যে দেশের লোকের যে কালে যে প্রকার হেম্মত থাকে, সে দেশে সে সময় সেই প্রকার কর্ম্মকাণ্ড, আমোদ-প্রমোদ ও কার-কারবার প্রচলিত হয়। দেশের লোকের মনই সমাজে লোকোমোটিবের মত, ব্যবহার কেবল ‘ওয়েদরকর্কের’ কাজ করে। দেখুন, আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা রঙ্গভূমি প্রস্তুত করে মল্লযুদ্ধে আমোদ প্রকাশ কত্তেন, নাটক ত্রোটকের অভিনয় দেখতেন, পরিশুদ্ধ সঙ্গীত ও সাহিত্যে উৎসাহ দিতেন; কিন্তু আজকাল আমরা বারোইয়ারিতলায়, নয় বাড়ীতে, বেদেনীর নাচ ও ‘মদন আগুনের তানে পরিতুষ্ট হচ্ছি; ছোট ছোট ছেলে ও মেয়েদের অনুরোধ উপলক্ষ করে পুতুল নাচ, পাঁচালী ও পচা খেউড়ে আনন্দ প্রকাশ কচ্চি, যাত্রাওয়ালাদের ‘ছকুবাবু ও সুন্দরের সং’ নাবাতে হুকুম দিচ্চি। মল্লযুদ্ধের তামাসা ‘দ্যাখ বুল বুল ফাইট’ ও ‘ম্যাড়ার লড়ায়ে’ পর্যবসিত হয়েচে। আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা পরস্পর লড়াই করেচেন, আজকাল আমরা সর্ব্বদাই পরস্পরের অসাক্ষাতে নিন্দাবাদ করে থাকি; শেষে একপক্ষের ‘খেউড়ে’ জিত ধরাই আছে।
আমাদের এই প্রকার অধঃপতন হবে না কেন? আমরা হামা দিতে আরম্ভ করেই ঝুমঝুমি, চুষী ও শোলার পাখীতে বর্ণপরিচয় করে থাকি। কিছু পরে ঘুড়ি, লাটিম, লুকোচুরি ও বৌ বৌ খেলাই আমাদের যুবত্বের এনট্রান্স-কোর্স হয়; শেখে তাস, পাশা ও বড়ে টিপে মাৎ করে ডিগ্রী নিয়ে বেরুই! সুতরাং ঐগুলি পুরাণে পড়ার মত কেবল চিরকাল আউড়ে আসতে হয়; বেশীর ভাগ বয়সের পরিণামেব সঙ্গে ক্রমশঃ কতকগুলি আনুসঙ্গিক উপসর্গ উপস্থিত হয়।
রামলীলা এদেশের পরব নয়, এটি প্রবল খোট্টাই! কিছুকাল পূর্ব্বে চীনকের সেপাইদের দ্বারা এই রামলীলার সূত্রপাত হয়; পূর্ব্বে তারাই আপনা-আপনি চাঁদা করে চীনকের মাঠে রাম-রাবণের যুদ্ধের অভিনয় কত্তো; কিছু দিন এ রকমে চলে, মধ্যে একেবারে রহিত হয়ে যায়। শেষে বড়বাজারের দু’ চার ধনী খোট্টার উদ্যোগে ১৭৫৭ শকে পুনর্ব্বার রামলীলার আরম্ভ হয়। তদবধি এই বার বৎসর রামলীলার মেলা চলে আসছে। কলকেতায় আর অন্য কোন মেলা নাই বলেই, অনেকে রামলীলায় উপস্থিত হন। এদের মধ্যে নিষ্কৰ্ম্মা বাবু, মাড়োয়ারী খোট্টা, বেশ্যা ও বেণেই অধিক।
