ক্রমে দুর্গোৎসবের দিন সংক্ষেপ হয়ে পড়লো; কৃষ্ণনগরের কারিগরেরা কুমারটুলী ও সিদ্ধেশ্বরীতলা জুড়ে বসে গেল। জায়গায় জায়গায় রং-করা পাটের চুল, তবলকীর মালা, টীন ও পেতলের অসুরের ঢাল-তলওয়ার, নানারঙ্গের ছোবান প্রতিমার কাপড় ঝুলতে লাগলো; দর্জ্জিরা ছেলেদের টুপি, চাপকান ও পেটী নিয়ে দরোজায় দরজায় বেড়াচ্চে; ‘মধু চাই। শাঁকা নেবে গো!’ বোলে ফিরিওয়ালারা ডেকে ডেকে ঘুরছে। ঢাকাই ও শান্তিপুরে কাপুড়ে মহাজন, আতরওয়ালারা ও যাত্রার দালালেরা আহার-নিদ্রে পরিত্যাগ করেচে। কোনখানে কাঁসারীর দোকানে রাশীকৃত মধুপক্কের বাটী, চুমকী ঘটি ও পেতলের থালা ওজন হচ্ছে। ধূপ-ধুনো, বেণে মসলা ও মাখাঘষার একষ্ট্রা দোকান বসে গেছে। কাপড়ে মহাজনেরা দোকানে ডবল পর্দ্দা ফেলেচে; দোকানঘর অন্ধকারপ্রায়, তারি ভিতরে বসে যথার্থ ‘পাই-লাভে’ বউনি হচ্ছে। সিন্দুরচুপড়ী, মোমবাতি, পিঁড়ে ও কুশাসনের অবসর বুঝে দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে ‘অ্যাকুডক্টের’ উপর বার দিয়ে বসেচে। বাঙ্গাল ও পাড়াগেঁয়ে চাকরেরা আরসি, ঘুনসি, গিণ্টির গহনা ও বিলাতী মুক্তো একচেটেয় কিনচেন; রবরের জুতো, কনফরটার, ষ্টিক ও ন্যাজওয়ালা পাগড়ী অগুন্তি উঠচে; ঐ সঙ্গে বেলোয়ারি চুড়ী, আঙ্গিয়া, বিলাতী সোনার শীল আংটী ও চুলের গার্ডচেনেরও অসঙ্গত খদ্দের। এত দিন জুতোর দোকান ধূলো ও মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু পূজোর মোর্সমে বিয়ের কনের মত কেঁপে উঠছে, দোকানের কপাটে কাই দিয়ে নানা রকম রঙ্গিণ কাগজ মারা হয়েচে, ভিতরে চেয়ার পাতা, তার নীচে একটুকরা ছেঁড়া কারপেট। সহরে সকল দোকানেরই, শীতকালের কাগের মত চেহারা ফিরেছে। যত দিন ঘুনিয়ে আসছে, ততই বাজারের কেনা-বেচা বাড়চে; কলকেতা তত গরম হয়ে উঠছে। পল্লীগ্রামের টুলো অধ্যাপকেরা বৃত্তি ও বার্ষিক সাধতে বেরিয়েচেন; রাস্তায় রকম রকম তরবেতর চেহারার ভিড় লেগে গেছে।
কোনখানে খুন, কোনখানে দাঙ্গা, কোথায় সিঁধচুরি, কোনখানে ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়ের কাছ থেকে দু ভরি রূপো গাঁটকাঁটায় কেটে নিয়েছে; কোথাও কোন মাগীর নাক থেকে নথটা ছিঁড়ে নিয়েছে; পাহারাওয়ালারা শশব্যস্ত, পুলিস বদমাইস্ পোরা চোরেরা পূজোর মোর্সমে দেদার কারবার ফালাও কচ্চে। “লাগে তা না লাগে তুক্কো” “কিনি তে হাতী লুটি তো ভাণ্ডার” তাদের জপমন্ত্র হয়েচে; অনেকে পার্ব্বণের পূর্ব্বে শ্রীঘরে ও বাঙ্কুলে বসতি কচ্চে; কারো পুজোয় পাথরে পাঁচ কিল; কারো সৰ্ব্বনাশ। ক্রমে চতুর্থী এসে পড়লো।
