বারোইয়ারি পূজোর সম্বৎসরের মধ্যেই বীরকৃষ্ণ দাঁর বাজার-দেনা চেগে উঠলো, গদী ও আড়ত উঠ গ্যাল, শেষে ইন্সল্ভেট গিয়ে ফরেশডাঙ্গায় গিয়ে বাস করেন; কিছুদিন বাদে হঠাৎ ঘর চাপা পড়ে মরে গেলেন! আমমোক্তার কানাইবন দত্তজা সুপ্রিমকোর্টে জাল সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে, সার রবার্ট পিল সাহেবের বিচারে চৌদ্দ বছরের জন্য ট্রান্সপোর্ট হলেন, তার পরিবারের কিছুকাল অত্যন্ত দুঃখে কাল কাটিয়ে শেষে মুড়িমুড়কির দোকান করে দিনপাত কত্তে লাগলেন; মুড়িঘাটা লেনের হুজুর কোন বিশেষ কারণে বারোইয়ারিপুজোর মধ্যে কাশী গ্যালেন। প্যালানাথবাবু একদিন কতকগুলি বাঈ ও মেয়েমানুষ নিয়ে বোটে করে কোম্পানীর বাগানে বেড়াতে যাচ্ছিলেন; পথে আচমকা একটা ঝড় উঠলো, মাঝিরে অনেক চেষ্টা কল্লে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বোটখানি একেবারে একটা চড়ার উপর উল্টে পড়ে চুরমার হয়ে ডুবে গেল। বাবু বড়মানুষের ছেলে, কখন সাঁতার দেন নাই। সুতরাং জলের টানে কোথায় যে গিয়ে পড়লে তার অদ্যাপি নির্ণয় হয় নাই। মুখুয্যেদের ছোটবাবু ক্রমে ভারি গাঁজাখোর হয়ে পড়লেন, অনবরত গাঁজা টেনে তার যক্ষ্মাকাস জন্মালো, আরাম হবার জন্যে তারকেশ্বরের দাড়ি রাখলেন বাল্সীর চরণামৃত খেলেন, সাফরিদের মাদুলী ধারণ কল্লেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বিবাগী হয়ে কোথায় যে বেরিয়ে গেছেন, আজও তার ঠিকানা হয় নাই। প্রধান দোয়ার গবারাম গাওনা ছেড়ে পৈতৃক পেশা গিল্টি অবলম্বন করে কিছুকাল সংসার চালাচ্ছিলেন, গত পুজোর সময় পক্ষাঘাত রোগে মরেচেন। পচ্চুবাবু, অঞ্জনারঞ্জন দেব বাহাদুর ও আর আর অধ্যক্ষ দোয়ারেরা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের যা হবে, তা এর পরে বক্তব্য।
১.০৩ হুজুক
সাধারণে কথায় বলেন, “হুনরে চীন” ও “হুজ্জুতে বাঙ্গাল” কিন্তু হুতুম বলেন “হুজুকে কলকেতা”। হেথা নিত্য নতুন হুজুক, সকল গুলিই সৃষ্টিছাড়া ও আজগুব। কোন কাজকর্ম্ম না থাকলে, “জ্যাঠাকে গঙ্গাযাত্রা” দিতে হয়, সুতরাং দিবারাত্র হুঁকো হাতে করে থেকে গল্প করে, তাস ও বড়ে টিপে, বাতকৰ্ম্ম কত্তে কত্তে, নিষ্কৰ্ম্মা লোকেরা যে আজগুব হুজুক তুলবে, তা বড় বিচিত্র নয়। পাঠক! যতদিন বাঙ্গালীর “বেটর অকুপেসন” না হচ্ছে, যতদিন সামাজিক নিয়ম ও বাঙ্গালীর বর্তমান গাহস্থ্যপ্রণালীর রিফরমেশন না হচ্ছে, ততদিন এই মহান্ দোষের মুলোচ্ছেদের উপায় নাই। ধৰ্ম্মনীতিতে যারা শিক্ষা পান নাই, তারা মিথ্যার যথার্থ অর্থ জানেন না, সুতরাং অক্লেশে আটপৌরে ধুতির মত ব্যবহার কত্তে লজ্জিত বা সঙ্কুচিত হন না।
১.০৫ প্রতাপচাঁদ