পাঠকবর্গ মনে করুন, আপনাদের পাড়ার বনেদী বড়মানুষ ও দলপতি বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদির ওপর বার দিয়ে বসেছেন; গদির সামনে বড় বড় বাক্স ও আয়না পড়েছে, বাবুর প্রকাণ্ড আলবোলা প্রতি টানে শরতের মেঘের মত শব্দ কচ্ছে, আর মস্ক ও মূসব্বর মেশান ইরাণী তামাকের খোসবোয় বাড়ী মাত করেচে। গদির কিছু দূরে এক জন খোট্টা সিদ্ধির মাজুম, হজমীগুলি ও পালংতোড় প্রভৃতি ‘কুয়ৎ কি চিজ’ রুমালে বেঁধে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্ণৌয়ের এক জন সম্পন্ন জহুরীর পুত্র, এক্ষণে সহরেই বাস; হয়ত বছর কতক হলে আফিমের তেজমন্দি খেলায় সর্ব্বস্বান্ত হয়ে বাবুর অবশ্য-পোষ্য হয়েচেন। মনে করুন, তার অনেক প্রকার হাকিমী ঔষধ জানা আছে। সিদ্ধি সম্পর্কীয় মাজুমও তিনি উত্তম রকমে প্রস্তুত কত্তে পারেন। বিশেষতঃ বিস্তর বাই, কথক ও গানওয়ালীর সহিত পরিচয় থাকায়, আপন হেকমত ও হুনুরীতে আজকাল বাবুর দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠেছেন। এর পাশে ভবানীবাবু ও মিসুয়ার্স আর্টফুল ডজরস উকীল সাহেবের হেডকেরাণী হলধরবাবু। ভবানীবাবু ঐ অঞ্চলের একজন বিখ্যাত লোক, আদালতে ভারী মাইনের চাকরী করেন; এ সওয়ায় অন্তঃশিলে কোম্পানীর কাগজের দালালী, বড় বড় ব্রাজা-রাজড়ার আমমোক্তারী ও মকদ্দমার ম্যানেজারী করা আছে। এমন কি অনেকেই স্বীকার করে থাকেন যে, ভবানীবাবু ধড়িবাজিতে উমিচাঁদ হইতে সরেস ও বিষয়-কর্ম্মে জয়কৃষ্ণ হতে জব্বর। ভবানীবাবুর পার্শ্বস্থ হলধরও কম নন–মনে করুন, হলধর উকীলের বাড়ী মকদ্দমার তদ্বিরে ফের-ফন্দীতে ও জাল-জালিয়াতে প্রকৃত শুভঙ্কর। হলধরের মোচা গোঁফ, মুসকের মত ভুঁড়ি, হাতে ইষ্টিকবচ, কোমরে গোট ও মাদুলি, সরু ফিনফিনে সাদা ধুতি পরিধান, তার ভিতরে একটা কাচ, কপালে টাকার মত একটা রক্তচন্দনের টিপ ও দাঁতে মিসি;—চাদরটা তাল পাকিয়ে কাঁধে ফেলে অনবরত তামাক খাচ্চেন ও গোঁপে তা দিয়ে যেন বুদ্ধি পাকাচ্চেন। এমন সময়ে বাবুর এ মজলিসে ফলহরিবাবু ও রামভদ্দরবাবু উপস্থিত হলেন; ফুলহরি ও রামভদ্দরকে দেখে বাবু সাদরসম্ভাষণে বসালেন, হুঁক্কাবরদার তামাক দিয়ে গেল; বাবুরা শ্রান্তি দূর করে তামাক খেতে খেতে একথা সে কথার পর বল্লেন, “মশাই, আজ রামলীলার ধূম! আজ শুনলেম লক্ষ্মণের শক্তিশেল হবে, বিস্তর বাজী পুড়বে, এখানে আসবার সময়ে দেখলেম, ও পাড়াদ রামবাবুর চৌঘুড়ী গেল। শম্ভুবাবু বগীতে লক্ষ্মীকে নিয়ে যাচ্চেন–আজ বেজায় ভিড়। মশাই যাবেন না?” তখনি ‘ভবানীবাবু’ এই প্রস্তাবের পোষকতা কল্লেন—বাবুও রাজী হলেন—অমনি ‘ওরে! ওরে কোই হ্যায়রে! কোই হ্যায়!’ শব্দ পড়ে গেল আশেপাশে, ‘খোদাবন্দ’ ও ‘আচ্চা যাইয়ে’ প্রতিধ্বনি হতে লাগলো–হরকরাকে হুকুম হলো, বড় ব্রিজকা ও বিলাতি জুড়ি তইরি কত্তে বল শীগগির।
