আজ অমুকের গাজনতলায় চিৎপুরের হর; ওদের মাঠে সিঙ্গির বাগানের পালা; ওদের পাড়ার মেয়ে পাঁচালী। আজ সহরের গাজনতলায় ভারী ধূম-চৌমাথার চৌকীদারদের পোহাবারো। মদের দোকান খোলা না থাকলেও সমস্ত রাত্তির মদ বিক্রী হবে, গাজা অনবরত উড়বে, কেবল কাল সকালে শুবেন যে-“ঘোষেরা পাতকোতলার বড় পেতলের ঘটীটি পাচ্ছে না,” “পালেদের একধামা পেতলের বাসন গেছে” ও “গন্ধবেণেদের সর্ব্বনাশ হয়েছে।” আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়—থেকে থেকে কেবল ঢাকের বাদ্যি, সন্ন্যাসীর হররা ও “বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চীৎকার।
এ দিকে গির্জ্জার ঘড়িতে টুং টাং ঢং টুং টাং ঢং করে রাত চারটে বেজে গেল–বারফটকা বাবুরা ঘরমুখো হয়েচে। উড়ে বামুনেরা ময়দার দোকানে ময়দা পিষতে আরম্ভ করেছে। রাস্তার অলোর আর তত তেজ নেই। ফুরফুরে হাওয়া উঠেছে। বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার কোকিলেরা ডাকতে আরম্ভ করেছে; দু’ এক কাকের ডাক, কোকিলের আওয়াজ ও রাস্তার বেকার কুকুরগুলোর খেউ ঘেউ রব শোনা যাচ্চে, এখনও মহানগর যেন নিস্তব্ধ ও লোকশূন্য। ক্রমে দেখুন,–“রামের মা চলতে পারে না,” “ওদের ন-বউটা কি বজ্জাত মা” “মাগী হেন জক্কী” প্রভৃতি নানা কথার আন্দোলনে রত দুই এক দল মেয়েমানুষ গঙ্গাস্নান কত্তে বেরিয়েছেন। চিংপুরের কসাইরা মটনচাপের তার নিয়ে চলেছে। পুলিসের সার্জ্জন, দারোগা জমাদার প্রভৃতি গরীবের যমরা রোঁদ সেরে মস্ মস্ করে থানায় ফিরে যাচ্ছেন।
গুড়ুম করে তোপ পড়ে গেল! কাকগুলো কা কা করে বাসা ছেড়ে ওড়বার উজ্জুগ কল্লে। দোকানীরা দোকানের ঝাঁপতাড়া খুলে গন্ধেশ্বরীকে প্রণাম করে, দোকানে গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে, হু কার জল ফিরিয়ে তামকি খাবার উজ্জ্বল কচ্চে। ক্রমে ফরসা হয়ে এলো–মাছের ভারীরা দৌড়ে আসতে লেগেচে–মেছুনীরা ঝগড়া কত্তে কত্তে তার পেছু পেছু দৌড়েচে। বদ্দিবাটির আলু, হাসমানের বেগুন বাজরা বাজরা অসচে, দিশী বিলিতী যমেরা অবস্থা ও রেস্তমত গাড়ী পাল্কী চড়ে ভিজিটে বেরিয়েছেন। জ্বরবিকার, ওলাউঠার প্রাদুর্ভাব না পড়লে এদের মুখে হাসি দেখা যায় না। উলো অঞ্চলে মড়ক হওয়াতে অনেক গো-দাগাও বিলক্ষণ সঙ্গতি করে নেছেন; কলিকাতা সহরেও দু-চার গো-দাগাকে প্রাকটিস কত্তে দেখা যায়, এদের অষুধ চমৎকার; কেউ বলদের মত রোগীর নাক ফুঁড়ে আরাম করে; কেউ শুদ্ধ জল খাইয়ে সারেন। শহুরে কবিরাজেরা আবার এঁদের হতে এককাটি সরেশ; সকল রকম রোগেই সদ্য মৃত্যুশর ব্যবস্থা করে থাকেন–অনেকে চাণক্য-শ্লোক ও দাতাকর্ণের পুঁথি পড়েই চিকিৎসা আরম্ভ করেছেন।
