পদ্মলোচনের জন্মদিনটি সামান্য লোকের জন্মদিনের মত অমনি যায়নি; সেদিন—হঠাৎ মেঘাড়ম্বর করে সমস্ত দিন অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়–একটি সাপ আঁতুড় ঘরের দরজায় সমস্ত রাত্রি বসে ফোঁস ফোঁস করে, আর বাড়ীর একটি পোষা টিয়ে পাখী হঠাৎ মরে গিয়ে দাঁড়ে ঝুলে থাকে। পদ্মলোচনের পিতামহী এ সকল লক্ষণ শুভ নিমিত্ত বিবেচনা করে, বড়ই খুসী হয়ে আপনার পর্বার একখানি লালপেড়ে সড়িী ধাইকে বক্সি, দেন। অভ্যাগত ঢুলি ও বাজন্দরেরাও একটি সিকি আর এক হাঁড়ি নারকেল লাডু পেয়েছিল! ক্রমে মহা আনন্দে আট্কৌড়ে সারা হলো, গায়ের ছেলেরা “আটকৌড়ে বাট্কৌড়ে ছেলে আছে ভাল, ছেলের বাবার দাড়িতে বসে হাগ” বলে কূলো বাজিয়ে আটকড়াই, বাতাসা ও এক এক চকচকে পয়সা নিয়ে, আনন্দে বিদেয় হলো! গোভাগাড় থেকে একটা মরা গরুর মাথা কুড়িয়ে এনে আঁতুড়ঘরের দরজায় রেখে ‘দোরষষ্ঠী’ বলে হলুদ ও দূৰ্ব্বো দিয়ে পুজো করা হলো। ক্রমে ১৫ দিন ২০ দিন, তক মাস সম্পূর্ণ হলে গাঁয়ের পঞ্চাননতলায় ষষ্ঠীর পুজো দিয়ে আঁতুড় ওঠান হয়।
ক্রমে পদ্মলোচন শুক্লতিথিগত চাঁদের মতন বাড়তে লাগলেন! গুলিদাণ্ডা, কপাটী কপাটী, চোর চোর, তেলি হাত পিছলে গেলি প্রভৃতি খেলায় পদ্মলোচন প্রসিদ্ধ হয়ে পড়লেন। পাঁচ বছরে হাতে খড়ি হলো, গুরু মহাশয়ের ভয়ে পদ্মলোচন পুকুরপাড়ে, নল বনে ও বাঁশবাগানে লুকিয়ে থাকেন, পেট কামড়ানি ও গা বমি বমি প্রভৃতি অন্তঃশীলে রোগেরও অভাব রইলো না; ক্রমে কিছুদিন এই রকমে যায়, একদিন পদ্মলোচনের বাপ মলেন, তাঁর মা আগুন খেয়ে গেলেন; ক্রমে মাতামহ, মামা ও মামাতো ভেয়েরাও একে একে অকালে ও সময়ে সল্লেন; সুতরাং মাতামহ মিত্তিরদের ভিটে পুরুষশূন্য প্রায় হলো। জমিজমাগুলি জয়কৃষ্ণের মত জমিদারে কতক গিলে ফেলে, কতক খাজনা না দেওয়ায় বিকিয়ে গেল। সুতরাং পদ্মলোচনকে অতি অল্পবয়সে পেটের জন্যে অদৃষ্ট ও হাতযশের উপর নির্ভর কত্তে হলো। পদ্মলোচন কলকেতায় এসে এক বাসাড়েদের বাসায় পেটভাতে ফাইফরমাস, কাপড় কোঁচানো ও লূচি ভাজা প্রভৃতি কৰ্ম্মে ভর্ত্তি হলেন—অবকাশ মত হাতটাও পাকান হবে—বিশেষতঃ কুঠেলরা লেখা-পড়া শেখাবেন, প্রতিশ্রুত হলেন।
পদ্মলোচন কিছুকাল ঐ নিয়মে বাসাড়েদের মনোরঞ্জন করতে লাগলেন, ক্রমে দু-এক বাবুর অনুগ্রহপাপ্তির প্রত্যশায় মাথালে জায়গায় উমেদারী আর কল্লেন। সহরের যে বড়মানুষের বৈঠকখানায় যাবেন, প্রায় সর্ব্বত্রই লোকারণ্য দেখতে পাবেন; যদি ভিতরকার খবর দ্যান, তা হলে পাওনাদার, মহাজন, উঠনোওয়ালা দোকানদার, উমেদার, আইবুড়ো ও বেকার কুলীনের ছেলে বিস্তর দেখতে পাবেন—পদ্মলোচনও সেই ভিড়ের মধ্যে একটি বাড়লেন; ক্রমে অষ্টপ্রহর ঘণ্টার গরুড়ের মত উমেদারিতে অনবরত এক বৎসর হাঁটাহাঁটা ও হাজিরের পর দুচারখানা সই-সুপারিসও হস্তগত হলো; শেষে এক সদয়হৃদয় মুছুদ্দী আপনার হাউসে ওজোন সরকারী কর্ম্ম দিলেন।
পদ্মলোচন কষ্টভোগের একশেষ করেছিলেন; ভদ্দরলোকের ছেলে হয়েও তাকে কাপড় কোঁচানো, লুচি ভাজা, বাজার করা, জল তোলা প্রভৃতি অপকৃষ্ট কাজ স্বীকার কত্তে হয়েছিল; ক্রমশঃ লুচি ভাজতে ভাজতে ক্রমে লুচি ভাজায় তিনি এমনি তইরি হয়ে উঠলেন যে, তার মত লূচি অনেক মেঠাইওয়ালা বামুনেও ভাজতে পাত্তো না! বাসাড়েরা খুসী হয়ে তারে ‘মেকর’ খেতাব দেয়। সুতরাং সেই দিন থেকে তিনি ‘মেকর পদ্মলোচন দত্ত’ নামে বিখ্যাত হলেন!
