চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধূম। গোস্বামী বরের মত সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে শুলেন। হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন; মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মাত্তে লাগলো।
হরহরিবাবু ছোঁড়ার কানে শুনে একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্ব্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন; এক্ষণে দেখলেন যে, স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটি প্রণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো; প্রভু খাটে থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন; কন্যাটি কি করে! বংশপরম্পরাগত “ধৰ্ম্মের অন্যথা কল্লে মহাপাপ” এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি কল্লে না—শুড় শুড় করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলো। প্রভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, বল “অমি রাধা তুমি শ্যাম”; কন্যাটিও অনুমতিমত “আমি রাধা তুমি শ্যাম” তিনবার বলেচে, এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পালেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে “এই কাঁদে বাড়ি বলরাম” বলে রুলসই কত্তে লাগলেন। ঘরের বাইরে ন্যাড়া বষ্টমেরা খোলকত্তাল নিয়ে ছিল— গোস্বামীর রুলসইয়ের চীৎকারে তারা হরিবোল ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগলো। মেয়েরা উলু দিতে লাগলো; কাঁসোর ঘণ্টা শাঁকের শব্দে হুলস্থুল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বল্লেন। দারোগা ভদ্রলোক ছিলেন, (অতি কম পাওয়া যায়); তারে অভয় দিয়ে সেদিন যথা সমাদরে বাসায় রেখে, তার পরদিন বরকন্দাছ মোতায়েন দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে সকলের তাক লেগে গেল, ইনি কেমন করে ঘরে গিয়েছিলেন। শেষে সকলে ঘরে গিয়ে দেখে যে, গোস্বামীর দাঁতকপাটি লেগে গেচে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, বিছানায় রক্তের নদী বচ্চে। সেই অবধি গুরুপ্রসাদি উঠে গেল, লোকের চৈতন্য হলো। প্রভুরাও ভয় পেলেন।
আর একবার এক সহুরে গোঁসাই এক বেনের বাড়ী কেষ্টলীলা করে জব্দ হয়েছিলেন, সেটিও এই বেলা বলে নিই।
রামনাথ সেন ও শ্যামনাথ সেন দুই ভাই, সহরে চার পাঁচটা হৌসের মুচ্ছুদ্দি। দিনকতক বাবুদের বড় জ্বলজ্বলা হয়ে উঠেছিল–চৌঘুড়ী, ভেঁপু, মোসাহেব ও অবিদ্যার ছড়াছড়ি। উমেদার, বেকার রেকমেণ্ড চিঠিওয়ালা লোকে বৈঠকখানা থৈ থৈ কত্তো, বাবুরা নিয়ত বাগান, চোহেল ও আমোদেই মত্ত থাকত্তেন, আত্মীয়-কুটুম্ব ও বন্ধুবান্ধবেই বাবুদের কাজকর্ম্ম দেখতেন। একদিন রবিবার বাবুরা বাগানে গিয়েছেন, এই অবকাশে বাড়ীর প্রভু,–খুন্তি, খোল ও ভেঁপু নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর ভিতর খবর গ্যালো। প্রভুকে সমাদরে বাড়ীর ভিতর নিয়ে যাওয়া হলো। প্রভু চৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবতের মতে লীলা দেখালেন। শেষে গোস্বামী বাড়ী ফিরে যান–এমন সময় ছোটবাবু এসে পড়লেন। ছোটবাবুর কিছু সাহেবী মেজাজ, প্রভুকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও অনেক কষ্টে আন্তরিক ভাব গোপন করে জিজ্ঞেসা কল্লেন, “কেমন প্রভু! ভগবানের মতে লীলা দেখান হলো?” প্রভু ভয়ে আমতা আমতা গোছের “আজ্ঞে হাঁ’ করে সেরে দিলেন। ছোটবাবুর একজন মুখোড়া গোছের কায়স্থ মোসাহেব ছিল, সে বল্লে, “হুজুর। গোঁসাই সকল রকম লীলে করে চল্লেন, কিন্তু গোবর্ধনধারণা হয়নি, অনুমতি করেন তো প্রভুকে গোবর্ধন ধারণটাও করিয়ে দেওয়া যায়, সেটাও বাকী থাকে কেন?” ছোটবাবু এতে সম্মত হলেন, শেষে দরওয়ানদের হুকুম দেওয়া হলো–দরজার পাশে একখান দশ-বারো মণ পাথর পড়ে ছিল, জন কতকে ধরে এনে গোস্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে, পাথরের চাপানে গোস্বামীর কোমর ভেঙ্গে গেল। এদিকে বারোইয়ারিতলায় কেত্তন বন্ধ হয়ে গেল, কেত্তনের শেষে একজন বাউল সুর করে এই গানটি পাইলে–
বাউলের সুর
আজব সহর কলকেতা।
রাড়ী বাড়ী জুড়ীগাড়ী মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁতে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐকতা;
যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা।
পুঁটে তেলির আশা ছড়ি শুঁড়ী সোনার বেণের কড়ি,
খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ী, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।
হদ্দ হেরি হিন্দুয়ানী, ভিতর ভাঙ্গা ভড়ংখানি,
পথে হেগে চোরাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেরগাঁতা।
গিন্টি কাজে পালিশ করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,
হুতোম দাসেস্বরূপ-ভাষে, তফাৎ থাকাই সার কথা।
গানটি শুনে সকলেই খুসী হলেন। বাউলে চার আনার পয়সা বক্সিস পেলে; অনেকে আদর করে গানটি শিখে ও লিখে নিলেন।
বারোইয়ারি পুজো শেষ হলো, প্রতিমখানি আট দিন রাখা হলো, তারপর বিসর্জ্জন করবার আয়োজন হতে লাগলো। আমমোক্তার কানাইধনবাবু পুলিশ হতে পাশ করে আনলেন। চার দল ইংরাজী বাজনা, সাজা তুরুকসোয়ার নিশেন ধরা ফিরিঙ্গি, আশা শোটা ঘড়ী ও পঞ্চাশটা ঢাক একত্র হলো! বাহাদুরী কাঠতোলা চাক একত্র করে, গাড়ীর মত করে, তাতেই প্রতিমে তোলা হলো; অধ্যক্ষের প্রতিমের সঙ্গে সঙ্গে চল্লেন, দু পাশে সংয়ের সার বেঁধে চল্লো। চিৎপুরের বড় রাস্তা লোকারণ্য হয়ে উঠলো; রাঁড়েরা ছাদের ও বারাণ্ডার উপর থেকে রূপোবাঁধানো হুঁকোয় তামাক খেতে খেতে তামাসা দেখতে লাগলো, রাস্তার লোকেরা হাঁ করে চলতী ও দাঁড়ানো প্রতিমে দেখতে লাগলো। হাটখোলা থেকে জোড়াসাঁকো ও মেছোবাজার পর্যন্ত ঘোরা হলো, শেষে গঙ্গাতীরে নিয়ে বিসর্জ্জন করা হয়। অনেক পরিশ্রমে যে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিলো, আজ তারি শ্ৰাদ্ধ ফুরুলো। বীরকৃষ্ণ দাঁ আর আর অধ্যক্ষের অত্যন্ত বিষণ্ণদনে বাড়ী ফিরে গেলেন। বাবুদের ভিজে কাপড় থাকূলে অনেকেই বিবেচনা কতো যে, বাবুরা মড়া পুড়িয়ে এলেন।