এ দিকে টুং টাং টুং করে মেকাবী ক্লকে পাঁচটা বাজলো, ‘হুজুর গাড়ী হাজির’ বলে হরকরা হুজুরে প্রোক্লেম কল্লে। বাবু মোসাহেবদের সঙ্গে নিয়ে গাড়ীতে উঠলেন—বিলাতী জুড়ি কৌচম্যানের ইঙ্গিতে টপাটপ টপাটপ শব্দে রাস্তা কাঁপিয়ে বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এ দিকে চাকরের ‘রাম বাঁচলুম’ বলে কেউ বাবুর মচলন্দে গড়িয়ে পড়লো, কেউ হুজুরের সোনাবাঁধান হুঁকোটা টেনে দেখতে লাগলো–অনেকে বাবুর ব্যবহারের কাপড়চোপড় পরে বেড়াতে বেরুলো; সহরের অনেক বড় মানুষের বাড়ী বাবুদের সাক্ষাতে বড় আঁটাআঁটী থাকে, কিন্তু তাঁদের অসাক্ষাতে বাড়ীর অনেক ভাগ উদোম এলো হয়ে পড়ে।
ক্রমে বাবুর ব্রিজকা চিৎপুর রোডে এসে পড়লো। চিৎপুর রোডে আজ গাড়ী-ঘোড়ার অসম্ভব ভিড়। মাড়ওয়ারী, খোট্টা ও বেশ্যারা খাতায় খাতায় ছক্কড় ও কেরাঞ্চীতে রামলীলা দেখতে চলেচে। যাঁরা যোত্রহীন, তাঁরাও সখের অনুরোধ এড়াতে না পেরে, হেঁটেই চলেচেন, কলকেতা সহরের এই একটি আজব গুণ যে, মজুর হতে লক্ষপতি পৰ্য্যন্ত সকলের মনে সমান সখ। বড় লোকেরা দানসাগরে যাহা নির্ব্বাহ করবেন, সামান্য লোকে ভিক্ষা বা চুরি পর্য্যন্ত স্বীকার করেও কায়ক্লেশে তিলকাঞ্চনে সেটির নকল কত্তে হবে।
আন্দাজ করুন, যেন, এ দিকে ছক্কড় ও বড় বড় গাড়ীর গতিতে রাস্তার ধূলে উড়িয়ে সহর অন্ধকার করে তুল্পে। সূৰ্যদেও সমস্ত দিন কমলিনীর সহবাসে কাটিয়ে পরিশ্রান্ত নাগরেব মত ক্লান্ত হয়ে শ্রান্তি দূর করবার জন্যই যেন অস্তাচল আশ্রয় কল্লেন; প্রিয়সথী প্রদোষরাণীর পিছে পিছে অভিসারিণী সন্ধ্যাবধূ ধীরে ধীরে সতিনী শৰ্বরীর অনুসরণে নির্গত হলেন; রহস্যজ্ঞ অন্ধকার সমস্ত দিন নিভৃতে লুকিয়ে ছিল, এখন পাখীদের সঙ্কেবাক্যে অবসর বুঝে ক্রমশঃ দিকসকল আচ্ছাদিত করে নিশানাথের নিমিত্ত অপূর্ব্ব বিহারস্থল প্রস্তুত কত্তে আরম্ভ কল্লে। এ দিকে বাবুর ব্রিজকা রামলীলার রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হলো। রামলীলার বঙ্গভূমি রাজাবাহাদুরের বাগানখানি পূৰ্ব্বে সহরের প্রধান ছিল, কিন্তু কুলপ্রদীপকুমারদের কল্যাণে আজকাল প্রকৃত চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছে। পূৰ্ব্বে রামলীলা ঐ রাজা বৰ্দিনাথ বাহাদুরের বাগানেতেই হতো; গত বৎসর হতে রহিত হয়ে রাজা নরসিংহ বাহাদুরের বাগানে আরম্ভ হয়েচে। নরসিংহ বাহাদুরের ফুলগাছের উপর যার পর নাই সখ ছিল এবং চিরকাল এই ফুলগাছের উপাসনা করেই কাটিয়ে গেছে; সুতরাং তার বাগান যে সহরের শ্রেষ্ঠ হবে, বড় বিচিত্র নয়? এমন কি, অনেকেই স্বীকার করেচেন যে, গাছের পারিপাট্যে রাজা বাহাদুরের বাগান কোম্পানীর বাগান হতে বড় খাট ছিল না; কিন্তু বর্ত্তমান কুমার বাহাদুর পিতার মৃত্যুর মাসেকের মধ্যে বাগানখানি