এই প্রকার সপ্তমী, অষ্টমী ও সন্ধিপূজো কেটে গেল; আজ নবমী, আজ পূজোর শেষ দিন। এত দিন লোকের মনে যে আহ্লাদটি জোয়ারের জলের মত বাড়তেছিল, আজ সেইটির একেবারে সারভাটা।
আজ কোথাও ঘোড়া মোষ, কোথাও নব্বইটা পাঁটা, সুপারি আখ, কুমড়ো, মাগুরমাছ ও মরীচ বলিদান হয়েচে; কর্ম্মকর্ত্তা পাত্র টেনে পাঁচোইয়ারে জুটে নবমী গাচ্চেন ও কাদামাটী কচ্চেন; ঢুলীর ঢেলে সঙ্গত হচ্ছে, উঠানে লোকারণ্য, উপর থেকে বাড়ীর মেয়েরা উঁকি মেরে নবমী দেখছেন। কোথাও হোমের ধুমে বাড়ী অন্ধকার হয়ে গেছে; কার সাধ্য প্রবেশ করে-কাঙ্গালী, রেয়োভাট ও ভিক্ষুকের পূজোবাড়ী ঢোকা দূরে থাকুক, দরজা হতে মশাগুলো পর্য্যন্ত ফিরে যাচ্চে। ক্রমে দেখতে দেখতে দিনমণি অস্ত গ্যালেন, পূজোর আমোদ প্রায় সম্বৎসরের মত ফুরালো! ভোরাও ওক্তে ভয়রো রাগিণীতে অনেক বাড়ীতে বিজ্ঞয়া গাওনা হলো; ভক্তের চক্ষে ভগবতীর প্রতিমা পরদিন প্রাতে মলিন মলিন বোধ হতে লাগলো, শেষে বিসর্জ্জনের সমারোহ শুরু হলো—আজ নিরঞ্জন।
ক্রমে দেখতে দেখতে দশটা বেজে গেল; দইকড়মা ভোগ দিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলো; আরতির পর বিসর্জ্জনের বাজনা বেজে উঠলো। বামুনবাড়ীর প্রতিমারা সকলেই জলসই। বড়মানুষ ও বাজে জাতির প্রতিমা পুলিসের পাশ মত বাজনা বাদ্দির সঙ্গে বিলৰ্জন হবেন—এ দিকে এ কাজে সে কাজে গির্জ্জার ঘড়ীতে টুং টাং টুং টাং করে বারটা বেজে গেল; সূর্য্যের মৃদুতপ্ত উত্তাপে সহর নিমকি রকম গরম হয়ে উঠলো; এলোমেলো হাওয়ায় রাস্তার ধুলো ও কাঁকর উড়ে অন্ধকার করে তুল্লে। বেকার কুকুরগুলো–দোকানের পাটাতনের নীচে ও খানার ধারে শুয়ে জীব বাহির করে হাঁপাচ্চে, বোঝাই গাড়ীর গরুগুলোর মুখ দে ফ্যানা পড়চে-গাড়োয়ান ভয়ানক চীৎকারে “শালার গরু চলে না” বলে ন্যাজ মোলচে ও পাচলবাড়ি মাচ্চে; কিন্তু গরুর চাল বেগড়াচ্চে না, বোঝাইয়ের ভরে চাকাগুলি কোঁ কোঁ শব্দে রাস্তা মাতিয়ে চলেছে। চড়াই ও কাকগুলো বারান্দা আলম্বে ও নলের নীচে চক্ষু মুদে বসে আছে। ফিরিওয়ালারা ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্চে; রিপুকৰ্ম্ম ও পরামাণিকেরা অনেকক্ষণ হলো ফিরেচে; আলু পটোল! ঘি চাই! ও তামাকওয়ালারা কিছুক্ষণ হলো ফিরে গেছে। ঘোল চাই! মাখন চাই! ভয়সা দই চাই! ও মালাই-দইওয়ালারা কড়ি ও পয়সা গুণতে গুণতে ফিরে যাচ্চে। এখন কেবল মধ্যে মধ্যে পানিফল! কাগোজ বদল! পেয়ালা পিরিচ! ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্চে–নৈবিদ্দি-মাথায় পূজোবাড়ীর লোক, পুজুরী বামুন, পটো বাজন্দার ভিন্ন রাস্তায় বাজে লোক নাই, গুপুস করে একটার তোপ পড়ে গেল। ক্রমে অনেক স্থলে ধুমধামে বিসর্জ্জনের উদযোগ হতে লাগলো।
হায়! পৌত্তলিকতা কি শুভ দিনেই এ স্থলে পদার্পণ করেছিল। এতে দেখে শুনে, মনে স্থির জেনেও আমরা তারে পরিত্যাগ কত্তে কত কষ্ট ও অসুবিধা বোধ কচ্চি; ছেলেবেলা যে পুতুল নিয়ে খেলাঘর পেতেছি, বৌ বৌ খেলেছি ও ছেলে-মেয়ের বে দিয়েছি, আবার বড় হয়ে সেই পুতুলকে পরমেশ্বর বলে পুজো কচ্চি, তার পদার্পণে পুলকিত হচ্চি ও তার বিসর্জ্জনে শোকের সীমা থাকচে না–শুধু আমরা কেন, কত কত কৃতবিদ্য বাঙ্গালী সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও, হয় ত সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে, পুতুল পুজে আমোদ প্রকাশ করেন, বিসর্জ্জনের সময় কাঁদেন ও কাদা রক্ত মেখে কোলাকুলি করেন; কিন্তু নাস্তিকতায় নাম লিখিয়ে বনে বসে থাকাও ভাল, তবু “জগদীশ্বর একমাত্ৰ” এটি জেনে আবার পুতুলপূজায় আমোদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
