শোবার সময়ে ঠাকুরমাকে সেই মালীর মহাপুরুষের কথা বল্লেম—ঠাকুরমা শুনে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন ও একজন চাকরকে পরদিন সকালে মহাপুরুষের পায়ের ধূলো আনতে বলে দিয়ে, মহাপুরুষের বিষয়ে আরও দু-একঃগর কল্লেন।
ঠাকুরমা বললেন–বছর আশী হলে (ঠাকুরমার তখন নতুন বিয়ে হয়েচে) আমাদের বারাণসী ঘোষ কাশী যাবার সময়ে পথে জঙ্গলের ভিতর ঐ রকম এক মহাপুরুষ দেখেন। সেই মহাপুরুষও ঐ রকম অচৈতন্য হয়ে ধ্যানে ছিলেন। মাঝিরে ধরাধরি করে নৌকায় তুলে আনে। বারাণসী তাকে বড় যত্ন করে নৌকায় রাখলেন। তখন ছাপঘাটীর মোহনায় জল থাকতো না বলে, কাশীযাত্রীরে বাদাবনের ভিতর দিয়ে যেতেন আসতেন; সুতরাং বারাণসীকেও বাদ দিয়ে যেতে হলো। এক দিন বাদাবনের ভিতর দিয়ে গুণ টেনে নৌকা যাচ্ছে, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে, এমন সময়ে ঠিক ঐ রকম আর একজন মহাপুরুষ নৌকার গলুয়ের কাছে বসে ধ্যানে ছিলেন, এরি মধ্যে ডাঙ্গার মহাপুরুষও হাসতে হাসতে নৌকার উপর এসে নৌকার মহাপুরুষের হাত ধরে নিয়ে জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা হাঁ করে রইলো! বারাণসী বাদাবন তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু আর মহাপুরুষদের দেখতে পেলেন না, এরা সব সেকালের মুনিঋষি, কেউ হাজার বৎসর তপিস্যে কচ্চেন, এঁরা মনে কলে সব কত্তে পারেন!
আর একবার ঝিলিপুরের দত্তরা সোঁদরবন আবাদ কত্তে কত্তে ত্রিশ হাত মাটীর ভিতরে এক মহাপুরুষ দেখেছিল। তার গায়ে বড় বড় অশোদগাছের শেকড় জন্মে গিয়েছিল। আর শরীর শুকিয়ে চেলাকাঠের মত হয়েছিল। দত্তরা অনেক পরিশ্রম করে তারে ঝিলিপুরে আনে, মহাপুরুষও প্রায় এক মাস ঝিলিপুরে থাকেন, শেষে একদিন রাত্তিরে তিনি যে কোথায় চলে গেলেন, কেউ তার ঠিকানা কত্তে পাল্পে না!–শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
তার পরদিন সকালে রামা চাকর মহাপুরুষের পায়ের ধুলো এনে উপস্থিত কল্লে; ঠাকুরমা একটি জয়ঢাকের মত মাদুলিতে সেই ধুলো পুরে, আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন, সুতরাং সেই দিন থেকে আমরা ভূত, পেৎনী, শাঁকচুন্নী ও ব্রহ্মদত্তির হাত থেকে কথঞ্চিৎ নিস্তার পেলেম।
ক্রমে আমরা পাঠশালা ছাড়লেম–কলেজে ভর্ত্তি হলেম–সহাধ্যায়ী দু-চার সমকক্ষ বড়মানুষের ছেলের সঙ্গে আলাপ হলো। একদিন আমরা একটার সময়ে গোলদীঘির মাঠে ফড়িং ধরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় আমাদের কেলাসের পণ্ডিত মহাশয় সেই দিকে বেড়াতে এলেন। পণ্ডিত মহাশয় প্রথমে বড়মানুষের বাড়ীর রাঁধুনী বামুন ছিলেন, এডুকেশন কৌন্সেলের সুক্ষ্ম বিবেচনায়, সেন বাবুর সুপারিসে ও প্রিন্সিপালের কৃপায় পণ্ডিত হয়ে পড়েন। পণ্ডিত মহাশয় পান খেতে বড় ভালবাসতেন, সুতরাং সকলেই তাকে যথাসাধ্য পান দিয়ে তুষ্ট কত্তে ক্রটি কত্তো না; পণ্ডিত মহাশয় মাঠে আসবামাত্র ছেলেরা পান দিতে আরম্ভ কল্লে; আমরাও এক দোনা মিঠে খিলি উপহার দিলেম। পণ্ডিত মহাশয় মিঠে খিলি পছন্দ কত্তে; পান খেয়ে আমাদের নাম ধরে বলেন, “আরে হুতোম! আর শুনচো? ভূকৈলেসের রাজাদের বাড়ী যে একটা মহাপুরুষ ধরে এনেছিলো, ডাক্তার সাহেব তার ধ্যান ভঙ্গ করে দিয়েছেন;–প্রথমে রাজারা তার পায়ে গুল পুরিয়ে দেন, জলে ডুবিয়ে রাখেন, কিছুতেই ধ্যানভঙ্গ হয় নাই। শেষে ডাক্তার সাহেব এক আরক নিয়ে তার নাকের গোড়ায় ধল্লে তার চেতন হলো; এখন সেই মহাপুরুষ লোকের গলা টিপে পয়সা নিচ্ছে, রাজাদের পাখা টেনে বাতাস কচ্চে, যা পাচ্ছে, তাই খাচ্ছে, তার মহাপুরুষত্ব-ভুর ভেঙ্গে গেছে।”
