জামাইবাবু তিন-চার দিনে তোলপুরে পৌঁছিলেন। গাঁয়ে সোর পড়ে গেল, চক্রবর্ত্তীর সহুরে জামাই এসেছে; গাঁয়ের মেয়েরা কাজকর্ম্ম ফেলে ছুটোছুটি জামাই দেখতে এলো! ছোঁড়ারা সহুরে লোক প্রায় দেখে নি, সুতরাং পালে পালে এসে হরহরিবাবুরে ঘিরে বোসলো। …চক্রবর্ত্তীর চণ্ডীমণ্ডপ লোকে রৈ-রৈ করে লাগলো; একদিকে আশপাশ থেকে মেয়েরা উঁকি মাচ্চে; একপাশে কতকগুলো গোডিমওয়ালা ছেলে ন্যাংটা দাঁড়িয়ে রয়েছে; উঠানে বাজে লোক ধরে না। শেষে আমাইবাবুকে জলযোগ করবার জন্য বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। পূর্ব্বে জলযোগের যোগাড় করা হয়েছে শিড়ে নীচে চারিদিপে চারটি সুপারি দেওয়া হয়েছিল; জামাইবাবু যেমন পিঁড়েয় পা দিয়ে বসতে যাবেন, অমনি পিঁড়ে গড়িয়ে গেল। জামাইবাবু ধুপ করে পড়ে গেলেন শালী-শালাজ-মহলে হাসির গর্রা পড়লো! জলযোগের সকল জিনিসগুলিই ঠাট্টাপোরা। মাটির কালো জাম, ময়দা ও চেলের গুঁড়ির সন্দেশ, কাঠের আক ও বিচালির জলের চিনির পানা, জলের গেলাসে ঢাকুনি দেওয়া আরসুলো ও মাকোড়সা, পানের বাটায় ছুঁচো ও ইঁদুর পোরা। জামাইবাবু অতিকষ্টে ঠাট্টার যন্ত্রণা সহ্য করে বাইরে এলেন। সমবয়সী দু’চার শালা সম্পর্কের জুটে গেল; সহরের গল্প, তামাসা ও রঙ্গেই দিনটি কেটে গেল।
রজনী উপস্থিত—সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে–রাখালেরা বাঁশী বাজাতে বাজাতে গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। এক-একটি পরমা সুন্দরী স্ত্রীলোক কলসী কাঁকে করে নদীতে জল নিতে আসচে–লম্পটশিরোমণি কুমুদরঞ্জন যেন তাদের দেখবার জন্যই বাঁশঝাড়ে ও তালগাছের পাশ থেকে উঁকি মাচ্ছেন। ঝিঁঝিপোকা ও ঈইচিংড়িরা প্রাণপণে ডাকচে। ভাম, খটাখ ও ভোঁদড়েরা ভাঙ্গা শিবের মন্দির ও পড়ো বাড়ীতে ঘুরে বেড়াচ্চে। চামচিকে ও বাদুড়েরা খাবার চেষ্টায় বেরিয়েছে; এমন সময় একদল শিয়াল ডেকে উঠলো–এক প্রহর রাত্রি হয়ে গেল। ছেলেরা জামাইবাবুর বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল, পুনরায় নানারকম ঠাট্টা ও আসল খেয়ে–জামাইবাবু নির্দ্দিষ্ট ঘরে শুতে গেলেন।
বিবাহের পর পুনর্ব্বিবাহের সময়েও জামাইবাবু শ্বশুরালয়ে যান নাই। সুতরাং পাঁচ বৎসরের সময় বিবাহকালে বা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তখন দুইজনেই বালক-বালিকা ছিলেন। সুতরাং হরহরিবাবুর নিদ্ৰা হবার বিষয় কি? আজ স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হবে, স্ত্রী মান করে থাকলে তিনি কলেজী এডুকেশন ও ব্রহ্মজ্ঞান মাথায় তুলে পায়ে ধরে মান ভাঙবেন এবং এরপর যাতে স্ত্রী লেখাপড়া শিখেন ও চিরহৃদয়তোষিকা হন, তার বিশেষ তদ্বির কত্তে থাকবেন। বাঙ্গালীর স্ত্রীরা কি দ্বিতীয়া “মিস ষ্টো, মিস টমসন ও মিসেস বরকরলি ও লেডী বুলুয়ার লিটন” হতে পারে না? বিলিতী স্ত্রী হতে বরং এরা অনেক অংশে বুদ্ধিমতী ও ধর্ম্মশীলা—তবে কেন বডি দিয়ে, পুতুল খেলে ঝকড়া ও হিংসায় কাল কাটায়? সীতা, সাবিত্রী, সতী, সত্যভামা, শকুন্তলা, কৃষ্ণাও তো এক খনির মণি? তবে এঁরা যে কয়লা হয়ে