের চৈতন্যচুটকি সর্ব্বদা খোঁপার মত বাঁধা থাকতো; বাবাজী বহুকাল কচ্ছ দিয়ে কাপড় পরা পরিহার করেছিলেন, সুতরাং কৌপীনের উপর নানারঙ্গের বহির্বাস ব্যবহার কভেন। সর্ব্বদা সর্ব্বাঙ্গে গোপীমৃত্তিকা মাখা ছিল ও গলায় পদ্মবীচি তুলসী প্রভৃতি নানা প্রকার মালা সৰ্ব্বদা পরে থাকত্তেন। তাতে একটি লাল বাতের বড় বালিসের মত জপমালার থলি পিতলের কড়ায় আবক্ষ ঝুলতে।