অয়রান করে ফেল্লেন! বড় বড় গাছগুলি উবড়ে বিক্রি করা হলো, রাজা বাহাদুরের পুরাতন জুতো পর্য্যন্ত পড়ে রইলো না, যে প্রকারে হোক টাকা উপার্জন করাই কুমার বাহাদুরের মতে কৰ্তব্য কৰ্ম্ম। সুতরাং শেষে এই শ্রেষ্ঠ বাগান রামলীলার বঙ্গভূমি হয়ে উঠলো, ঘরে বাইরে বানর নাচতে লাগলো। সহরে সোয়োত উঠলো, এবার বদ্দিনাথের বদলে রাজা নরসিংহের বাগানের ‘রামলীলার।’ কিন্তু এবার গাড়ী-ঘোড়র টিকিট! রাজা বন্দিনাথের বাগানের রামলীলার সময়ে টিকিট বিক্রী করা পদ্ধতি ছিল না, রাজা বাহাদুর ও অপর বড়মানুষে বিলক্ষণ দুশ টাকা সাহায্য কত্তেন, তাতেই সমুদয় খরচ কুলিয়ে উঠতে। কিন্তু রাজা বদ্দিনাথ বৃদ্ধাবস্থায় দু-তিন বৎসর হলে দেহত্যাগ করায় রাজকুমার সুবুদ্ধি বাহাদুরের বাগানখানি ভাগ করে নিলেন—মধ্যে দেইজি পাঁচীল পড়লো; সুতরাং অন্য বড় মানুষেরাও রামলীলায় তাদৃশ উৎসাহই দেখালেন না, তাতেই এবার টিকিট করে কনক টাকা তোলা হয়। বলতে কি, কলিকাতা বড় চমৎকার সহর! অনেকেই রং-তামাসায় অপব্যয় কত্তে বিলক্ষণ অগ্রসর, টিকিট সত্ত্বেও রামলীলার বাগান গাড়ী-ঘোড়া ও জনতায় পরিপূর্ণ; লোকের বেজায় ভিড়!
এ দিকে বাবুর ব্রিজক জনতার জন্য অধিক দূর যেতে পাল্লে না, সুতরাং হুজুর দলবলসমেত পায়দলে বেড়ানই সঙ্গত ঠাউরে গাড়ী হতে নেবে বেড়াতে বেড়াতে বঙ্গভূমির শোভা দেখতে লাগলেন।
বঙ্গভূমির গেট হতে রামলীলার রণক্ষেত্র পর্য্যন্ত দুসারি দোকান বসেছে; মধ্যে মধ্যে নাগোরদোলা ঘুরচে-গোলাবি খিলি, খেলেনা, চানাচুর ও চিনের বাদাম প্রভৃতি ফিরিওয়ালাদের চীৎকার উঠছে; ইয়ারের দল খাতায় খাতায় প্যারেড করে বেড়াচ্চে; বেশ্যা, খোট্টা, বাজে লোক ও বেণের দলই বারো আনা। রণক্ষেত্রের চার দিকে বেড়ার ধারে চার পাঁচ থাক গাড়ীর সার; কোন গাড়ীর ওপর একজন সৌখীন ইয়ার দু-চার দোস্ত ও দুই একটি মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ কচ্চেন। কোনখানির ভিতরে চিনেকোট ও চুলের চেনওয়ালা চার জন ইয়ার ও একটি মেয়েমানুষ, কোনখানিতে গুটিকত পিলইয়ার টেক্কা জাঠা ইস্কুলের বই বেচে পয়সা সংগ্রহ করে গোলাবি থিলি ও চরসের মজা লুটচে। কতকগুলি গাড়ীতে নিছক খোট্টা মাড়োয়ারী ও মেড়ুঁয়াবাদী, ককগুলি খোসপোষাকী বাবুতে পূর্ণ।
আমাদের হুজুর এই সকল দেখতে দেখতে থন্নুমলবাবুর হাত ধরে ক্রমে রণক্ষেত্রের দরজায় এসে পৌঁছিলেন—সেথায় বেজায় ভিড়। দশ-বারোজন চৌকীদার অনবরত সপাসপ করে বেত মাচ্চে; দশ জন সার্জ্জন সবলে ঠেলে রয়েছে, তথাপি রাখতে পাচ্চে না, থেকে থেকে “রাজা রামচন্দ্রজীকা জয়!” বলে খোট্টার ও রণক্ষেত্রের মধ্য হতে বানরেরা চেঁচিয়ে উঠচে। সকলেরই ইচ্ছা, রামচন্দ্রের মনোহর রূপ দেখে চরিতার্থ হবে; কিন্তু কার সাধ্য, সহজে রামচন্দ্রের সমীপস্থ হয়।