ভাষা কথায় বলে “যখন যার কপাল ধরে–যখন পড়তা পড়তে আরম্ভ হয়, তখন ছাইমুটো ধল্লে সোণমুটো হয়ে যায়। ক্রমে পদ্মলোচন দত্তের শুভদৃষ্ট ফলতে আরম্ভ হলো, মুদী অনুগ্রহ করে শিপসরকারী কর্ম্ম দিলেন। সাহেবরাও দত্তজার বিলাকী ও কাজের হুসিয়ারিতে সন্তুষ্ট হতে লাগলেন পদ্মলোচন ততই সাহেবদের সন্তুষ্ট করবার অকসুর খুঁজতে লাগলেন—একমনে সেবা কক্সে ভয়ঙ্কর সাপও সদয় হয়; পুরাণে পাওয়া যায় যে, তপস্যা করে অনেকে হিন্দুদের ভূতের মত ভয়ানক দেবতাগুলোকেও প্রসন্ন করেছে! ক্ৰম সায়েবরা পদ্মলো:নর প্রতি সন্তুষ্ট হয় তার ভাল করার চেষ্টায় রইলন; একদিন হাউসের সদরমেট কর্ম্মে জবাব দিলে সায়েবরা মুছুদ্দীকে অনুরোধ করে পদ্মলোচনকে সেই কর্ম্মে ভর্ত্তি কল্লেন!
পদ্মলোচন শিপসরকার হয়েও বাসড়েদের আশ্রয় পরিত্যাগ করেন নি; কিন্তু সদরমেট হয়ে সেখানে থাকা আর ভাল দেখায় না বলেই, অন্যত্র একটু জায়গা ভাড়া করে একখানি খেলার ঘর প্রস্তুত করে রইলেন। কিন্তু এ অবস্থায় তাঁরে অধিকদিন থাকতে হলো না। তাঁর অদৃষ্ট শীঘ্রই লুচির ফোসকার মত ফুলে উঠলো–বের জল পেলে কনেরা যেমন ফেঁপে ওঠে, তিনিও তেমনি ফাঁপতে লাগলেন। ক্রমে মুচ্ছুদ্দীর সঙ্গে সায়েবদের বড় একটা বনিবনাও না হওয়ায় মুচ্ছুদ্দী কৰ্ম্ম ছেড়ে দিলেন, সুতরাং সায়েবদের অনুগ্রহধর পদ্মলোচন, বিনা ডিপজিটে মুচ্ছুদ্দী হলেন।
টাকায় সকলই করে! পদ্মলোচন মুচ্ছুদ্দী হবামাত্র অবস্থার পরিবর্ত্তন বুঝতে পাল্লেন। তার পরদিন সকালে খেলার ঘর বালাখানাকে ভাংচাতে লাগলো—উমেদার, দালাল, প্যায়দা, গদিওয়ালা ও পাইকার ভরে গেল। কেউ পদ্মলোচনবাবুকে নমস্কার করে হাঁটুগেড়ে জোড়হাত করে কথা কয়, কেউ ‘আপনার সোণার দোত কলম হোক’ ‘লক্ষপতি হোন’ ‘সম্বৎসরের মধ্যে পুওর সন্তান হোক’ অনুগতের হুজুর ভিন্ন গতি নাই’ প্রভৃতি কথায় পদ্মলোচনকে তুঁদুলে পাউরুটী হতেও ফোলাতে লাগলেন–ক্রমে দুরবস্থা দুষ্কর লোচ্চার মত মুখে কাপড় দিয়ে লুকুলেন–অভিমানও অহঙ্কারে ভূষিত হয়ে সৌভাগ্যযুবতী বারাঙ্গনা সেজে তাঁরে আলিঙ্গন কল্লেন, হুজুকদারেরা আজকাল ‘পদ্মলোচনকে পায় কে’ বলে ঢ্যাঁকা পিটে দিলেন, প্রতিধ্বনি রেও বামুন, অগ্রদানী ও গাইয়ে বাজিয়ে সেজে এই কথাটি সর্ব্বত্র ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন–সহরে ঢি ঢি হয়ে গেল—পদ্মলোচন একজন মস্ত লোক।