শ্রীতালা হূল ব্ল্যাক ইয়ার ইয়ার,
প্রকাশক
শত্রুঘ্নপুর
১লা এপ্রিল
১.০১ কলিকাতায় চড়ক পার্ব্বণ
“কহই টুনেয়া——
শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালি”——-টুনোয়ার টপ্পা।
হে শারদে! কোন দোষে দুষি দাসী ও চরণতলে,
কোন্ অপরাধে ছলিলে দাসীরে দিয়ে এ সন্তান?
এ কুৎসিতে! কোন লাজে সপত্নী-সমাজে পাঠাইব,
হেরিলে মা এ কুরূপে—দুষিবে জগৎ—হাসিবে
সতিনী পোড়া; অপমানে উভরায়ে কাঁদিবে
কুমার সে সময় মনে য্যান থাকে; চির অনুগত লেখনীরে।
১২০২ সাল। কলকাতা সহরের চারদিকেই ঢাকের বাদ্দি শুনা যাচ্চে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে,–সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ের নূপুর, মাতায় জরীর টুপী, কোমোরে চন্দ্রহার আর সেপাইপেড়ে ঢাকাই শাড়ী মালকোচা করে পরা, ছোপানে তারকেশ্বরে গামছা হতে, বিল্বপত্ৰ-বাঁধা সূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দেরর সীমা নাই—“আমাদের বাবুদের বাড়ী গাজন!”
কোম্পানীর বাংলা দখলের কিছু পরে, নন্দকুমারের ফাঁসী হবার কিছু পূর্ব্বে আমাদের বাবুর প্রপিতামহ নিমকের দাওয়ান ছিলেন। সেকালে নিমকীর দাওয়ানীতে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় ছিল; সুতরাং বাবুর প্রপিতামহ পাঁচ বৎসর কৰ্ম্ম করে মৃত্যুকালে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা রেখে যান—সেই অবধি বাবুরা বনেদী বড়মানুষ হয়ে পড়েন। বনেদী বড়মানুষ কবলাতে গেলে বাঙ্গালী সমাজে যে সরঞ্জামগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েচে–বাবুদের নিজের একটি দল আছে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত কুলীনের ছেলে, বংশজ, শ্রোত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী, গন্ধবেণে আর কাঁসারী ও ঢাকাই কামার নিতান্ত অনুগত–বাড়ীতে ক্ৰিয়ে-কৰ্ম্ম ফাঁক যায় না, বাৎসরিক কৰ্ম্মেও দলস্থ ব্রাহ্মণদের বিলক্ষণ প্রাপ্তি আছে; আর ভদ্রাসনে এক বিগ্রহ, শালতগ্রামশিলে ও আকব্বরী মোহরপোরা লক্ষ্মীর খুঁচীর নিত্য সেবা হয়ে থাকে।
এদিকে দুলে, বেয়ারা, হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে, উত্তরী সূতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীর-ব্রতের ও মহত্বের স্তম্ভম্বরূপ বাণ ও দশমকি হাতে করে প্রত্যেক মদের দোকানে, বেশ্যালয়ে, ও লোকের উঠানে ঢাকের ও ঢোলের সঙ্গতে নেচে বেড়াচ্ছে। ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখীর পালক, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ার পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরুমহাশয়ের পাঠশালা বন্ধ হয়ে গিয়েচে–ছেলের গাজনতলাই বাড়ী করে তুলেছে, আহার নাই, নিদ্ৰা নাই, ঢাকের পেচৌনে পেচোনে রোদে রোদে রপ্টে রপ্টে বেড়াচ্ছে; কখন বলে “ভদ্দেশ্বরে শিব মহাদেব” চীৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে। কখন ঢাকের টোয়ের চামর ছিঁড়ছে; কখন ঢাকের পেছনটা দুম দুম করে বাজাচ্চে–বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যায়রাম কল্লে হয়!
ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এলো, আজ বৈকালে কাঁটা ঝাঁপ। আমাদের বাবুর চার পুরুষের বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কাণে বিল্বপত্র খুঁজে, হাতে এক মুটো বিল্বপত্র নিয়ে ধুকতে ধুকতে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েছে, সুতরাং বাবুকে তারে নমস্কার কত্তে হলো; মূলসন্নাসী এক পা কাদা শুদ্ধ ধোপ ফরাসের উপর দিয়ে গিয়ে বাবুর মাথায় আশীৰ্ব্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন,–বাবু তটস্থ!
বৈঠকখানায় মেকাবি ক্লাকে টাং টাং টাং করে পাঁচটা বাজলো, সূর্যের উত্তাপের হ্রাস হয়ে আসতে লাগলো। সহরের বাবুরা ফেটিং, সেলফ ড্রাইভিং বগী ও ব্রাউহ্যামে করে অবস্থাগত ফ্রেণ্ড, ভদ্রলোক বা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন; কেউ বাগানে চল্লেন। দুই চারজন সহৃদয় ছাড়া অনেকেরই পেছনে মালভরা মোদাগাড়ী চল্লো; পাছে লোকে জাতে পারে, এই ভয়ে কেউ সে গাড়ীর সহিস-কৌচম্যানকে তকমা নিতে বারণ করে দেছেন। কেউ কেউ লোকাপবাদ তৃণজ্ঞান বেশ্যাবাজী বাহাদুরীর কাজ মনে করেন। বিবিজ্ঞানের সঙ্গে একত্রে বসেই চলেছেন, খাতির নদারং–কুঠিওয়ালারা গহনার ছক্কড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখে চক্ষু সার্থক কচ্চেন।
এদিকে আমাদের বাবুলের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ঢাক বাজতে লাগলো, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হলো; সন্ন্যাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্ছে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়েছে–শিবের বামুন কেবল গঙ্গা জল ছিটুচ্চে। প্রায় আধ ঘণ্টা মাথা চালা হলো, তবু ফুল আর পড়ে না; কি হবে! বাড়ীর ভিতরে খবর গেল, গিন্নীর পরস্পর বিষণ্ণবদনে “কোন অপরাধ হয়ে থাকবে” বলে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে রসে পড়লেন—উপস্থিত দর্শকেরা “বোধ হয় মূলসন্ন্যাসী কিছু খেয়ে থাকবে, সন্ন্যাসীর দোষেই এইসব হয়” এই বলে নানাবিধ তর্কবিতর্ক আরম্ভ কল্লে; অবশেষে গুরু-পুরুত ও গিন্নীর ঐক্যমতে বাড়ীর কর্ত্তাবাবুকে বাঁধাই স্থির হলো। একজন অমুদে ব্রাহ্মণ ও চার পাঁচজন সন্ন্যাসী দৌড়ে গিয়ে বাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে বল্লে—“মোশায়কে একবার গা ভুলে শিবতলায় যেতে হবে, ফুল তো পড়ে না, সন্ধ্যা হয়।”-–বাবুর ফিটন্ প্রস্তুত, পোষাক পরা, রেশমী-রুমালে বোকো মেখে বেরুচ্ছিলেন—শুনেই অজ্ঞান কিন্তু কি করেন, সাত পুরুষের ক্রিয়ে-কাণ্ড বন্ধ করা হয় না; অগত্যা পায়নাপেলের চাপকান পরে সেই সাজগোজ সমেতই গাজনতলায় চল্লেন—বাবুকে আসতে দেখে দেউড়ীর দারোয়ানেরা আগে আগে সার গেঁথে চল্লো; মোসাহেবেরা বাবুর সমূহ বিপদ মনে করে বিষণ্ণবদনে বাবুর পেচোনে পেচোনে যেতে লাগলো।