টুলো পূজুরি ভটচাজ্জিরে কাপড় বগলে করে স্নান কত্তে চলেচে; আজ তাদের বড় ত্বরা, যজমানের বাড়ী সকাল সকাল যেতে হবে। আদবুড়ো বেতোরা মর্ণিং-ওয়াকে বেরিয়েছেন। উড়ে বেহারারা দাঁতন হাতে করে স্নান কওে দৌড়েচে। ইংলিশম্যান, হরকরা, ফিনিক্স এক্সচেঞ্জ গেজেট, গ্রাহকদের দরজায় উপস্থিত হয়েছে। হরিণমাংসের মত কোন কোন বাঙ্গালা খবরের কাগজ বাসি না হলে গ্রাহকেরা পান না—ইংরাজী কাগজের সে রকম নয়, গরম গরম ব্রেকফাষ্টের সময় গরম গরম কাগজ পড়াই আবশ্যক। ক্রমে সূৰ্য্য উদয় হলেন।
সেক্সন্-লেখা কেরাণীর মত কলুর ঘানির বলদ বদলী হলো; পাগড়ীবাঁধা দলের প্রথম ইনষ্টলমেন্টে—শিপ-সরকার ও বুকিং ক্লার্ক দেখা দিলেন। কিছু পরেই পরামাণিক ও রিপুকৰ্ম্ম বেরুলেন। আজ গবর্ণমেন্টের অফিস বন্ধ; সুতরাং আমরা ক্লার্ক কেরাণী, বুককিপার ও হেড রাইটারদিগকে দেখতে পেলাম না। আজকাল ইংরাজী লেখাপড়ার আধিক্যে অনেকে নানা রকম বেশ ধরে অফিসে যান- পাগড়ী প্রায় উঠে গেল—দুই এক জন সেকেলে কেরাণীই চিরপরিচিত পাগড়ীর মান রেখেচেন; তারা পেন্সন নিলেই আমরা আর কুঠিওয়ালা বাবুদের মাথায় পাগড়ী দেখতে পাব না; পাগড়ী মাথায় দিলে, আলবার্ট-ফেশনের বাঁকা সিঁথেটি ঢাকা পড়ে, এই এক প্রধান দোষ। রিপুকৰ্ম্ম ও পরামাণিকদের পাগড়ী প্রায় থাকে না থাকে হয়েছে।
দালালের কখনই অব্যাহতি নাই। দালাল সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে। হাতে কাজ কিছু নাই, অথচ যে রকমে হোক না, চোটাখোর বেণের ঘরে ও টাকাওয়ালা বাবুদের বাড়ীতে একবার যেতেই হবে। “কার বাড়ী বিক্রী হবে,” “কার বাগানের দরকার,” “কে টাকা ধার করবে,” তারই খবর রাখা দালালের প্রধান কাজ, অনেক চোটাখোর বেণে ও ব্যাভার-বেণে সহুরে বাবু দালাল চাকর রেখে থাকেন; দালালেরা শীকার ধরে আনে—বাবুরা আড়ে গেলেন!
দালালী কাজটা ভাল, “নেপো মারে দইয়ের মতন” এতে বিলক্ষণ গুড় আছে। অনেক ভদ্রলোকের ছেলেকে গাড়ী-ঘোড়ায় চড়ে দালালী কত্তে দেখা যায়। অনেকে “রেস্তহীন মূচ্ছুদি” চার বার “ইন্সলভেট” নিয়ে এখন দালালী ধরেছেন। অনেক পদ্মলোচন দালালীর দৌলতে “কলগেছে থাম” ফেঁদে ফেল্লেন। এরা বর্ণচোরা আঁব, এঁদের চেনা ভার, না পারেন, হেন কর্ম্মই নাই। পেশাদার চোটাখোর বেণে–ও ব্যাভার-বেণে বড়মানুষের ছলনারূপ নদীতে বেঁউতি-জলি পাতা থাকে; দালাল বিশ্বাসের কলসী ধরে গা ভাসান দে জল তাড়া দেন; সুতরাং মনের মত কোটাল হলে চুনোপুঁটিও এড়ায় না।
ক্রুমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গেল। সহরে কাণ পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সূতো, শোণ, সাপ, ছিপ, বাঁশ, ফুঁড়ে, একেবারে মোরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালঘাট থেকে আসছে। বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা ইয়ারগোচর ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ; সখের দলের পাঁচালী ও হাপ-আখড়াইয়ের দোহার, গুল্গার্ডেনের মেম্বই অধিক— এঁরা গাজন দেখবার জন্য ভোরের বেলা এসে জমেছেন।