কলকেতা সহরে কতকগুলি বেকার জয়কেতু আছেন। যখন যার নতুন বোলবোলাও হয়, তখন তাঁরা সেইখানে মেশেন, তাঁকেই জগতের শ্রেষ্ঠ দেখান ও অনন্যমনে তাঁরই উপাসনা করে, আবার যদি তাঁর চেয়ে কেউ উঁচু হয়ে পড়েন, তবে তাঁরে পরিত্যাগ করে উঁচু দলে জমেন; আমরা ছেলেবেলা বুড়ো ঠাকুরমার কাছে ‘ছাঁদন দড়ি ও গোদা নড়ির’ গল্প শুনেছিলাম, এই মহাপুরুষেরা ঠিক সেই ‘ছাঁদন দড়ি গোদা নড়ি।’ গল্পে আছে, রাজপুত্তুর জিজ্ঞাসা কল্লো, “ছাঁদন দড়ি গোদা নড়ি! এখন তুমি কার?–না আমি যখন যার তখন তার?” তেমনি হতোমপ্যাঁচা বলেন, সহুরে জয়কেতুরাও যখন যার তখন তার!!
জয়কেভু ভদ্দরলোকের ছেলে, অনেকে লেখাপড়াও জানেন; তবে কেউ কেউ মূর্ত্তিমতী মা। এঁদের অধিকাংশই পৌত্তলিক, কুলীন বামুন, কায়স্থ কুলীন, বেকার, পেনশুনে ও ব্রকোদই বিস্তর! বহুকালের পর পদ্মলোচনবাবু কলকেতা সহরে বাবু বলে বিখ্যাত হন। প্রায় বিশ বৎসর হলো সহরের হঠাৎ বাবুর উপসংহার হয়ে যায়, তন্নিবন্ধন ‘জয়কেতু’ ‘মোসাহেব’ ‘ওস্তাদজী’ ‘ভড়জা’ ‘ঘোষজা’ ‘বোসজা’ প্রভৃতি বরাখুরেরা জোয়ারের-বিষ্ঠার মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, সুতরাং এখন পদ্মলোচনের “তর্পণের কোশায়” জুড়াবার জায়গা পেলেন।
জয়কেতুরা ক্রমে পদ্মলোচনকে ফাঁপিয়ে তুল্লেন, পড়তাও ভাল চল্লো—পদ্মলোচন অ্যাম্বিসনের দাস হলেন, হিতাহিত বিবেচনা দেনদার বাবুদের মত গা ঢাকা হলেন। পদ্মলোচন প্রকৃত হিন্দুর মুখোস পরে সংসার-রঙ্গভূমিতে নাবলেন;–ব্রাহ্মণের পার্দ্ধলো খান–পা চাটেন—দলাদলির ও হিন্দুধর্মের ঘোঁটি করেন—ঠাকরুণ বিষয় ও সখীযংবাদ গাওনার পক্ষে প্রকৃত ব্লটীংপেপার; পদ্মলোচনের দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ! বৈঠকখানায় ব্রাহ্মণ অধ্যাপক ধরে না, মিউটিনীর সময়ে গবর্ণমেণ্ট যেমন দোচোখখাত ভলেটীয়ার জুটিয়েছিলেন, পদ্মলোচন বাবু হয়ে সেইরূপ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সংগ্রহ কত্তে বাকি রাখলেন না! এসিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়মের মত বিবিধ আশ্চর্য জীব একত্র কল্লেন—বেশীর ভাগ জ্যান্ত!!
