এ দিকে ক্রমে বিবাহের গোল চুকে গেল; পদ্মলোচন বিষয়কৰ্ম্ম কত্তে লাগলেন। তিনি নিত্যনৈমিত্তিক দোল দুর্গোৎসব প্রভৃতি বার মাসে তের পার্ব্বণ ফাঁক দিতেন না, ঘেঁটু পূজাতেও চিনির নৈবিদ্য ও সখের যাত্রী বরাদ্দো ছিলো, আপনার বাড়ীতে যে রকম ধূম করে পূজো আচ্ছা করেন, রক্ষিতা মেয়েমানুষ ও অনুগত দশ বারো জন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের বাড়ীতে তেমনি ধূমে পূজো করাতেন। নিজের ছেলের বিবাহের সময়ে তিনি আগে চল্লিশ জন আইবুড়ো বংশজের বিয়ে দিয়ে দেন। ইংরেজি লেখাপড়ার প্রাদুর্ভাবে রামমোহন রায়ের জন্মগ্রহণে ও সত্যের জ্যোতিতে হিন্দুধর্ম্মের যে কিছু দুরবস্থা দাঁড়িয়েছিলো, পদ্মলোচন কায়মনে তার অপনয়নে কৃতসংকল্প হলেন। কিন্তু তিনি, কি তার ছেলেরা দেশের ভালোর জন্য একদিনও উদ্যত হন নি—শুভ কৰ্ম্মে দান দেওয়া দূরে থাকুক, সে বৎসরের উত্তর-পশ্চিমের ভয়ানক দুর্ভিক্ষেও কিছুমাত্র সাহায্য করেন নি, বরং দেশের ভালো করবার জন্য কেউ কোন প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের কাছে উপস্থিত হলে তারে কৃশ্চান ও নাস্তিক বলে তাড়িয়ে দিতেন—এক শ বেলেল্লা বামুন ও দু শ মোসাহেব তাঁর অন্নে প্রতিপালিত হতো—তাতেই পদ্মলোচনের বংশ মহা পবিত্র বলে সহরে বিখ্যাত হয়। লেখা-পড়া শেখা বা তার উৎসাহ দেওয়ার পদ্ধতি পদ্মলোচনের বংশে ছিল না, শুদ্ধ নামটা সই কত্তে পাল্লেই বিষয় রক্ষা হবে, এই তাঁদের বংশপরম্পরার স্থির সংস্কার ছিল। সরস্বতী ও সাহিত্য ঐ বংশের সম্পর্ক রাখতেন না! ঊনবিংশতি শতাব্দীতে হিন্দুধৰ্ম্মের জন্য সহরে কোন বড়মানুষ তার মত পরিশ্রম স্বীকার করেন নাই। যে রকম কাল পড়েছে, তাতে আর কেউ যে তাদৃক যত্নবান হন, তারও সম্ভাবনা নাই। তিনি যেমন হিন্দুধর্মের বাহ্যিক গোঁড়া ছিলেন, অন্যান্য সৎকৰ্ম্মেও তার তেমনি বিদ্বেষ ছিল; বিধবাবিবাহের নাম শুনলে তিনি কানে হাত দিতেন, ইংরেজী পড়লে পাছে খানা খেয়ে কৃশ্চান হয়ে যায়, এই ভয়ে তিনি ছেলেগুলিকে ইংরাজী পড়াননি, অথচ বিদ্যাসাগরের উপর ভয়ানক বিদ্বেষ নিবন্ধন সংস্কৃত পড়ানও হয়ে উঠে নাই, বিশেষতঃ শূদ্রের সংস্কৃততে অধিকার নাই, এটিও তাঁর জানা ছিল; সুতরাং পদ্মলোচনের ছেলেগুলিও “বাপকা বেটা সেপাইকা ঘোড়া”র দলেই পড়ে।
কিছুদিন এই রকম অদৃষ্টচর লীলা প্রকাশ করে, আশী বৎসর বয়সে পদ্মলোচন দেহ পরিত্যাগ কল্লেন-মৃত্যুর দশ দিন পূর্ব্বে একদিন হঠাৎ অবতারের সর্বাঙ্গ বেদনা করে। সেই বেদনাই ক্রমে বলবর্তী হয়ে তার শয্যাগত কল্লে–তিনি প্রকৃত হিন্দু, সুতরাং ডাক্তারী চিকিৎসায় ভারী দ্বেষ কত্তেন, বিশেষতঃ তাঁর ছেলেবেলা পর্য্যন্ত সংস্কার ছিল, ডাক্তার অষুধ মাত্রেই মদ মেশান, সুতরাং বিখ্যাত বিখ্যাত কবিরাজ মশাইদের দ্বারা নানা প্রকার চিকিৎসা করান হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে আত্মীয়েরা কবিরাজ মশাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে শ্ৰীশ্রী ঁভাগীরথীতটস্থ কল্লেন, সেখানে তিন রাত্তির বাস করে মহাসমারোহে প্রায়শ্চিত্তের পর সজ্ঞানে রাম ও হরিনাম জপ কত্তে কত্তে প্রাণত্যাগ করেন।