পণ্ডিত মহাশয়ের কথা শুনে আমরা তাক্ হয়ে পড়লেম, মহাপুরুষের উপর যে ভক্তিটুকু ছিল— মরিচবিহীন কর্পূরের মত–পরহীন ইথরের মত একেবারে উবে গেল। ঠাকুরমার মাদুলিটি তার পর দিনই খুলে ফ্যালা হলো; ভূত, শাঁকচুন্নী পেৎনীদের ভয় আবার বেড়ে উঠলো।
১.০৭ লালা রাজাদের বাড়ী দাঙ্গা
আমরা স্কুলে আর এক কেলাস উঠলেম। রাধুনি বামুন পণ্ডিতের হাত এড়ানো গেল। একদিন আমরা পড়া বলতে না পারায় জল খাবার ছুটীর সময়ে গাধার টুপী মাথার দিয়ে, বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কন্ফাইন্ হয়ে রয়েছি, মাষ্টার মশাই তামাক খাবার ঘরে জল খেতে গেছেন (তাঁর ক্ষিদে বরদাস্ত হয় না, কিন্তু ছেলেদের হয়); একজন বামুন বাবুদের বাড়ীর ছোটবাবুর মুখে শ্যামা পাখীর বোল—“বক্ বকম্ বক বকম্” করে পায়রার ডাক ডেকে বেড়াচ্চেন ও পনি টাট্টু সেজে কদম দেখাচ্ছেন; এমন সময়ে কাশীপুর অঞ্চলের একজন ছোকরা বল্লে, “কাল বৈকালে পাকপাড়ায় লালাবাবুদের (শ্রী বিষ্ণু! আজকাল রাজা) লালা রাজাদের বাড়ী—এক দল গোরা মাতাল হয়ে এসে চার-পাঁচ জন দারোয়ানকে বর্শায় বিঁধে গিয়েছে, রাজারা ভয়ে হাসন হোসেনের মত একটা পুরোণো পাতকোর ভিতর লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেছেন।” (বোধ হয় কেবল গিরগিটের অপ্রতুল ছিল)। আর একজন ছোকরা বলে উঠলো “আরে তা নয়, আমরা দাদার কাছে শুনেছি, রাজাদের বাড়ীর সামনের গাছে একটা কাগ মেরেছিল বলে রাজাদের জমাদার, সাহেবদের মাত্তে এসে”; আর একজন ছোকরা দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের মুখের কাছে হাত নেড়ে বল্লে, “আ রে না হে না, ও সব বাজে কথা! আমারও বাড়ী টালাতে, রাজাদের বাড়ীর পেছনে যে সেই বড় পগারটা আছে জান? তার পাশে যে পচা পুকুর সেই আমাদের খিড়কি। রাজাদের এক জন আমলার ভাই ঠিক বানরের মত মুখ; তাই দেখে একজন সাহেব ভেংচে ছিল, তাতে আমলাও ভেংচায়; তাতেই সাহেবরা বন্দুক পিস্তল নিয়ে দলবল সমেত এসে গুলী করে”। এইরূপে অনেক রকম কথা চলেছে, এমন সময়ে মাষ্টার বাবু তামাক খাবার ঘর থেকে এলেন, ছোটবাবুর পনি টাটুর কদম ও ‘বক বকম্’ বন্ধ হয়ে গেল, রাজারা বাঁচলেন—ঢং ঢং করে দুটো বাজলে কেলাস বসে গেল, আমরাও জল খেতে ছুটী পেলেম। আমরা বাড়ী গিয়ে রাজাদের ব্যাপার অনেকের কাছে আরও ভয়ানক রকম শুনলেম; বাঙ্গালা কাগজওয়ালারা, “এক দল গোরা বাজনা বাজিয়ে যাইতেছিল, দলের মধ্যে একজনের জলতৃষ্ণা পেয়েছিল, রাজাদের বাড়ী যেমন জল খেতে যাবে, জমাদার গলা ধাক্কা মারিয়া বাহির করিয়া দেয়, তাহাতে সঙ্গের কর্ণেল গুলী কত্তে হুকুম দেন” প্রভৃতি নানা আজগুবী কথায় কাগজ পোড়াতে লাগলেন। সহরের পূর্ব্বের বাঙ্গালা খবরের কাগজ বড় চমৎকার ছিল, ‘অমুক বাবুর মত দাতা কে!” “অমুক বাবুর মার শ্রাদ্ধে জোর টাকা ব্যয়, (বাবু মুচ্ছুদী মাত্র); “অমুক মাতাল জলে ডুবে মরে গেচে” “অমুক বেশ্রার নত খোয়া গিয়েছে, সন্ধান করে দিতে পাল্লে সম্পাদক তার পুরস্কারস্বরূপ তারে নিজ সহকারী করবেন” প্রভৃতি আল্ত কথাতেই পত্র পুরুতেন; কেউ গাল দিয়ে পয়সা আদায় কত্তেন, কেউ পয়সার প্রত্যাশায় প্রশংসা কত্তেন;–আজকালও অনেক কাগজে চোর গোপ্তান চলে!