এবার অমুক বাবুর নতুন বাড়ীতে পূজার ভারী ধূম! প্রতিপদাদিকল্পের পর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বিদায় আরম্ভ হয়েচে, আজও চোকে নাই—ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বাড়ী গিস্গিস্ কচ্চে। বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদীর উপর তসর কাপড় পরে বার দিয়ে বসেচেন, দক্ষিণে দেওয়ান টাকা ও সিকি আধুলির তোড়া নিয়ে খাতা খুলে বসেচেন, বামে হবীশ্বর ন্যায়ালঙ্কার সভাপণ্ডিত অনবরত নস্য নিচ্চেন ও নাসা-নিঃসৃত রঙ্গিণ কফজল জাজিমে পুঁচ্চেন। এদিকে জহুরী জড়ওয়া গহনার পুঁটুলী ও ঢাকাই মহাজন ঢাকাই শাড়ীর গাঁট নিয়ে বসেচে। মুন্সি মোশাই, জামাই ও ভাগনেবাবুরা ফর্দ্দ কচ্চেন, সামনে কতকগুলি প্ৰিতিমে-ফেলা দুর্গাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ, বাইয়ের দালাল, যাত্রার অধিকারী ও গাইয়ে ভিক্ষুক ‘যে আজ্ঞা’ ‘ধৰ্ম্ম অবতার’ প্রভৃতি প্রিয় বাক্যের উপহার দিচ্চেন; বাবু মধ্যে মধ্যে কীরেও এক আধটা আগমনী গাইবার ফরমান কচ্চেন। কেউ খোসগল্প ও অন্য বড়মানুষের নিন্দাবাদ করে বাবুর মনোরঞ্জনের উপক্রমণিকা কচ্চেন–আসল মতলব দ্বৈপায়ন হ্রদে রয়েচে, উপফুক্ত সময়ে তীরস্থ হবে। আতরওয়ালা, তামাকওয়ালা, দানাওয়ালা ও অন্যান্য পাওনাদার মহাজনেরা বাইরের বারাণ্ডায় ঘুরচে, পূজো যায় তথাচ তাদের হিসেব নিকেস হচ্ছে না। সভাপণ্ডিত মহাশয় সরপটে পিরিলীর বাড়ীর বিদেয় নেওয়া বিধবা-বিবাহের দলের এবং বিপক্ষপক্ষের ব্রাহ্মণদের নাম কাটচেন, অনেকে তার পা ছুঁয়ে দিব্বি গালচেন যে, তাঁরা পিরিলীর বাড়ী চেনেন না; বিধবা-বিয়ের সভায় যাওয়া চুলোয় যাক, গত বৎসর শয্যাগত ছিলেন বল্লেই হয়। কিন্তু বানের মুখের জেলেডিঙ্গীর মত তাদের কথা তল্ হয়ে যাচ্চে, নামকাটাদের পরিবর্তে সভাপণ্ডিত আপনার জামাই, ভাগনে, নাত-জামাই, দোত্তুর ও খুড়তুতো ভেয়েদের নাম হাসিল কচ্চেন; এদিকে নামকাটারা বাবু ও সভাপণ্ডিতকে বাপান্ত করে, পৈতে ছিঁড়ে, গালে চড়িয়ে শাপ দিয়ে উঠে যাচ্চেন। অনেকে উমেদারের অনিয়ত হাজরের পর বাবু কাকেও ‘আজ যাও’ ‘কাল এসো’ ‘হবে না’ ‘এবার এই হলো’ প্রভৃতি অনুজ্ঞায় আপ্যায়িত কচ্চেন–হজুরী সরকারের হেক্মত দেখে কে! সকলেই শশব্যস্ত, পূজার ভারী ধূম!
ক্রমে চতুর্থীর অবসান হলো, পঞ্চমী প্রভাত হলেন—ময়ররা দুর্গোমণ্ডা বা আগাতোলা সন্দেশের ওজন দিতে আরম্ভ কল্লে। পাঁঠার রেজিমেণ্টকে রেজিমেণ্ট বাজারে প্যারেড কত্তে লাগলো, গন্ধবেণেরা মসলা ও মাথাঘষা বেঁধে বেঁধে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আজ সহরের বড় রাস্তায় চলা ভার, মুটেরা প্রিমিয়মে মোট বইচে; দোকানে খদ্দের বসবার স্থান নাই। পঞ্চমী এইরূপে কেটে গেল। আজ ষষ্ঠী; বাজারের শেষ কেনাবেচা, মহাজনের শেষ তাগাদা—আশার শেষ ভরসা। আমাদের বাবুর বাড়ীরও অপূৰ্ব্ব শোভা; সব চাকর-বাকর নতুন তক্মা, উর্দ্দী ও কাপড় পোরে ঘুরে বেড়াচ্চে, দরজার দুই দিকে পূর্ণকুম্ভ ও আম্রসার দেওয়া হয়েচে; ঢুলীরা মধ্যে মধ্যে বোশনচৌকী ও শানাইয়ের সঙ্গে বাজাচ্চে; জামাই ও ভাগনেবাবুরা নতুন জুতো নতুন কাপড় পোরে ফর্রা দিচ্চেন, বাড়ীর কোন বৈঠকখানায় আগমনী গাওয়া হচ্ছে, কোথাও নতুন তাসজোড়া পর্কান হচ্ছে, সমবয়সী ও ভিক্ষুকের ম্যালা লেগেছে, আতরের উমেদাররা বাবুদের কাছে শিশি হাতে করে সাত দিন ঘুরচে; কিন্তু বাবুদের এমনি অনবকাশ যে, দুফোঁটা আতর দানের অবকাশ হচ্ছে না।