হায়! যাদের জন্মগ্রহণে বঙ্গভুমির দুরবস্থা দূর হধা প্রত্যাশা করা যায়, যার প্রভূত ধনের অধিপতি হয়ে স্বজাতি, সমাজ ও বঙ্গভূমির মঙ্গলের জন্য কায়মনে যত্ন নেবে, না সেই মহাপুরুষেরাই সমস্ত ভয়ানক দোষ ও মহাপাপের আকর হয়ে বসে রইলেন; এর বাড়া আর আক্ষেপের বিষয় কি আছে? আজ একশ বৎসর অতীত হলো, ইংরাজের এ দেশে এসেছেন, কিন্তু আমাদের অবস্থার কি পরিবর্ত্তন হয়েছে? সেই নবাবী আমলের বড়মানষী কেতা, সেই পাকান কাচা, সেই কোঁচান চাদর, লপেটা জুতো ও বাবরী চুল আজও দেখা যাচ্চে; বরং গৃহস্থ মধ্যস্থ লোকের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু আমাদের হুজুরেরা যেমন, তেমনই রয়েচেন। আমাদের ভরসা ছিল, কেউ হঠাৎ বড়মানুষ হলে রিফাইণ্ড গোচের বড়মানুষীর নজীর হবে, কিন্তু পদ্মলোচনের দৃষ্টান্তে আমাদের সে আশা সমূলে নিৰ্ম্মল হয়ে গেল–পদ্মলোচন আবার কফিনচোরের ব্যাটা ম্যকমারা হয়ে পড়লেন, কফিনচোর মরা লোকের কাপড় চুরি কত্তো মাত্র–অবিদ্যা রেখে অবধি পদ্মলোচন স্ত্রীর সহবাস পরিত্যাগ কল্লেন, স্ত্রী চরে খেতে লাগলেন। পূৰ্ব্ব সহবাস বা তার হাতযশে পদ্মলোচনের গুটি চার ছেলে হয়েছিল; ক্রমে জ্যেষ্ঠটি বড় হয়ে উঠলো, সুতরাং তার বিবাহে বিলক্ষণ ধূমধাম হবার পরামর্শ হতে লাগলো!
ক্রমে বড়বাবুর বিয়ের উজ্জুগ হতে লাগলো; ঘটক ও ঘটকীর বাড়ী বাড়ী মেয়ে দেখে বেড়াতে লাগলেন—“কুলীনের মেয়ে, দেখতে পরমা সুন্দরী হবে, দশ টাকা যোত্তর থাকবে এমনটি শীগগির জুটে ওঠা সোজা কথা নয়। শেষে অনেক বাছা-গোছা ও দেখা-শুনার পর শহরের আগড়োম ভোঁম সিঙ্গির লেনের আত্মারাম মিত্তিরের পৌত্তুরীরই ফুল ফুটলো! আত্মারামবাবু খাস হিন্দু, কাপ্তেনীর কৰ্ম্মে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় করেছিলেন, আত্মারামবাবুর সংসারও রাবণের সংসার বল্লে হয়–সাত সাতটি রোজগেরে ব্যাটা, পরীর মত পাঁচ মেয়ে, আর গড়ে গুটি চল্লিশ পৌত্তুর পৌত্তুরী; এ সওয়ার ভাগ্নে, জামাই কুটুম্বসাক্ষাৎ বাড়ীতে গিজ গিজ করে,–সুতরাং সৰ্বগুণাক্রান্ত আসামি পদ্মলোচনের বেয়াই হবার উপযুক্ত স্থির হলেন। শুভলগ্নে মহা আড়ম্বর করে লগ্নপত্রে বিবাহের দিন স্থির হলো; দলস্থ সমুদায়, ব্রাহ্মণেরা মর্য্যাদামত পত্রের বিদেয় পেলেন, রাজভাট ও ঘটকেরা ধন্যবাদ দিতে চল্লো; বিয়ের ভারী ধূম! সহরে হুজুক উঠলো পদ্মলোচনবাবুর ছেলের বিয়ের পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ–গোপাল মল্লিক ছেলের বিয়েতে খরচ করেছিলেন বটে, কিন্তু এতো নয়।
দিন আসচে দেখতে দেখতেই এসে পড়ে। ক্রমে বিবাহের দিন ঘনিয়ে এলো বিয়েবাড়ীতে নহবৎ বসে গেল। অধ্যক্ষ ভট্টাচার্য্য ও দলস্থদের ঘোঁট বাদন সুরু হলো—ত্রিশ হাজার জোড়া শাল, সোণার লোহা ও ঢাকাই সাড়ী, দু লক্ষ সামাজিক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদলে বিতরণ হলো; বড়মানুষদের বাড়ীতেও ও শাল ও সোণাওয়ালা লোহা, ঢাকাই কাপড়, গেদরা কদ্দক, গোলাব ও আতর, এক এক জোড়া শাল সওগাদ পাঠান হলো! কেউ আদর কবে গ্রহণ কল্লেন, কেউ কেউ বলে পাঠালেন যে, আমরা টুলি বা বাজন্দরে নই যে, শাল নেবো! কিন্তু পদ্মলোচন হঠাৎ অবতার হয়ে শ্রীরামচন্দ্রের মত আত্মবিস্মৃত হয়ে ছিলেন, সুতরাং সে কথা গ্রাহ্য কল্লেন না। পারিষদ, মোসাহেব ও বিবাহেব অধ্যক্ষেরা বলে উঠলেন—বেটার অদৃষ্টে নাই।
এদিকে বিয়েব বাইনাচ আরম্ভ হলো, কোথাও রূপোর বালা লাল কাপড়ের তকমাধরা ও উর্দ্ধী-পরা চাকরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও অধ্যক্ষেরা গড়ের বাজ্ঞা আনবার পরামর্শ কচ্চেন—কোথাও বরের সজ্জা তইরির জন্য দজ্জিরা একমনে কাজ কচ্চে—চারিদিকেই হৈ হৈ ও রৈ রৈ শব্দ। বাবুর দেওয়া শালে শহরের অর্ধেক লোকেই লালে লাল হয়ে গেল, ঢুলি ও বাজন্দরেরা তো অনেকের বিয়েতেই পুরাণ শাল পেয়ে থাকে, কিন্তু পদ্মলোচনের ছেলের বিয়ের সুন্দর লোকেও শাল পেয়ে লাল হয়ে গেলেন!
