ব্যাণ্ড, ঢাক, ঢোল ও নাগরার শব্দে, লোকের বল্লা ও অধ্যক্ষদের মিছিলের চীৎকারে কলকেতা কাঁপতে লাগলো; অপর পাড়ার লোকেরা তাড়াতাড়ি ছাতে উঠে মনে কল্লে ওদিকে ভয়ানক আগুন লেগে থাকবে। রাস্তার দুধারি বাড়ীর জানালা ও বারাণ্ডা লেকে পুরে গেল। বেশ্যারা “অহা দিব্বি ছেলেটি যেন চাদ!” বলে প্রশংসা কত্তে লাগলো। হুতোমুপচা অন্তরক্ষি থেকে নক্সা নিতে লাগলেন। ক্রমে বর কনের বাড়ী পৌঁছিল। কাকর্ত্তারা তাদর সওষণ করে বরুবাত্তোরদের অভ্যর্থনা কল্লেন–পাড়ার মৌতাতি বুড়ো ও বওয়াটে ছোঁড়ারা গ্রামভটির জন্য বরকর্ত্তাকে ঘিরে দাঁড়ালো –বর সভায় গিয়ে বসলো, ঘটকের ছড়া পড়তে লাগলো, মেয়েরা বার থেকে উঁকি মাত্তে লাগলো, ঘটকের মিত্তিরবাবুর কুলজী আউড়ে দিলে, মিত্তিরবাবু কুলীন, সুতরাং বল্লালী রেজেষ্টারীতে তাঁর বংশাবলী রেজেষ্টারী হয়ে আছে, কেবল দত্তবাবুর বংশাবলীটি বানিয়ে নিতে হয়।
ক্রমে বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীরা সাপ্টা জলপান করে বিদেয় হলেন! বর স্ত্রী-আচারের জন্য বাড়ীর ভিতর গেলেন। ছাদনাতলায় চারিটি কলাগাছের মধ্যে আল্পনা দিয়ে একটি পিঁড়ে রাখা হয়েছিল, বর চোরের মত হয়ে সেইখানে দাঁড়ালে, মেয়েরা দাঁড়া-গুয়া পান বরণডালা, মঙ্গলের ভাঁড়ওয়ালা কুলো ও পিদ্দিম দিয়ে বরণ কল্লেন, শাঁখবাজানো ও উলু উলুর চোটে বড়ি সরগরম হয়ে উঠলো; ক্রমে মায় শ্বাশুড়ী এয়োরা সাতবার বরকে প্রদক্ষিণ কল্লেন–শ্বাশুড়ী বরের হাতে মাকু দিয়ে বল্লেন, “হাতে দিলাম মাকু একবার ভ্যা কর তা বাপু!” বর কলেজ বয়, আড়চোখে এয়োদের পানে তাকাচ্ছিলেন ও মনে মনে লঙ্কা ভাগ কচ্ছিলেন, সুতরাং “মনে মনে কল্লেন” বল্লেন—শালাজেরা কান মলে দিলে, শালীর গালে ঠোনা মাল্লে। শেষে গুড়চাল, __তাক, অষুদ বিষুদ ফুরুলে, উচ্ছুগ্গু করবার জন্য কনেকে দালানে নিয়ে যাওয়া হলো। শাস্ত্রমতে মন্ত্র পড়ে কনে উচ্ছুগ্গু হলেন, পুরুত ও ভট্টাচার্য্যেরা সন্দেশের সরা নিয়ে সল্লেন; বরকে বাসরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাসরটিতে আমাদের চূড়ান্ত হয়। আমরা তো অ্যাতো বুড়ো হয়েছি, তবু এখনোও বাসরের আমোদটি মনে পড়লে, মুখ দে লাল পড়ে ও আবার বিয়ে কর্ত্তে ইচ্ছে হয়।
ক্রমে বাসরের অমোদের সঙ্গেই কুমুদিনী অস্ত গেলেন। কমলিনীর হৃদয়রঞ্জন প্রকৃত তেজীয়ান হয়েও যেন তার মানভঞ্জনের জন্যই কোমলভাব ধারণ করে উয়দ হলেন। কমলিনী নাথের তাদৃশ দুর্দ্দশা দেখেই যেন সরোবরের মধ্যে হাসতে লাগলেন; পাখীরা “ছি ছি! কামোন্মত্তদের কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে না;” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। বায়ু মুচকে মুচকে হাসতে লাগলেন–দেখে ক্রোধে সূৰ্য্যদেব নিজ মূর্ত্তি ধারণ কল্লেন; তাই দেখে পাখীরা ভয়ে দূর-দূরান্তরে পালিয়ে গেল। বিয়েবাড়িতে বাসি বিয়ের উজ্জুগ হতে লাগলো। হলুদ ও তেল মাখিয়ে বরকে কলাতলায় কনের সঙ্গে নাওয়ান এমন হলো, বরণডালায় বরণ ও কতক তুকতাকের পর বর-কনে গাঁটছড়া কিছুক্ষণের পর খুলে দেওয়া হলো।