ক্রমে সহরের বড় রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা আলাপীতে পূরে গেল; ইংরাজী বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সার্জ্জন সঙ্গে প্রতিমার রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন–তখন ‘কার প্রতিমা উত্তম’ ‘কার সাজ ভাল’ ‘কার সরঞ্জাম সরেস’ প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু হায়! ‘কার ভক্তি সরেস’ কেউ সে বিষয়ের অনুসন্ধান করে না–কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না! এদিকে প্রসন্নকুমার বাবুর ঘাট ভদ্দরলোক গোচের দর্শক, ক্ষুদে ক্ষুদে পোষাক পরা ছেলে, মেয়ে ও ইস্কুলবয়ে ভরেরে গেল। কর্ম্মকর্ত্তারা কেউ কেউ প্রতিমে নিয়ে বাচখেলিয়ে বেড়াতে লাগলেন—আমুদে মিনষেরা ও ছোঁড়ারা নৌকার ওপর ঢোলের সঙ্গতে নাচতে লাগলো, সৌখীন বাবুরা খ্যামটা ও বাই সঙ্গে করে বোট, পিনেস ও বজরার ছাতে বার দিয়ে বসলেন—মোসাহেব ও ওস্তাদ চাকরেরা কবির সুরে দু-একটা রংদার গান গাইতে লাগলো।
গান
“বিদায় হও মা ভগবতি। এ সহরে এসো নাকো আর।
দিনে দিনে কলিকাতার মর্ম্ম দেখি চমৎকার।।
জষ্টিসেরা ধৰ্ম্ম-অবতার, কায়মনে কচ্চেন সুবিচার।
এদিকে বুলোর তরে রাজপথেতে চেঁচিয়ে চেয়ে চলা ভার।।
পথে হাগা মোতা চলবে না, লহরের জল তুলতে মানা,
লাইসেন্সটেক্স মাথটচাঁদা, পাইখানায় বাসি ময়লা রবে না।
হেলথ অফিসর, সেতখানার মেজেষ্টর, ইনকমের আসেসর সাল্লে সবারে।
আবার গবর্ণরের গুয়ে দষ্টি, সৃষ্টিছাড়া ব্যবহার।
অসহ্য হতেছে মাগো! অসাধ্য বাস করা আর।।
এই জীয়ন্তে এই ত জ্বালা মাগো!—মলেও শান্তি পাবে না,
মুখাগ্নির দফা রফা কলেতে করবে সৎকার।
হুতোমদাস তাই সহর ছেড়ে আসমানে করেন বিহার॥”
এ দিকে দেখতে দেখতে দিনমণি যেন সম্বৎসরের পূজোর আমোদর সঙ্গে অস্ত গেল। সন্ধ্যাবধ বিচ্ছেদ-বসন পরিধান করে দেখা দিলেন। কর্ম্মকর্ত্তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকণ্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে ‘দাদা গো দিদি গো’ বাজনার সঙ্গে ঘট নিয়ে ঘরমুখো হলেন। বাড়ীতে পৌঁছে চণ্ডীমণ্ডপ পূর্ণঘটকে প্রণাম করে শান্তিজল নিলেন; পরে কাঁচাহলুদ ও ঘটজল খেয়ে পরস্পর কোলাকুলি কল্লেন। অবশেষে কলাপাতে দুর্গানাম লিখে সিদ্ধি খেয়ে বিজয়ার উপসংহার হলো। ক’দিন মহাসমারোহের পর আজ সহরটা খাঁ খাঁ কত্তে লাগলো—পৌত্তলিকের মন বড়ই উদাস হলো, কারণ, যখন লোকের সুখের দিন থাকে, তখন সেটির তত অনুভব কত্তে পারা যায় না, যত সেই সুখের মহিমা, দুঃখের দিনে বোঝা যায়।
২.৩ রামলীলা
দুর্গোৎসব এক বছরের মত ফুরুলো; ঢুলীরা নায়েক বাড়ী বিদেয় হয়ে শুঁড়ির দোকানে রং বাজাচ্চে। ভাড়াকরা ঝাড়েরা মুটের মাথায় বাঁশে ঝুলে টুনু টুনু শব্দে বালাখানায় ফিরে যাচ্চে; যজমেনে বামুনের বাড়ীর নৈবিদ্দির আলো-চাল ও পঞ্চশস্য শুকুচ্চে, ব্রাহ্মণী ছেলে কোলে করে কাটি নিয়ে কাগ তাড়াচ্ছেন। সহরটা থমথমে। বাসাড়েরা আজও বাড়ী হতে ফেরেন নি, অফিস ও ইস্কুল খোলবার আরও চার পাঁচ দিন বিলম্ব আছে।