চিরকাল “ফরনেসে” বন্ধ হয়ে পোড়েন ও পোড়ন, সে কেবল বাপ-মা ও ভাতারবর্গের চেষ্টা ও তদ্বিরের ত্রুটিমাত্র। বাঙ্গালীসমাজের এমনি এক চমৎকার রহস্য যে, প্রায় কোন বংশেই স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কৃতবিদ্য দেখা যায় না! বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর হয়তো বর্ণ পরিচয় হয় নাই; গঙ্গাজলের ছড়া–সাফরিদের মাদুলী ও বালসির চন্নমেত্তো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত! এ ভিন্ন জামাইবাবুর মনে নানা রকম খেয়াল উঠলো, ক্রমে সেইসব ভাবতে ভাবতে ও পথের ক্লেশে অঘোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষে বেলা এক প্রহরের সময়ে মেয়েদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল—দেখেন যে, বেলা হয়ে গিয়েছে— তিনি একলা বিছানায় শুয়ে আছেন।
এদিকে চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর গিন্নীরা বলাবলি কন্তে লাগলেন যে, “তাই তো গা! জামাই এসেচেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পোনের হলো, এখন প্রভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক।” সুতরাং চক্রবর্ত্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে, প্রভুর বাড়ী খবর দিলে–প্রভু তূরী, খুন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্রসাদির আয়োজন হতে লাগলো।
হরহরিবাবু প্রকৃত রহস্য কিছুমাত্র জানতো না, গোঁসাই দলবল নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর সকলে শশব্যস্ত! স্ত্রী নূতন কাপড় ও সর্ব্বালঙ্কারে ভূষিত হয়ে বেড়াচ্চে! সুতরাং তিনি এতে নিতান্ত সন্দিগ্ধ হয়ে একজন ছেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “ওহে, আজ বাড়ীতে কিসের ধূম?” ছোকরা বল্লে, “জামাইবাবু, তা জান না, আজ আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে।”
“আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে” শুনে হরহরিবাবু একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও কি প্রকারে কুৎসিত গুরুপ্রসাদি হতে স্ত্রী পরিত্রাণ পান, তারি তদ্বিরে ব্যস্ত রইলেন।
কর্ত্তব্যকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান কত্তে সাধুরা কোন বাধাই মানেন না বলেই যেন দিনমণি কমলিনীর মনোব্যথায় উপেক্ষা করে অস্ত গেলেন। সন্ধ্যাবধূ শাঁক ঘণ্টা ও ঝিঁঝিঁ পোকার মঙ্গলশব্দের সঙ্গে স্বামীর অপেক্ষা কত্তে লাগলেন। প্রিয়সখী প্রদোষ দূতীপদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, নিশানাথকে সংবাদ দিতে গেলেন। নববধুর বাসরে অমোদ করবার জন্য তারাদল একে একে উদয় হলেন, কুমুদিনী স্বচ্ছ সরোবরে ফুটলেন—হৃদয়রঞ্জনকে পরকীয় রসাস্বাদনে গমনোদ্যত দেখেও, তাঁর মনে কিছুমাত্র বিরাগ হয় নাই। কারণ, চন্দ্রের সহস্র কুমুদিনী আছে, কিন্তু কুমুদিনীর তিনিই একমাত্র অনন্যগতি! এদিকে নিশানাথ উনয় হলেন—শেয়ালেরা যেন স্তব পাঠ কত্তে লাগলো—ফুলগাছেরা ফুলদল উপহার দিতে লাগলো দেখে আাদে প্রকৃতি সত্য হাসতে লাগলেন।