“যে যাবার সে যাক সখী আমি তো যাবো না জলে।
যাইতে যমুনাজলে, সে কালা কদম্বতলে,
আঁখি ঠেরে আমায় বলে, মালা দে রাই আমার গলে!”
গান ধরেচেন; কোনখানে এইমাত্র একখানি বোট নোঙ্গের কল্লে–বাবু ছাদে উঠলেন, অমনি আর আর সঙ্গীরাও পেচনে চল্লো; একজন মোসাহেব মাঝীদের জিজ্ঞাসা কল্লেন, “চাচা! জায়গাটার নাম কি?” অমনি বোটের মাঝী হজুরে সেলাম ঠুকে ‘আইগেঁ কাশীপুর কর্তা! এই রতনবাবুর গাট” বলে বক্সিসের উপক্রমণিকা করে রাখলে! বাবুর দল ঘাট শুনে হাঁ করে দেখতে লাগলেন; ঘাটে অনেক বৌ-ঝি গা ধুচ্ছিলো, বাবুদলের চাউনি, হাসি ও রসিকতার ভয়ে ও লজ্জায় জড়সড় হলো, দু একটা পোষ মান্বারও পরিচয় দেখাতে ত্রুটি কল্লে না–মোসাহেব দলে মাহেন্দ্রযোগ উপস্থিত; বাবুর প্রধান ইয়ার রাগ ভেঁজে–
অনুগত অশ্রিত তোমার।
রেখো রে মিনতি আমার।
অন্য ঋণ হলে বাঁচিতাম পলালে,
এ ঋণে না মলে পরিশোধ নাই!
অতএব তার, ভার তোমার,
দেখো রে করো নাকো অবিচার।
গান জুড়ে দিলেন। সন্ধ্যা-আহ্নিকওয়ালা বুড়ো বুড়ো মিন্ষেরা, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে, নিষ্কর্মা মাগীরা ঘাটের উপর কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল; বাবুরাও উৎসাহ পেয়ে সকলে মিলে গাইতে লাগিলেন—মড়াখেকো কুকুরগুলো খেউ খেউ করে উঠলো, চরন্তী শোয়ারগুলো ময়লা ফেলে ভয়ে ভোঁৎ ভোঁৎ করে খোঁয়াড়ে পালিয়ে গেল।
কোন বাবুর বজরা বরানগরের পাটের কলের সামনেই নোঙ্গোর করা হয়েচে, গাঁয়ের বওয়াটে ছেলেরা বাবুদের রঙ্গ ও সঙ্গের মেয়েমানুষ দেখে, ছোট ছোট নুড়ি পাথর, কাদা মাটীর চাপ ছুড়ে অমোদ কর্তে লাগলো, সুতরাং সে ধারের খড়খড়েগুলো বন্ধ কত্তে হলো–আরো বা কি হয়।
কোন বাবুর ভাউলেখানি রাসমণির নবরত্নের সামনে নোঙ্গোর করেছে, ভিতরের মেয়েমানুষেরা উঁকী মেরে নবরত্নটি দেখে নিচ্চে।
আমাদের নায়কবাবু গুরুদাস বাগবাজারের পোলের আসে পাশেই আছেন; তাঁদের বাঁয়ার এখনও আওয়াজ শোনা যাচ্চে, আতুরী ও আনীসদের বেশীর ভাগ আনাগোনা হচ্চে-আনীস ও রমেদের মধ্যে যাঁরা গেছলেন, তাঁরাই দুনো হয়ে বেরিয়ে আসছেন। ফুলূরী ও গোলাপী খিলিরা দেবতাদের মত বর দিয়ে অন্তর্ধান হয়েছেন, কারু কারু তপস্যার ফললাভও শুরু হয়েছে–স্নেহময়ী পিসী আঁচল দিয়ে বাতাস কচ্চেন; নৌকাখানি অন্ধকার।
এমন সময়ে ঝম্ ঝম্ করে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এলো। একটা গোলমেলে হাওয়া উঠলো, নৌকোর পাছাগুলি দুলতে লাগলো—মাঝীরা পাল ও চট মাথায় দিয়ে, বৃষ্টি নিবারণ কত্তে লাগলো; রাত্তির প্রায় দুপুর!
