ক্রমে বেলা প্রায় একটা বেজে গেল। জগন্নাথের আর স্নান হয় না–দশ আনীর জমিদার ‘মহাশয়’ বাবুরা না এলে, জগন্নাথের স্নান হবে না। কিন্তু পচা আদা ঝাল ভরা তাঁদের আর আসা হয় না; ক্রমে যাত্রীরা নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লো, আসপাশের গাছতলা, আমবাগান ও দরজা লোকে ভরে গেল। অনেকের সর্দ্দিগৰ্ম্মি উপস্থিত, কেউ কেউ শিঙ্গে ফোঁকবার যোগাড় কল্লেন; অনেকেই ধুতুরোফুল দেখতে লাগলো। ডাব ও তরমুজে রণক্ষেত্র হয়ে গেল, লোকের রল্লা দ্বিগুণ বেড়ে উঠলো, সকলেই অস্থির। এমন সময় শোনা গেল, বাবুরা এসেচেন। অমনি জগন্নাথের মাথায় কলসী করে জল ঢালা হলো, যাত্রীরাও চরিতার্থ হলেন। চিঁড়ে, দই, মুড়ি, মুড়কি, চাটিমকলা দেদার উঠতে লাগলো। খোসপোষাকী বাবুরা খাওয়া দাওয়া কল্লেন। অনেকের আমোদেই পেট ভরে গেছে, সুতরাং খাওয়া দাওয়া আবশ্যক হলো না। কিছু বিশ্রামের পর তিনটে বেজে গেল। বাচখেলা আরম্ভ হলো–কার নৌকা আগে গিয়ে নিশেন নেয়, এরই তামাসা দেখবার জন্য সকল নৌকোই খুলে দেওয়া হলো। অবশ্যই এক দল জিৎলেন, সকলে জুটে হারের হাত্তালি ও জিতের বাহবা দিলেন। স্নানযাত্রার আমোদ ফুরুলো। সকলে বাড়ীমুখো হলেন; যত বাড়ী কাছে হতে লাগলো, শেষে ততই গৰ্ম্মিবোধ হতে লাগলো। কাশীপুরের চিনির কল, বালির ব্রিজ, কেউ পার হয়ে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ঘাটে উঠলেন, কেউ বাগবাজার ও আহারীটোলার ঘাটে নাবলেন। সকলেরই বিষণ্ণ বদন—ম্লান মুখ; অনেককেই ধরে তুলতে হলো; শেষ চার পাঁচ দিনের পর আমাদের নাগাড় মরে ফিরতি গোলের দরুণ আমরা গুরুদাসবাবুর নৌকোখানা বেচে নিতে পাল্লেম না।
———-
প্রথম ভাগ সমাপ্ত
২.১ রথ
হে সজ্জন, স্বভাবের সুনির্মল পটে,
রসের রঙ্গে,–
চিত্রিনু চরিত্র—দেবী সরস্বতীর রবে।
কৃপাচক্ষে হের একবার; শেষে বিবেচনামতে,
যার যা অধিক আছে তিরস্কার’ কিম্বা ‘পুরস্কার’
দিও তাহা মোরে–বহুমানে লব শির পাতি।
স্নানযাত্রার আমোদ ফুরুলো, গুরুদাস গুঁই গুলদার উঁড়ুনী পরিহার করে পুনরায় চিরপরিচিত র্যাদা ও ঘিস্কাপ ধল্লেন। ক্রমে রথ এসে পড়লো। ফ্যেতো র্যতো পরব প্রলয় বুড়ুটে; এতে ইয়ারকির লেশমাত্র নাই, সুতরাং সহরে রথ-পার্ব্বণে বড় একটা ঘটা নাই; কিন্তু কলিকাতায় কিছুই ফাঁক যাবার নয়। রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠলে ছোট ছোট ছেলেরা বার্নীস করা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পোরে, কোমরে রুমাল বেঁধে চুল ফিরিয়ে চাকর-চাকরাণীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর, পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েছে। আদবইসি মাগীরা খাতায় খাতায় কোরা ও কলপ দেওয়া কাপড় পোরে, রাস্তা