বাঙ্গালী বদমায়েস ও দুর্ব্বুদ্ধির হাতে টাকা না থাকলে সংসারের কিছুমাত্র ক্ষতি কত্তে পারে না, বদমায়েশী ও টাকা একত্র হলে হাতী পর্য্যন্ত মারা পড়ে, সেটি বড় সোজা ব্যাপার নয়, শিবকেষ্টো বাঁড়ুয্যে পর্য্যন্ত যাতে মারা যান! পদ্মলোচনও পাঁচজন কুলোকের পরামর্শে বদমায়েসী আরম্ভ কল্লেন—পৃথিবীর লোকের নিন্দা করা, খোঁটা দেওয়া বা টিট্কারী করা তার কাজ হলো; ক্রমে তাতেই তিনি এমনি চোড়ে উঠলেন যে, শেষে আপনাকে আপনি অবতার বলে বিবেচনা কত্তে লাগলেন; পারিষদেরা অবতার, বলে তাঁর স্তব কত্তে লাগলো; বাজে লেকে ‘হঠাৎ অবতার’ খেতাব দিলে-দর্শক ভদ্দর লোকেরা এই সকল দেখে শুনে অবাক হয়ে ক্ল্যাপ দিতে লাগলেন।
পদ্মলোচন যথার্থই মনে মনে ঠাউরেছিলেন যে, তিনি সামান্য মনুষ্য নন, হরি হরি, নয় পীর কিম্বা ইহুদিদের ভাবী মেসায়া!—তারই সফলতা ও সার্থকতার জন্য পদ্মলোচন বুজরুকী পর্য্যন্ত দেখাতে ত্রুটী করেন নাই।
বিলাতী জিজেষ্ক্রাইষ্ট এক টুকরো রুটিতে একশ লোক খাইয়েছিলেন–কানা ও খোঁড়া ফুঁয়ে ভাল কত্তেন! হিন্দু মতের কেষ্টও পূতনা বধ, শকটভঞ্জন প্রভৃতি অলৌকিক কাৰ্য্য করেছিলেন। পদ্মলোচন আপনারে অবতার বলে মানাবার জন্যে সহরে হুজুক তুলে দিলেন যে, “তিনি একদিন বারো জনের খাবার জিনিসে একশ লোক খাইয়ে দিলেন।” কাণ খোঁড়ারা সর্ব্বদাই হবেড়ীর ধ্বজবজ্রাঙ্কুশযুক্ত পদ্মহস্ত পাবার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন, বুড়ী বুড়ী মাগীরা ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে নিয়ে ‘হাতবুলানো’ পাইয়ে আনে, পদ্মলোচন এইরূপ নানাবিধ বুজরুকী প্রকাশ কত্তে লাগলেন। এই সকল শুনে চতুষ্পাঠীওয়ালা মহাপুরুষের মড়কের শকুনির মত নাচতে লাগলেন—টাকার এমনি প্রতাপ যে, চন্দ্রকে দেখে রত্নাকর সাগরও কেঁপে ওঠেন—অন্যের কি কথা! ময়রার দোকানে যত রকমারি মাছি, বসন্তি বোলতা আর ভোঁভূয়ে ভোমরা দেখা যায়, বইয়ের দোকানে তার কটা থাকে সেথায় পদার্থহীন উই পোকার—আন্সাড়ে আরুসুলার দল, আর দু একটা গোডিমওয়ালা ফচকে নেংটি ইঁদুর মাত্র।
হঠাৎ টাকা হলে মোজ যে রকম গরম হয়, এক দম গাঁজাতেও সে রকম হয় না, হঠাৎ অবতার হয়েও পদ্মলোচনের আশা নিবৃত্ত হবে তারও সম্ভাবনা কি? কিছু দিনের মধ্যে পদ্মলোচন কলকেতা সহরের একজন প্রধান হিন্দু হয়ে পড়েন তিনি হাই তুল্লে হাজার ভুঁড়ি পড়ে–তিনি হাঁচলে জীব জীব জীব শব্দে ঘর কেঁপে উঠে! ‘ওরে ওরে ওরে!’ ‘হুজুর’ ও ‘যো হুকুমের’, হল্লা পড়ে গেল, ক্রমে সহরের বড় দলে খবর হলো যে, কলকেতার ন্যাচরাল হিষ্টীর দলে একটি নম্বরে বাড়লো।
ক্রমে পদ্মলোচন নানা উপায়ে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় কত্তে লাগলেন, অবস্থার উপযুক্ত একটি নতুন বাড়ী কিনলেন, সহরের বড়মানুষ হলে যে সকল জিনিপত্র ও উপাদানের আবশ্যক, সভাস্থ আত্মীয় ও মোসাহেবের ক্রমশঃ সেই সকল জিনিস সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ও উদর পুরে ফেল্লেন; বাবু স্বয়ং পছন্দ করে (আপন চক্ষে সুবর্ণ বর্ষে) একটি অবিদ্যাও রাখলেন।
