গাজনতলায় সজোরে ঢাক-ঢোল বেজে উঠলো, সকলে উচ্চস্বরে “ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব” বলে চীৎকার কত্তে লাগলো; বাবু শিবের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন।—বড় বড় হাতপাখা দুপাশে চলতে লাগলো। বিশেষ কারণ না জানলে অনেকে বোধ কত্তে পারতো যে আজ বাবু বুঝি নরবলি হবেন। অবশেষে বাবুর দু-হতি একত্র করে ফুলের মালা জড়িয়ে দেওহলো, বাবু কাঁদ কাঁদ মুখ করে রেশমী রুমাল গলায় দিয়ে একবারে দাঁড়িয়ে রইলেন, পুরোহিত শিবের কাছে ‘বাবা ফুল দাও, বাবা ফুল দাও’ বারংবার বলতে লাগলো, বাবুর কল্যাণে একঘটি গঙ্গাজল পুনরায় শিবের মাথায় ঢালা হলো, সন্ন্যাসীরা সজোরে মাথা ঘুরুতে লাগলো, আধঘণ্টা এইরূপ কষ্টের পর শিবের মাথা থেকে একবোঝা বিল্বপত্র স’রে পড়লো। সকলের আনন্দের সীমা নাই, ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো’ বলে চীৎকার হতে লাগলো, সকলেই বলে উঠলো “না হবে কে—কেমন বংশ!”
ঢাকের তাল ফিরে গেল। সন্ন্যাসীরা নাচতে নাচতে কাছের পুকুর থেকে পরশু দিনের ফ্যলা কতকগুলি বইচির ডাল ভুলে আনলে। গাজনতলায় বিশ আঁটী বিচালি বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বাড়ি ঠ্যাঙ্গান হলো; কাঁটাগুলি ক্রমে সব মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলেন, দুইজন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁধে তার দুদিকে টানা ধল্লে–সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর ঝাঁপ খেয়ে পড়তে লাগলো। উঃ! শিবের কি মাহাত্ম্য! কাঁটা ফুটলে বলবার যো নাই! এদিকে বাজে দর্শকের মধ্যে দু’ একজন কুটেল চোরা-গোপ্তা মাচ্ছেন। অনকে দেবতাদের মত অন্তরীক্ষে রয়েছেন, মনে কচ্চেন, বাজে আদায়ে দেখে নিলুন, কেউ জানতে পাল্লে না। কিন্তু আমরা সব দেখতে পাই। ক্রমে সকলের ঝাঁপ খাওয়া ফুলো; একজন আপনার বিক্রম জানাবার জন্য চিৎ হয়ে উল্টো ছাঁপ খেলে; সজোরে ঢাক বেজে উঠলো। দর্শকেরা কাঁটা নিয়ে টানাটানি কত্তে লাগলেন—গিন্নীরা বলে দিয়েছেন—“ঝাঁপের কাঁটার এমনি গুণ যে, ঘরে রাখলে এ জন্মে বিছানায় ছারপোকা হবে না।”
এদিকে সহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদয় আলো জ্বলা হয়েছে। ‘বেলফুল’, ‘বরফ’, ‘মালাই’, চীৎকার শুনা যাচ্চে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েছে, অথচ খদ্দের ফিচ্চে না। ক্রমে অন্ধকার গা-ঢাকা হয়ে এলো; এ সময় ইংরাজী জুতো, শান্তিপুরে ডুরে উড়ুনি আর সিমলের ধুতির কল্যাণে–রাস্তায় ছোটলোক ভদ্দরলোক আর চেনবার যো নাই। তুখোড় ইয়ারের দল হাসির গরবা ও ইংরাজী কথার ফরবার সঙ্গে খাতায় খাতায় এর দরজায়, তার দরজায় ঢু মেরে বেড়ে বেড়াচ্ছেন। এঁরী সন্ধ্যা জ্বালা দেখে বেরুলেন আবার ময়দা-পেষা দেখে বাড়ী ফিরবেন। মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা, চৌরবাগানের মোড়, যোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান, নতুন বাজার, বটতলা, সোণাগাজির গলি ও আহিরীটোলার চৌমাথা লোকারণ্য— কেউ মুখে মাথায় চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন, কেউ তাঁরে চিনতে পারবে না। আবার অনেকে চেঁচিয়ে কথা কয়ে কেসে হেঁচে লোককে জানান দিচ্ছেন যে, “তিনি সন্ধ্যার পর দুদণ্ড আয়েস করে থাকেন।”