পাঠক! আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে বহু দূর এসেছেন। যে পদ্মলোচন আপনাদের সম্মুখে জন্মালেন, আবার মলেন, শুদ্ধ তাঁর নিজের চরিত্র আপনারা অবগত হলেন এমন নয়, সহরের অনেকের চরিত্র অবগত হলেন। সহরের বড়মানুষদের মধ্যে অনেকেই পদ্মলোচনের জুড়িদার, কেউ কেউ দাদা হতেও সরেস! যে দেশের বড়লোকের চরিত্র এই রকম ভয়ানক, এই রকম বিষময়, সে দেশের উন্নতি প্রার্থনা করা নিরর্থক। যাদের হতে উন্নতি হবে, তাঁরা আজও পশু হতেও অপকৃষ্ট ব্যবহারের সর্ব্বদাই পরিচয় দিয়ে থাকেন তাঁরা ইচ্ছা করে আপনা আপনি বিষময় পথের পথিক হন; তাঁরা যে সকল দুষ্কৰ্ম্ম করেন, তার যথারূপ শাস্তি নরকেও দুষ্প্রাপ্য।
জন্মভূমি-হিতচিকীর্ষুরা আগে এই সকল মহাপুরুষদের চরিত্র সংশোধন করবার যত্ন পান, তখন দেশের অবস্থায় দৃষ্টি করবেন; নতুবা বঙ্গদেশের যা কিছু উন্নতি প্রার্থনায় যত্ন দেবেন, সকলই নিরর্থক হবে।
“আলালের ঘরের দুলাল” লেখক—বাবু, টেকচাঁদ ঠাকুর বলেন, “সহরের মাতাল বহুরূপী;” কিন্তু আমরা বলি, সহরের বড় মানুষের নানারূপী—এক এক বাবু এক এক তরো, আমরা চড়কের নক্সায় সেগুলিই প্রায়ই গড়ে বর্ণন করেচি, এখন ক্রমশঃ তারি বিস্তার বর্ণন করা যাবে-তারি প্রথম উঁচুকে দল খাস হিন্দু; এই হঠাৎ অবতারের নক্সাতেই আপনারা সেই উঁচুকেতার খাস হিন্দুদের চরিত্র জানতে পাল্লেন—এই মহাপুরুষেরাই রিফমেশনের প্রবল প্রতিবাদী, বঙ্গসুখ-সৌভাগ্যের প্রলয় কণ্টক ও সমাজের কীট।
হঠাৎ অবতারের প্রস্তাবে পাঠকদের নিকট আমরাও কথঞ্চিৎ আত্ম-পরিচয় দিয়ে নিয়েছি; আমরা ক্রমে আরো যত ঘনিষ্ঠ হবো, ততই রং ও নক্সার মাঝে মাঝে সং সেজে আসবে;-আপনারা যত পারেন, হাততালি দেবেন ও হাসবেন!
১.২৮ মাহেশের স্নানযাত্রা
গুরুদাস গুঁই সেরুড় কোম্পানীর বাড়ীর মেট মিস্তিরি। তিরশ টাকা মাইনে, সওয়ায় দশ টাকা উপরি রোজগারও আছে। গুরুদাসের চাঁপাতলাঞ্চলে একটি খোলার বাড়ী আছে, পরিবারের মধ্যে বুড়ো মা, বালিকা স্ত্রী ও বিধবা পিসী মাত্র।
গুরুদাস বড় সাখরচে লোক। মা দশ টাকা রোজগার করেন, সকলই খরচ হয়ে যায়। এমন কি, কখন কথন মাস কাবারের পূর্ব্বে গয়না খানা ও জিনিসটে পত্তরটাও বাঁধা পড়ে। বিশেষতঃ আষাঢ় শ্রাবণ মাসে ইলিশ মাছ ওটবার পূর্ব্বে ও ঢ্যালাফ্যালা পার্ব্বণে গুরুদাসের দু মাসের মাইনেই খরচ হয়। ভাদ্রমাসের আনন্দটি বড় ধূমে হইয়া থাকে। আর পিটে-পাৰ্ব্বণেও দশ টাকা খরচ হয়েছিল —ক্রমে স্নানযাত্রা এসে পড়লো। স্নানযাত্রাটি পরবের টেক্কা, তাতে আমোদের চূড়ান্ত হয়ে থাকে। সুতরাং স্নানযাত্রা উপলক্ষে গুরুদাস বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খাওয়ারও অবকাশ রইল না; ক্রমে আরও পাঁচ ইয়ার জুটে গেল। স্নানযাত্রায় কি কি রকম আমোদ হবে, তাই তদ্বির ও পরামর্শ হতে লাগলো; কেবল দুঃখের বিষয় চাঁপাতলার হলধর বাগ মতিলাল বিশ্বেস ও হারাধন দাস, গুরুদাসের বুজুম্ ফ্রেণ্ড ছিলেন,–কিন্তু কিছুদিন হলো হলধর একটা চুরী মামলায় গেরেপ্তার হয়ে দু বছরের জন্য জেলে গেছেন, মতি বিশ্বাস মদ খেয়ে পাতকোর ভিতরে পড়ে গিয়েছিলেন, তাতেই তার দুটি পা ভেঙ্গে গিয়েছে, আর হারাধন গোটাকতক টাকা বাজার-দেনার জন্য ফরাসডাঙ্গায় সরে গেছেন; সুতরাং এবারে তাঁদের বিবাহে স্নানযাত্রাটা ফাঁক ফাঁক লাগছে কিন্তু তাহলে কি হয়–সংবৎসরের অমোদটা বন্ধ করা কোন ক্রমেই হতে পারে না বলেই নিতান্ত গর্মিতে থেকেও গুরুদাসকে স্নানযাত্রায় যাবার আয়োজন কত্তে হচ্ছে।