সন্ন্যাসী আমাদের বসতে বলে অন্য কথা তোলবার উপক্রম কচ্চেন, এমন সময়ে বঙ্কুবেহারীবাবু এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন—সে দিন বঙ্কুবেহারিবাবু মাথায় একটি জরীর কাবুলী তাজ, গায়ে লাল গাজের একটি পিরহান, “বেচে থাকুক বিদ্দেসাগর চিরজীবী হয়ে’ পেড়ে শান্তিপুরের ধুতি ও ডুরে উড়ুনী মাত্র ব্যবহার করেছিলেন, আর হাতে একখানি লাল রঙ্গের রুমাল ছিল—তাতে রিংসমেত গুটিকত চাবী ঝুলছিল।
বঙ্কবেহারীবাবুর ভূমিকা, মিষ্টি আলাপ, নমস্কার ও স্যেকহ্যাণ্ড চুকলে পর, তার দাদা সন্ন্যাসীকে হিন্দীতে বুঝিয়ে বল্লেন যে, এই সকল ভদ্দর লোকেরা আপনার বুজরুকী ও ক্যারামত দেখতে এসেছেন; প্রার্থনা—অবকাশমত দুই একটা জাহার করেন, তাতে সন্নাসীও কিছু কষ্টের পর রাজী হলেন। ক্রমে বুজরুকীর উপক্রমণিকা আরম্ভ হলো, বঙ্কবেহারীবাবু প্রোগ্র্যাম স্থির কল্লেন, কিছুক্ষণ দেখতে দেখতে প্রথমে ঘটের উপর থেকে একটি জবাফুল তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। ঘটের উপর থেকে জবাফুল বর্ষাকালের কড়কটে ব্যাঙের মত থপসি করে লাফিয়ে উঠলো, সন্ন্যাসী তার দুহাত তফাতে বসে রয়েচেন—এ দেখলে হঠাং বিস্মিত হতেই হয়। সুতরাং ঘর শুদ্ধ লোক খণিকক্ষণ অবাক হয়ে রইলেন সন্ন্যাসীর গম্ভীরতা ও দর্পভরা মুখখানি তই অহঙ্কারে ফুলে উঠতে লাগলো। এমন সময়ে এক জন চেল এক বোতল মদ এনে উপস্থিত কল্লেদ দুর্ব হয়ে যাবে। পাছে ডবল বোতল বা অন্য কোন জিনিষ বলে দর্শকদের সন্দেহ হয়, তার জন্য সন্ন্যাসী একখানি নতুন সরায় সেই বোতলের সমুদায় মদটুকু ঢেলে ফেল্লেন, ঘর মদের গন্ধে তর্র্ হয়ে গ্যালো–সকলেরই স্থির বিশ্বাস হলো, এ মদ বটে।
সন্ন্যাসী নতুন সরায় মদ ঢেলেই একটি হুঙ্কার ছাড়িলেন, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা আঁতকে উঠলো, বুড়োদের বুক গুর গুর কত্তে লাগলো; একজন চেলা নিকটে এসে জিজ্ঞাসা কল্লে, “গুরু! এ কটোরেমে ক্যা হয়?” সন্ন্যাসী, “দুধ হো বেটা!” বলে তাতে এক কুশী জল ফেলবামাত্র সরার মদ দুধের মত সাদা হয়ে গেল—আমরাও দেখে শুনে গাধা বনে গেলুম। এইরকম নানা প্রকার বুজরুকী ও কার্দ্দানী প্রকাশ হতে হতে রাত্রি এগারোটা বেজে গেল; সুতরাং সকলের সম্মতিতে বঙ্কবাবুর প্রস্তাবে সে রাত্রের মত বেদব্যাসের বিশ্রাম হলো; আমরা রামরকমের একটা প্রণাম দিয়ে, একটি উল্লুক হয়ে বাড়ীতে এলেম। একে ক্ষুধাও বিলক্ষণ হয়েছিল, তাতে আমাদের বাহন ঝাঁকামুটেটি যে রাৎকাণা, তা পূৰ্ব্বে বলে নাই; সুতরাং তার হাত ধরে গুটি গুটি করে আধ ক্রোশ পথ উজোন ঠেলে তাকে কাঠের দোকানে পৌঁছে রেখে, তবে বাড়ী যাই। দুঃখের বিষয়, আবার সে রাত্রে বেড়ালে আমাদের খাবারগুলি সব খেয়ে গিয়েছিল; দোকানগুলিও বন্ধ হয়ে গ্যাচে। সুতরাং ক্ষুধায় ও পথের কষ্টে আমরা হতভম্ব হয়ে, সে রাত্রি অতিবাহিত করি!
আমরা পূর্ব্বেই বলে এসেছি, “দশ দিন চোরের এক দিন সেধের”। ক্রমে অনেকেই বঙ্কবাবুর বাড়ীর সন্ন্যাসীর কথা আন্দোলন কত্তে লাগলেন, শেষে এক দিন আমরা সন্ন্যাসীর জুচ্চরি ধত্তে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে, বন্ধুবাবুর বাড়ীতে গেলেম!
পূর্ব্বদিনের মত জবাফুল তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো, এমন সময়ে মেডিকেল কলেজের বাঙ্গালা ক্লাশের একজন বাঙ্গাল ছাত্র লাফিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসীর হাত ধরে ফেল্লেন। শেষে হুড়োমুড়িতে বেরুলো জবাফুলটি ঘোড়ার বালুঞ্চি দিয়ে, তাঁর নখের সঙ্গে লাগান ছিল!