এদিকে ক্রমে বরযাত্রী ও বরের আত্মীয়-কুটুম্বরা জুটতে লাগলো। বৈকালে পুনরায় সেই রকম মহাসমারোহে বর-কনেকে বাড়ী নে যাওয়া হলো। বরের মা বর-কনেকে বরণ করে ঘরে নিলেন! এক কড়া দুধ দরজার কাছে আগুনের ওপর বসান ছিল, কনেকে সেই দুধের কড়াটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা কর। হলো “মা! কি দেখচো? বল যে আমার সংসার উৎলে পড়চে দেখছি।” কনেও মনে মনে তাই বল্লেন। এ সওয়ায় পাঁচ গিন্নীতে নানা রকম তুকতাক কল্লে পর বর-কনে জিরুতে পেলেন; বিয়েবাড়ীর কথঞ্চিৎ গোল চুকলো—ঢুলিরা ধেনো মদ খেয়ে আমোদ কত্তে লাগলো। অধ্যক্ষের প্রলয় হিন্দু; সুতরাং একটা একটা অগিতোলা দুর্গোমণ্ডা ও এক ঘটী গঙ্গাজল খেয়ে বিছানায় আড় হলেন-বর কনে আলাদা আলাদা শুলেন–অঞ্জ একত্রে শুতে নাই, বে-বাড়ীর বড়গিন্নীর মতে আজকের রাত–কালরাত্রির।
শীতকালের রাত্রি শীগগির যায় না। এক ঘুম, দু ধুম, আবার প্রস্রাব করে শুলেও বিলক্ষণ এক ঘুম হয়। ক্রমে গুডুম করে তোপ পড়ে গেলো—প্রাতঃস্নানের মেয়েগুলো বকতে বকতে রাস্তা মাথায় করে যাচ্চে—বুড়ো বুড়ো ভটচায্যিরা স্নান করে “মহিম্নঃ পারন্তে” মহিম্নস্তব আ ওড়াতে আওড়াতে চলেছেন। এদিকে পদ্মলোচন অবিদ্যার বাড়ী হতে বাড়ী এলেন; আজ তার নানা কাজ! পদ্মলোচন প্রত্যহ সাত আট্টার সময় বেশ্যালয় থেকে উঠে আসেন, কিন্তু আজ কিছু সকালে আসতে হয়েছিল। সহরের অনেক প্রকৃত হিন্দু বুড়ো বুড়ো দলপতির এক একটি জলপাত্র আছে এ কথা আমরা পূর্ব্বেই বলেচি; এদের মধ্যে কেউ রাত্রি দশটার পর শ্রীমন্দিরে যান একেবারে সকাল বেলা প্রাতঃস্নান করে টিপ, তেলক ও ছাপা কেটে গীতগোবিন্দ ও তসর পরে হরিনাম কত্তে কষ্ট্রে বাড়ী ফেরেন–হঠাৎ লোকে মনে কত্তে পারে শ্ৰীযুত গঙ্গাস্নান করে এলেন। কেউ কেউ বাড়ীতেই প্রিয়তমাকে আনান; সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হলে ভোরের সময় বিদেয় দিয়ে স্নান করে পূজা কত্তে বসেন-যেন রাত্তিরে তিনি নন–পদ্মলোচনও সেই চাল ধরেছিলন।
ক্রমে আত্মীয় কুটুম্বেরাও এসে জমলেন, মমসাহেবরা “হুজুর! কলকেতায় এমন বিয়ে হয় নি–হবে না” বলে বাবুর ল্যাজ ফোলাতে লাগলেন। ক্রমে সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে ফুলশয্যার তত্ত্ব এলো, পদ্মলোচন মহাসমাদরে কনের বাড়ীর চাকর-চাকরাণীদের মহা অভ্যর্থনা কল্লেন, প্রত্যেককে একটি করে টাকা ও একখানি করে কাপড় বিদেয় দিলেন। দলস্থ ও আত্মীয়েরা কিছু কিছু করে অংশ পেলেন। বাকী ঢুলী ও রেশালার লোকেরা বক্সিস পেয়ে, বিদেয় হলো; কোন কোন বাড়ীর গিন্নী সামগ্রী পেয়ে হাঁড়ি পূরে শিকেয় টাঙ্গিয়ে রাখলেন; অধিক অংশ পচে গেল, কতক বেরালে ও ইঁদুরে খেয়ে গেল, তবু গিন্নীরা পেট ভরে খেতে কি কারেও বুক বেধে দিতে পাল্লেন না—বড়মানুষদের বাড়ীর গিন্নীরা প্রায়ই এই রকম হয়ে থাকেন, ঘরে জিনিষ পচে গেলেও লোকের হাতে তুলে দিতে মায়া হয়। শেষে পচে গেলে মহারাণীর খানায় ফেলে দেওয়া হয়, সেও ভাল। কোন কোন বাবুরও এ স্বভাবটি আছে, সহরের এক বড়মানুষের বাড়ীতে দুর্গাপূজার সময়ে নবমীর দিন গুটি ষাইটেক পাঁঠা বলিদান হয়ে থাকে; পুৰ্ব্ব পরম্পরায় সেগুলি সেই দিনেই দলস্থ ও আত্মীয়ের বাড়ী বিতরিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজকাল সেই পাঁঠাগুলি নবমীর দিন বলিদান হলেই গুদামজাত হয়; পূজার গোল চুকে গেলে, পূর্ণিমার পর সেইগুলি বাড়ী বাড়ী বিতরণ হয়ে থাকে, সুত্রং ছয় সাত দিনের মরা পচা পাঁঠা কেমন উপাদেয়, তা পাঠক আপনিই বিবেচনা করুন। শেষে গ্রহীতাদের সেই পাঠা বিদেয় কত্তে ঘর হতে পয়সা বার কত্তে হয়! আমরা যে পূর্ব্বে আপনাদের কাছে সহরের সর্দ্দার মূর্খের গল্প করেচি ইনিই তিনি!