ঠাওরাণ, যেন এ দিকে বাবর ব্রিজকা প্রস্তুত হতে লাগলো, পেয়ারের আদালীরা পাগড়ী ও তকমা পরে আয়নার মুখ দেখচে। বাবু ড্রেসিং রুমে ঢুকে পোষাক পচ্চেন। চার-পাঁচ জন চাকরে পড়ে চল্লিশ রকম প্যাটার্নের ট্যাসিলদেওয়া টুপী, সাটীনের চাপকান, পায়জামা বাছুনি কচ্চে। কোনটা পল্লে বড় ভাল দেখাবে, বাবু মনে মনে এই ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হচ্চেন, হয় ত একটা জামা পরে আবার খুলে ফেল্লেন। একটা টুপী মাথায় দিয়ে আয়নায় মুখ দেখে মনে ধচ্চে না; আবার আর একটা মাথায় দেওয়া হচ্ছে, সেটাও বড় ভাল মানাচ্ছে না। এই অবকাশে একজন মোসাহেবকে জিজ্ঞাসা কচ্চেন, ‘কেমন হে! এটা কি মাথায় দেবো?’ মোসাহেব সব দিক বজায় রেখে, ‘আজ্ঞে পোষাক পল্লে আপনাকে যেমন খোলে, শহরের কোন শালাকে এমন খোলে না’ বল্চেন; বাবু এই অবসরে আর একটা টুপী মাথায় নিয়ে জিজ্ঞাসা কচ্চেন ‘এটা কেমন?’ মোসাহেব ‘আজ্ঞে এমন আর কারো নাই’ বলে বাবুর গৌরব বাড়াচ্চেন ও মধ্যে মধ্যে ‘আপ রুচি খানা ও পর রুচি পিন্না’ বয়েদটা নজীর কচ্চেন। এই প্রকার অনেক তর্কবিতর্ক ও বিবেচনার পর হয়ত একটা বেয়াড়া রকমের পোষাক পরে, শেষে পমেটম ল্যাভেণ্ডার ও আতর মেখে, অংটী চেন ও ইষ্টিক বেচে নিয়ে, দু ঘণ্টার পর বাবু ড্রেসিংরুম হতে বৈঠক খানায় বার হলেন। হলধর, ভবানী, বমিভদ্দর প্রভৃতি বৈঠকখানাস্থ সকলেই আপনাদের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলেই যেন ‘আজ্ঞে পোষাকে আপনাকে বড় খুলেচে’ বলে নানাপ্রকার প্রশংসা কত্তে লাগলেন; কেউ বল্লেন, হুজুর। এ কি গিদ্সনের বাড়ীর তইরি না?’ কেউ ঘড়ির চেন, কেউ আংটী ও ইষ্টিকের অনিয়ত প্রশংসা কত্তে আরম্ভ কল্লেন। মোসাহেবের মধ্যে যাঁহাদের কাপড়-চোপড়গুলি বাবুর ব্রিজকা ও বিলাতী জুড়ির যোগ্য নয়, তারা বাবুর প্রসাদি কাপড় চোপড় পরে কানে আতরের তুলল গুঁজে চেহারা খুলে নিলেন; প্রসাদি কাপড়-চোপড় পরে মোসাহেবদের আর আহ্লাদের সীমা রইলো না। মনে হতে লাগলো, বাড়ীর কাছের উঠনোওয়ালা মুদি মাগী ও চেনা লোকেরা যেন দেখতে পায় আমি কেমন পোষাকে হুজুরের সঙ্গে বেড়াচ্ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, অনেক মোসাহেব সৰ্ব্বদাই আক্ষেপ করে থাকেন, তারা যখন বাবুদের সঙ্গে বড় বড় গাড়ী ও ভাল কাপড়-চোপড় পরে বেড়ান, তখন কেউ তাঁদের দেখতে পান না, আর গামচা কাঁদে করে বাজার কত্তে কেরুলেই সকলের নজরে পড়েন।