সুখের রাত্রি দেখতে দেখতেই যায়–ক্রমে সুখতারার সিঁতি পরে হাসতে হাসতে ঊষা উদয় হলেন, চাদ তার দিল নিয়ে অমোদ কচ্ছিলেন, হঠাৎ উষারে দেখে, লজ্জায় ম্লান হয়ে কাঁপতে লাগলেন। কুমুদিনী ঘোমটা টেনে দিলেন, পূর্ব্ব দিক ফরসা হয়ে এলো; “জোয়ার আইচে” বলে, মাঝারা নৌকা খুলে দিলে–ক্ৰমে সকল নৌকার সার বেঁধে মাহেশ ও বল্লভপুরে চলো। সকখানিই এখানে রং পোরা, কোন কোনখানিতে গলাভাঙ্গা সুরে–
“এখনো রজনী আছে বল কোথা যাবে রে প্রাণ
কিঞ্চিৎ বিলম্ব কর হো নিশি অবসান।।
যদি নিশি পোহাইত, কোকিলে ঝঙ্কার দিত,
কুমুদী মুদিত হতো শশী যেতে নিজ স্থান।”
শোনা যাচ্চে। কোনখানি কফিমের মত নিঃশব্দ—কোনখানিতে কান্নার শব্দ কোথাও নেশার গোঁ গোঁ ধ্বনি।
যাত্রীদের নৌকো চল্লো, জোয়ারও পেকে এলো, মালীরা জাল ফেলতে আরম্ভ কল্লে–কিনারায় সহরের বড়মানুষের ছেলেদের ট্রকপি ধোপার গাধা দেখা দিলে। ভটচায্যিরা প্রাতঃস্নান কত্তে লাগলেন, মাগী ও মিন্সেরা লজ্জা মাথায় করে কাপড় তুলে হাগতে বসেচে। তরকারীর বজরা সমেত হেটোরা বদ্দিবাটী ও শ্রীরামপুর চল্লো। আড়খেয়ার পাটুনীরে সিকি পয়সায় ও আধ পয়সায় পার কত্তে লাগলো। বদর ও দফর গাজীর ফকীরের ডিঙ্গের চড়ে ভিক্ষে আরম্ভ কল্লে। সূর্য্যদেব উদয় হলেন, দেখে কমলিনী আহ্লাদে ফুটলেন, কিন্তু ইলিশমাছ ধড়ফড়িয়ে মরে গেলেন; হায়! পরশ্রীকাতরদের এই দশাই ঘটে থাকে।
যে সকল বাবুদের খড়দ, পেনিটি, অগিড়পাড়া, কামারহাটী প্রভৃতি গঙ্গাতীর অঞ্চলে বাগান আছে, আজ তাঁদেরও ভারী ধূম। অনেক জয়েগার কাল শনিবার ফলে গেছে, কোথাও আজ শনিবার। কারু কদিনই জমাট বন্দোবস্ত—আয়েস ও চোহেলের হদ্দ! বাগানওয়ালা বাবুদের মধ্যে কারু কারু বাচ খেলাবার জন্য পান্সী তইরি, হাজার টাকার বাচ হবে। এক মাস ধরে নৌকার গতি বাড়াবার জন্য তলায় চরবি ঘষা হচ্চে ও মাঝিদের লাল উর্দ্দী ও আগু পেচুর বাদসাই নিশেন সংগ্রহ হয়েচে-গ্রামস্থ ইয়ার দল, খড়দর বাবুরা ও আর আর ভদ্দরলোক মধ্যস্থ! বোধ হয়, বাদী মহীন্দর নফর-চীনেবাজারের ক্যাবিনেট মেকর—ভারী সৌখীন—সখের সাগর বল্লেই হয়।
এ দিকে কোন যাত্রী মহেশ পৌঁছুলেন, কেউ কেউ নৌকাতেই রইলেন’; দুই একজন ওপরে উঠলেন—মাঠে লোকারণ্য, বেদীমণ্ডপ হতে গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত লোকের ঠেল মেরেছে; এর ভিতরেই নানাপ্রকার দোকান বসে গেচে। ভিখিরীরা কাপড় পেতে বসে ভিক্ষা কচ্চে, গায়েনের গাচ্ছে, আনন্দলহরী, একতারা খঞ্জনী ও বাঁয়া নিয়ে বোষ্টমেরা বিলক্ষণ পয়সা কুড়ুচ্চে। লোকের হররা, মাঠের ধূলো ও রোদের তাত একত্র হয়ে, একটি চমৎকার মেওয়া প্রস্তুত করেছে। অনেকে তাই দিল্লীর লাড্ডুর স্বাদে স্বাদ করে সেবা কচ্চেন!
ক্রমে বেলা দুই প্রহর বেজে গেল। সুৰ্য্যের উত্তাপে মাথা পুড়ে যাচ্চে, গামছা, রুমাল, চাদর ও ছাতি ভিজিয়েও পার পাচ্ছে না! জগবন্ধু চাঁদমুখ নিয়ে, বেদীর ওপর বসেচেন; চাঁদমুখ দেখে কুমুদিনীর ফোঁটা চুলোয় যাক, প্রলয়তুফানে জেলেডিঙ্গির তফরা খাওয়ার মত, সমাগত কুমুদিনীদের দুর্দশা দেখে কে!