১২ই পৌষ শনিবার বিবাহের লগ্ন স্থির হয়েছিল! আজ ১২ই পৌষ, আজ বিবাহ। আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, সহরে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল, “পদ্মলোচনের ছেলের বিয়ের পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ।” সুতরাং বিবাহের দিন বৈকাল হতে রাস্তায় ভয়ানক লোকারণ্য হতে লাগলো, পাহারা ওয়ালারা অতি কষ্টে গাড়ীঘোড়া চলবার পথ করে দিতে লাগলো। ক্রমে সন্ধ্যার সময় বর বেরুলো;–প্রথমে কাগজের ও অব্বরের হাতঝাড়, পাঞ্জা ও সিঁড়ি ঝাড় রাস্তার দুপাশে চল্লো। ঐ রেশালার আগে আগে দুটি চলতি নবত ছিল; তার পেছনে গেট–দালান ও কাগজের পাহাড়ের উপর হরপার্ব্বতী, নন্দী, ষাঁড়, ভৃঙ্গী, সাপ ও নানারকম গাছ–তার পেছনে ঘোড়াপঙ্খী, হাতীপঙ্খী, উটপঙ্খী, ময়ূরপঙ্খীগুলির ওপরে বারোজন করে দাঁড়ি, মেয়ে ও পুরুষ সওদাগর সাজা ও দুটি করে ঢোল। তার আশে পাশে তক্তনামার উপর ‘মগের নাচ’ ‘ফিরিঙ্গির নাচ’ প্রভৃতি নানাপ্রকার সাজা সং! তার পশ্চাৎ এক শ’ ঢোল, চল্লিশটি জগঝম্প ও গুটি যাইটেক ঢাক মায় রোষোনচৌকী—শানাই, ভোড় ও ভেপু তার কিছু অন্তরে এক দল নিমখাসা রকমের চুনোগলীর ইংরেজী বাজনা। মধ্যে বাবুর মোসাহেব, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, পারিষদ, আত্মীয় ও কুটুম্বরা। সকলেরই এক রকম শাল, মাথায় রুমাল জড়ান, হাতে একগাছি ইষ্টিক, হঠাৎ বোধ হয় যেন এক কোম্পানী ডিজার্মড সেপাই! এই দলের দুই ধারে লাল বনাতের খাশ গেলাস ও রূপোর ডাণ্ডিতে রেসমের নিসেনধরা তক্মাপরা মুটে ও ক্ষুদে ক্ষুনে ছোঁড়ারা; মধ্যে খোদ বরকৰ্ত্তা, গুরু-পুরোহিত, বাছালো বাছালো ভূঁড়ে ভূঁড়ে ভটচায্যি ও আত্মীয় অন্তরঙ্গরা; এর পেছনে রাঙ্গামুখোইংরেজী বাজনা, সাজা সায়েব-তুরুক-সওয়ার, বরের ইয়ারবস্ক, খাস দরওয়ানরা, হেড খানসামা ও রূপের সুখাসনখানির চারিদিকে মায় বাতি বেললণ্ঠন, টাঙ্গান, সাম্নে রূপোর দশডেলে বসান ঝাড়, দুই পাশে চামরধরা দুটো ছোঁড়া; শেষে বরের তোরঙ্গ, প্যাটরা, বাড়ীর পরামাণিক, সোনার দানা গলায় বুড়ী বুড়ী গুটীকত দাসী ও বাজে লোক; তার পেছনে বরযাত্রীর গাড়ীয় সার–প্রায় সকলগুলির উপয় এক এক চাকর ডবল বাতিদেওয়া হাত লণ্ঠন ধরে বসে যাচ্চে।