আমরা বড় হলেম, হাতে খড়ি হলো। একদিন গুরুমহাশয়ের ভয়ে চাকরদের কাছে লুকিয়ে রয়েছি, এমন সময় চাকরেরা পরস্পর বলাবলি কচ্চে যে “বর্দ্ধমানের রাজা প্রতাপচাঁদ একবার মরেছিলেন, কিন্তু আবার ফিরে এসেছেন। বর্দ্ধমানের রাজত্ব নেবার জন্য নালিশ করেচেন, সহরের তাবৎ বড়মানুষরা তাকে দেখতে যাচ্ছেন–এবার পুরাণবাবুর সর্ব্বনাশ, পুষ্যিপুত্তর নামঞ্জুর হবে।” নতুন জিনিষ হলেই ছেলেদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়; শুনে অবধি আমরা অনেকেরই কাছে খুঁটরে খুঁটরে রাজা প্রতাপচাঁদের কথা জিজ্ঞাসা কত্তেম। কেউ বলতো, “তিনি একদিন একরাত জলে ডুবে থাকতে পারেন!” কেউ বলতো, “তিনি গুলিতে মরেন নি-রাণী বলেছেন, তিনিই রাজা প্রতাপচাঁদ—ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে লকে কাণ কেটে গিয়েছিল, সেই কাটাতেই তার ভগিনী চিনে ফেল্লেন!” কেউ বল্লে, “তিনি কোন মহাপাপ করেছিলেন, তাই যুধিষ্ঠিরের মত অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলেন, বাস্তবিক তিনি মরেন নি; অম্বিকা কালনায় যখন তাঁরে দাহ কৰ্ত্তে অনা হয় তখন তিনি বাক্সের মধ্যে ছিলেন না, সুদু বাক্স পোড়ান হয়।” সহরে বড় হুজুক পড়ে গেল, প্রতাপচাঁদের কথাই সর্ব্বত্র আন্দোলন হতে লাগলো।
কিছুদিন এই রকমে যায়—একদিন হঠাৎ শুনা গেল, সুপ্রিমকোর্টের বিচারে প্রতাপচাঁদ জাল হয়ে পড়েছেন। সহরের নানাবিধ লোক কেউ সুবিধে কেউ কুবিধে–কেউ বল্লে, “তিনি আসল প্রতাপচাঁদ নন”—কেউ বলে, “ভাগ্যি দ্বারিকানাথ ঠাকুর ছিলেন, তাই জাল প্রুব হলো। তা না হলে পরাণবাবু টেরটা পেতেন।” এদিকে প্রতাপদ জাল সাব্যস্ত হয়ে, বরানগরে বাস কল্লেন। সেথা জরুক হলেন— খানকি ঘুসকি ও গেরস্ত মেয়েদের মেলা লেগে গেল, প্রতাপচাঁদ না পারেন, হেন কৰ্ম্মই নাই। ক্রমে চলতি বাজনার মত প্রতাপচাঁদের কথা আর শোনা যায় না; প্রতাপচাঁদ পুরোণো হলো, আমরাও পাঠশালে ভর্তি হলেম।
১.০৬ মহাপুরুষ
পাঠক! পাঠশালা যমালয় হতেও ভয়ানক—পণ্ডিত ও মাষ্টারকে যেন বাঘ বিবেচনা হচ্ছে। একদিন আমরা স্কুলে একটার সময়ে ঘোড়াঘোড়া খেলচি, এমন সময়ে আমাদের জলতোলা বুড়ো মালী বলে যে, “ভূকৈলেসে রাজাদের বাড়ী একজন মহাপুরুষ এসেছেন, মহাপুরুষ সত্যযুগের মানুষ, গায়ে বড় বড় আশেীদগাছ ও উইয়ের ঢিপি হয়ে গিয়েছে—“চোক বুজে ধ্যান কচ্চেন, ধ্যান ভঙ্গ হয়ে চক্ষু খুলেই সমুদয় ভস্ম করে দেবেন।” শুনে আমাদের বড় ভয় হলো। স্কুলে ছুটি হলে আমরা বাড়ীতে এসেও মহাপুরুষের বিষয় ভাবতে লাগলেম; লাট্টু, ঘুড্ডী, ক্রিকেট, পায়রা পড়ে রইলো—মহাপুরুষ দেখবার ইচ্ছা ক্রমে বলবর্তী হয়ে উঠলো; শেষে আমরা ঠাকুরমার কাছে গেলুম।
আমাদের বুড়ো ঠাকুরমা রোজ রাত্রে শোবার সময় ‘বেঙ্গমা-বেঙ্গুমী’ ‘পায়রা রাজা’ ‘রাজপুত্তর, পাত্তরের পুত্তুর, সওদাগরের পুওর ও কোটালের পুত্তর চার বন্ধু ‘তালপত্তরের খাড়া জাগে ও পক্ষিরাজ ঘোড়া জাগে’ ও ‘সোণার কাটী রূপার কাটী’ প্রভৃতি কত রকম উপকথা কইতেন। কবিকঙ্কণ ও কাশীদাসের পয়ার মুখস্থ আওড়াতে—আমরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তুম।–হায়, বাল্যকালের সে সুখসময় মরণকালেও স্মরণ থাকবে-–অপরিচিত সংসার—হৃদয়কমল কুসুম হতেও কোমল বোধ হতো, কলেরই বিশ্বাস ছিল, ভূত, পেৎনী ও ঠাকুর দেবতার নামে শরীর লোমাঞ্চ হতো—হৃদয় অনুতাপ ও শোকের নামও জানতো না—অমর বর পেলেও সেই সুকুমার অবস্থা অতিক্রম কত্তে ইচ্ছা হয় না।