সংসারের গতিই এই! একবার অনর্থের একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র বেরুলে, ক্রমে বহুলী হয়ে পড়ে। বালুঞ্চি বাঁধা জবাফুল ধরা পড়তেই, সকলেই একত্র হয়ে সন্ন্যাসীর তোবড়া-তুবড়ি খানা-তল্লাসী কত্তে লাগলেন; একজন ঘুর্ত্তে ঘুৰ্ত্তে ঘরের কোণ থেকে একটা মরা পাঁটা বাহির কল্লেন। সন্ন্যাসী একদিন ছাগল কেটে প্রাণ দান দেন, সেই কাটা ছাগলটি সরাতে না পেরে, ঘরের কোণেই (ফ্লোরওয়ালা মেজে নয়) পুতে রেখেছিলেন, তাড়াতাড়িতে বেমালুম করে মাটী চাপাতে পারেন নাই, পাঁটার একটি সিং বেরিয়েছিল-–সুতরাং একজরে পায় ঠ্যাকাতেই অনুসন্ধানে বেরুলো; সন্ন্যাসী আমাদের সাক্ষাতে যে মদকে দুধ করেছিলেন, সেদিন তারও জাঁক ভেঙ্গে গেল, সেই মজলিসের একজন সব আসিষ্টাণ্ট সার্জ্জন বল্লেন যে, আমেরিকান (মার্কিণ আনীস) নামক মদে জল দেবা মাত্র সাদা দুধের মত হয়ে যায়। এই রকম ধরপাকড়ের পর বেহারীবাবুও সন্ন্যাসীকে অপ্রস্তুত করেন। আমরা রৈ রৈ শব্দে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলেম, হরিভদ্দর খুড়ো সন্ন্যাসীর পেতলের শিবটি কেড়ে নিলেন, সেটি বিক্রী করে নেপালে চরস কেনেন ও তাঁরও সেইদিন থেকে এই রকম বুজরুক সন্ন্যাসীদের উপর অশ্রদ্ধা হয়।
পূর্ব্বে এই সকল অদৃষ্টচর ব্যাপারের যে রকম প্রাদুর্ভাব ছিল এখন তার অংশে আধগুণও নাই। আমরা সহরে কদিন কটা উৰ্দ্ধবাহু, কটা অবধূত দেখতে পাই? ক্রমে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এ সকল জুয়াচ্চরীরও লাঘব হয়ে অসচে; ক্রেতা ও লাভ ভিন্ন কোন ব্যবসাই স্থায়ী হয় না; সুতরাং উৎসাহদাতা-বিরহেই এই সকল ধৰ্ম্মানুসঙ্গিক প্রবঞ্চনা উঠে যাবে। কিন্তু কলকেতা সহরের এমনি প্রসবক্ষমতা যে এখনও এমন এক একটি মহাপুরুষের জন্ম দিচ্চেন যে, তারা যাতে এই সকল বদমায়েসী চিরদিন থাকে, যাতে হিন্দুধৰ্ম্মের ভড়ং ও ভণ্ডামোর প্রাদুর্ভাব বাড়ে সহস্র সৎকাৰ্য্য পায়ের নীচে ফেলে তার জন্যই শশব্যস্ত! একজনেরা তিন ভাই ছিল, কিন্তু তিনটিই পাগল; একদিন বড় ভাই তার মাকে বলে যে “মা! তোমার গর্ভটি দ্বিতীয় পাগলা গারদ।” সেই রকম একদিন আমরাও কতো সহরকে “রত্নগর্ভা।” বলেও ডাকতে পারি–কলকেতার কি বড় মানুষ, কি মধ্যাবস্থ এক একজন এক একটি রত্ন!! এই দৃষ্টান্তে আমরা বাবু পদ্মলোচনকে মজলিসে হাজির কল্লেম।
১.২৭ পদ্মলোচন দত্ত ওরফে হঠাৎ অবতার
বাবু পদ্মলোচন ওরফে হঠাৎ অবতার ১১১২ সালে তাঁর মাতামহ নাউ-পাড়ামুষুলীর মিত্তিরদের বাড়ী জন্মগ্রহণ করেন। নাউপাড়ামুষুলী গ্রামখানি মন্দ নয়, অনেক কায়স্থ ও ব্রাহ্মণের বাস আছে, গাঁয়ের জমিদার মজফ্ফর খাঁ মোছলমান হয়েও গরু জবাই প্রভৃতি দুঙ্কর্মে বিরত ছিলেন। মোল্লা ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই সমান দেখতেন—মানীর মান রাখতেন ও লোকের খাতির ও সেলামাল্কীর গুণা কত্তেন না; ফরাসীতে তিনি বড় লায়েক ছিলেন, বাঙ্গলা ও উর্দুতেও তাঁর দখল ছিল। মজফ্ফর খাঁ গায়ের জমিদার ছিলেন বটে, কিন্তু ধোপা-নাপিত বন্ধ করা, হুঁকা মারা, ঢ্যালা ফালা, বিয়ে ও গ্রাম ভাটীর হুকুম হাকাম ও নিষ্পত্তি করার ভার মিত্তিরবাবুদের উপরই দেওয়া হয়। পূৰ্ব্বে মিত্তিরবাবুদের বড় জলজলাট ছিল মধ্যে পরিবারের অনেকে মরে যাওয়ায় ভাগাভাগী ও বহু গোষ্ঠী নিবন্ধন কিঞ্চিৎ দৈন্যদশা পড়তে হয়েছিল; কিন্তু পূৰ্ব্বোপেক্ষা নিঃস্ব হলেও গ্রামস্থ লোকদের কাছে মানের কিছুমাত্র ব্যত্যয় হয়নি।