সৌখীন কুঠিওয়ালা মুখে হাতে জল দিয়ে জলযোগ করে সেতারটি নিয়ে বসেছেন। পাশের ঘরের ছোট ছেলেরা চীৎকার করে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় পড়ছে। পীল-ইয়ার ছোকরারা উড়তে শিখচে। স্যাকরারা দুর্গাপ্রদীপ সামনে নিয়ে রাংঝাল দিবার উপক্রম করেছে। রাস্তার ধারের দুই একখানা কাপড়, কাঠ-কাটরা ও বাসনের দোকান বন্ধ হয়েছে; রোকেড়ের দোকানদার ও পোদ্দার ও সোনার বেনের তহবিল মিলিয়ে কৈফিয়ং কাটচে। শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙ্গা বাজারে মেছুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাচ ও লোণা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের—“ও গামচাকাঁধে, ভাল মাচ নিবি?” “ও খেংরা-গুঁপো মিন্সে, চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্ছে—মধ্যে মধ্যে দুই একজন রসিকতা জানবার জন্য মেছুনী ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল ও মাতালেরা লাঠি হাতে করে কাণা সেজে “অন্ধ ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতাগণ” বলে ভিক্ষা করে মৌতাতের সম্বল কচ্চে। এমন সময় বাবুদের গাজতলায় সজোরে ঢাক বেজে উঠলো, “বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো।” চীৎকার হতে লাগলো; গোল উঠলো, এবারে ঝুল-সন্ন্যাস। বাড়ীর সামনের মাঠে ভারা টারা বাঁধা শেষ হয়েচে; বাড়ীর ক্ষুদে ক্ষুদে হবু হুজুরের দারোয়ান চাকর ও চাকরাণীর হাত ধরে গাজনতলায় ঘুরঘুর কচ্চেন।
ক্রমে সন্ন্যাসীরা খড়ে আগুন জ্বেলে ভারার নীচে ধল্লে; একজনকে তার উপর পানে পা করে ঝুলিয়ে দিয়ে তার মুখের কাছে অগুনের উপর গুঁড়ো ধুনো ফেলতে লাগলো; ক্রমে একে একে অনেকে ঐ রকম করে দুল্লে, ঝুলসন্ন্যাস সমাপন হলো; আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার সহর জুড়লো, পূর্ব্বের মত সেতার বাজতে লাগলো, বেলফুল, বরফ ও মালাই যথামত বিক্রী করবার অবসর পেলে; শুক্রবারের রাত্রি এই রকমে কেটে গেল।
আজ নীলের রাত্তির, তাতে আবার শনিবার। শনিবারের রাত্তিরে সহর বড় গুলজার থাকে। পানের খিলির দোকানে বেলণ্ঠন আর দেয়ালগিরী জ্বলচে। ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে বেলফু্লের গন্ধ ভুরভুর করে বেরিয়ে যেন সহর মাতিয়ে তুলচে। রাস্তার ধারেই দুই একটা বাড়ীতে খেমটা নাচের তালিম হচ্ছে, অনেকে রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে ঘুঙুর ও মন্দির রুণু রুণু শব্দ শুনে স্বর্গসুখ উপভোগ কচ্চেন; কোথাও একটা দাঙ্গা হচ্ছে। কোথাও পাহারাওয়ালা একজন চোর ধরে বেঁধে নে যাচ্চে–তার চারিদিকে চার পাঁচ জন হাসচে আর মজা দেখচে এবং আপনাদের সাবধানতার প্রশংসা কচ্চে; তারা যে এক দিন ঐ রকম দশায় পড়বে, তায় ভ্রুক্ষেপ নাই।।