জুড়ে চলেচে; মাটীর জগন্নাথ, কাঁটাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখী বেধড়ক বিক্রী হচ্ছে; ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো বুড়ো মিন্ষেরাও তালপাতের ভেপু নিয়ে বাজাচ্চেন, রাস্তায় ভোঁ পোঁ ভোঁ পোঁ শব্দের তুফান উঠেছে। ক্রমে ঘণ্টা, হরিবোল, খোল-খত্তাল ও লোকের গোলের সঙ্গে একখানা রথ এলো। রথের প্রথমে পেটা ঘড়ি, নিশান খুন্তী, ভেড়ং ও নেড়ির কবি, তারপর বৈরাগীদের দু-তিন দল নিমখাসা কেত্তন, তার পেছনে সখের সঙ্কীৰ্ত্তন পাওনা। দোহার-দলের সঙ্গে বড় বড় আটচালার মত গোলপাতার ছাতা ও পাখা চলেচে, আশে-পাশে কৰ্ম্মকর্ত্তারা পরিশ্রম ও গলদঘর্ম–কেউ নিশান ও রেশালার মিলে ব্যতিব্যস্ত, কেউ পাখার বন্দোবস্তে বিব্রত। সখের সঙ্কীর্তনওয়ালারা গোচসই বারাণ্ডার নীচে, চৌমাথায় ও চকের সামনে থেমে থেমে গান করে যাচ্চেন; পেছোনে চোতাদারেরা চেঁচিয়ে হাত নেড়ে গান বলে দিচ্চেন; দোহারের কি গাচ্ছেন, তা তারা ভিন্ন আর কেউ বুঝতে পাচ্ছেন না। দর্শকদের ভিড়ের ভিতর একটা মাতাল ছিল, সে বুথ দর্শন করে ভক্তিভরে মাতলামী সুরে–
“কে মা রথ এলি?
সর্বাঙ্গে পেরেক-মারা চাকা ঘুর-ঘুর ঘুরালি।
মা তোর সামনে দুটো ক্যেটো ঘোড়া,
চুড়োর উপর মুকপোড়া,
চাঁদ চামুরে ঘণ্টা নাড়া,
মধ্যে বনমালী।
মা ভোর চৌদিকে দেবতা আঁকা
লোকের টানে চল্চে চাকা,
আগে পাছে ছাতল পাকা, বেহদ্দ ছেনালী।”
গানটি গেয়ে, “মা রথ! প্রণাম হই মা!” বলে প্রণাম কল্লে। এদিকে রথ হেলতে দুলতে বেরিয়ে গেল; ক্রমে এই রকম দু চারখানা রথ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে পড়লো–গ্যাস-জ্বালা মুটের মৈ কাঁধে করে দেখা দিলে। পুলিসের পাশের সময় ফুরিয়ে এলো, দর্শকেরাও যে যার ঘরমুখো হলেন।
মাহেশে স্নানযাত্রায় যে প্রকার ধুম হয়, রথে সে প্রকার হয় না বটে; তবু ফেলা যায় না।
এদিকে সোজা ও উলটো রথ ফুরাল। শ্রাবণমাসে ঢ্যাল ফেলা পার্ব্বণ, ভাদ্র মাসের অরন্ধন ও জন্মাষ্টমীর পর অনেক জায়গায় প্রতিমের কাঠামোয় ঘা পড়লো, ক্রমে কুমোররা নায়েক বাড়ী একমেটে দোমেটে ও তেমেটে করে বেড়াতে লাগলো। কোলো বেঙ্গে “ক্রোড় কোঁ ক্রোড় কোঁ” শব্দে আগমনী গাইতে লাগলো; বর্ষা আঁবের আঁটি, কাঁটালের ভূঁতুড়ি ও তালের এঁসো খেয়ে বিদেয় হলেন–দেখতে দেখতে পূজো এলো।
২.২ দুর্গোৎসব
দুর্গোৎসব বাঙ্গালা দেশের পরব, উত্তরপশ্চিম প্রদেশে এর নামগন্ধও নাই; বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। পূর্ব্বে রাজা-রাজড়া ও বনেদী বড় মানুষদের বাড়ীতেই কেবল দুর্গোৎসব হত, কিন্তু আজকাল অনেক পুঁটে তেলীকেও প্রতিমা আনতে দেখা যায়; পূৰ্ব্বেকার দুর্গোৎসব ঔএখনকার দুর্গোৎসব অনেক ভিন্ন।