বেশ্যাবাজীটি আজকাল এ সহরে বাহাদুরীর কাজ ও বড়মানুষের এলবাত পোষাকের মধ্যে গণ্য। অনেক বড়মানুষ বহুকাল হলো মরে গেচেন, কিন্তু তাদের রক্ষিতার বাড়ীগুলি আজও মনুমেন্টের মত তাঁদে স্মরণার্থে রয়েছে—সেই তেতলা কি দোতলা বাড়ীটি ভিন্ন তাদের জীবনে আর এমন কিছু কাজ হয় নি, যা দেখে সাধারণে তাদের স্মরণ করে। কলকেতার অনেক প্রকৃত হিন্দু দলপতি ও রাজারাজড়ারা রাত্রে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখেন না। বাড়ীর প্রধান আমলা, দাওয়ান মুচ্ছুদ্দিরা যেমন হুজুরদের হয়ে বিষয় কৰ্ম্ম দেখেন—স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাঁদের উপর আইন মত অর্শায়, সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন? এই ভয়ে কোন কোন বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ীর ভিতরের ঘরে পূরে চাবি বন্ধ করে বাইরের বৈঠকথানায় সারা রাত্রি অবিদ্যা নিয়ে আমোদ করেন, তোপ পড়ে গেলে ফরসা হবার পূর্ব্বে গাড়ী বা পাল্কী করে বিবিসাহেব বিদায় হন—বাবু বাড়ীর ভিতর গিয়ে শয়ন করেন।–স্ত্রীও চাবি হতে পরিত্রাণ পান। ছোকরাগোছের কোন কোন বাবুরা বাপ-মার ভয়ে আপনার শোবার ঘরে স্ত্রীকে একাকিনী ফেলে আপনি বেরিয়ে যান; মধ্য রাত্রি কেটে গেলে বাবু আমোদ লুটে ফেরেন ও বাড়ীতে এসে চুপি চুপি শোবার ঘরের দরজায় ঘা মারেন, দরজা খোলা পেলে বাবু শয়ন করেন। বাড়ীর আর কেউই টের পায় না যে, বাবু রাত্রে ঘরে থাকেন না। পাঠকগণ! যারা ছেলে বেলা থেকে “ধৰ্ম্ম যে কার নাম, তা শোনে নি, হিতাহিত বিবেচনার সঙ্গে যাদের সুদূর সম্পর্ক, কতকগুলি হতভাগা মোসাহেবই যাদের হাল” তারা যে এই রকম পশুবৎ কদাচারে রত থাকবে, এ বড় আশ্চাৰ্য নয়! কলকেতা সহর এই মহাপুরুষদের জন্য বেশ্যাসহর হয়ে পড়েছে, এমন পাড়া নাই, যেখানে অন্তত দশ ঘর বেশ্যা নাই, হেয় প্রতি বৎসর বেশ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে বই কমছে না। এমন কি, এক জন বড়মানুষের বাড়ীর পাশে একটি গৃহস্থের সুন্দরী বউ কি মেয়ে বার কবার যো নাই, তা হলে দশ দিনেই সেই সুন্দরী টাকা ও সুখের লোভে কুলে জলাঞ্জলি দেবে—যত দিন সুন্দরী বাবুর মনস্কামনা পূর্ণ না করবে, তত দিন দেখতে পাবেন, বাবু অষ্ট প্রহর বাড়ীর ছাদের উপর কি বারান্দাতেই আছেন, কখন হাসচেন, কখন টাকার তোড়া নিয়ে ইসারা কোরে দেখাচ্চেন। এ ভিন্ন মোসাহেবদেরও নিস্তার নাই; তাঁরা যত দিন তাঁরে বাবুর কাছে না আনতে পারেন, ততদিন মহাদায়গ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, হয় ত সে কালের নবাবদের মতে “জান বাচ্চা এক গাড়” হবার হুকুম হয়েচে! ক্রমে কলে কৌশলে সেই সাধ্বী স্ত্রী বা কুমারীর ধর্ম্ম নষ্ট করে শেষে তাড়িয়ে দেওয়া হবে—তখন বাজারে কশার করাই তার অনন্যগতি হয়ে পড়ে! শুধুই এই নয় সহরের বড় মানুষেরা অনেকে এমনি লম্পট যে স্ত্রী ও রক্ষিত মেয়েমানুষ-ভোগেও সন্তুষ্ট নন, তাতেও সেই নরাধম রাক্ষসদের কাম-ক্ষুধাও নিবৃত্তি হয় না—শেষে আত্মীয়া যুবতীরাও তার ভোগে লাগে।–এতে কত সতী আত্মহত্যা করে, বিষ খেয়ে এই মহাপাপীদের হাত এড়িয়েছে। আমরা বেশ জানি, অনেক বড়মানুষের বাড়ী মাসে একটি করে প্রাণহত্যা হয় ও রক্তকম্বলের শিকড়, চিতের ডাল ও করবীর ছালের নুন-তেলের মত উঠনো বরাদ্দ আছে। যেখানে হিন্দুধর্মের অধিক ভড়ং, যেখানে দলাদলির অধিক ঘোঁট ও ভদ্দরলোকের অধিক কুৎসা, প্রায় সেখানেই ভিতর বাগে উদোম এলো, কিন্তু বাইরে পাদে গেরো!