চিতেন।
“বড় বারে বারে এসো ঘরে মকদ্দমা করে ফাঁক!
এইবারে গেরে, তোমার কল্লে সূর্পণখার নাক!”
আস্তাই।
ক্যামন সুখ পেলে কম্বলে শুলে,
ব্ৰহ্মওর দেবত্তর বড় নিতে জোর করে
এখন জারী গ্যাল, ভূর ভাংলো,
তোমার আত্তো জুলুম চলবে না!
পেনেলকোডের আইন গুণে মুখুয্যের পোর ভাংলো জাঁক।
বে-আইনীর দফারফা বদমাইসি হলো খাক্॥
মোহাড়া।
কুইনের খাসে, দেশে, প্রজার দুঃখ রবে না।
মহামহোপাধ্যায় মথুরানাথ মুসড়ে গিয়েচেন।
কংস-ধ্বংসকারী লেটোর, জেলায় এসেছেন।
এখন গুমী গ্রেপ্তারী লাঠি দাঙ্গা ফোর্জ চলবে না।
জমিদারী-কবি শুনে সহুরেরা খুশী হলেন, দু-চার পাড়াগেঁয়ে রায়চৌধুরী, মুন্সী ও রায়বাবুরা মাথা হেঁট কল্লেন, হুজুরী আমমোক্তারেরা চৌক রাঙ্গিয়ে উঠলো, কবিওয়ালার ঢোলের তালে নাচতে লাগলো।
স্ক্যাভেঞ্জরের গাড়ী সার বেঁধে বেরিয়েচে। ম্যাথরের ময়লার গাড়ী ঠেলে সেনের ঘাটে চলেছে। বাউলের ললিত রাগে খরতাল ও খঞ্জনীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সহস্র নাম ও
“ঝুলিতে মালা রেখে, জপলে আর হবে কি।”
কেবল কাঠের মালার ঠকঠকী, সব ফাঁকি!”
লোকের দোয়ারে দোয়ারে গান করে বেড়াচ্চে। কলুভায়া ঘানি জুড়ে দিয়েছেন। ধোপারা কাপড় নিয়ে চলেচে। বোঝাই-করা গরুর গাড়ী কোঁ-কোঁ শব্দে রাস্তা জুড়ে যাচ্ছে। ক্রমে ফরসা হয়ে এলো। বারোইয়াভিলায় কবি বন্ধ হয়ে গেল; ইয়ারগোচের অধ্যক্ষ ও দর্শকেরা বিদেয় হলেন, বুড়ো ও আধবুড়োরা কেত্তনের নামে এলিয়ে পড়লেন; দেশের গোঁসাই, গোঁড়া, বৈরাগী ও বষ্টব একত্র হলো;– সিমলের শাম ও বাগবাজারের নিস্তারিণীর কেত্তন।
সিলের শাম উত্তম কিত্তনী—বয়স অল্প, দেখতে মন্দ নয়—গলাখানি যেন কাঁসি খনখন কচ্চে। কেত্তন আরম্ভ হলো–কিত্তনী “তাথইরা তাথইয়া নাচত ফিরত গোপাল ননী চুরি করি খাঞীছে আরে আরে ননী চুরি করি খাঞীছে তাথইয়া” গান আরম্ভ কল্লে; সকলে মোহিত হয়ে পড়লেন! চারিদিক থেকে হরিবোল ধ্বনি হতে লাগলো, খুলীরে হাঁটু গেড়ে বসে সজোরে খোল বাজাতে লাগলো। কিত্তনী কখন হাঁটু গেছে কখনো দাঁড়িয়ে, মধু-বৃষ্টি কত্তে লাগলেন—হরি-প্রেমে একজন গোঁসাইয়ের দশা লাগলো। গোঁড়ারা তাকে কোলে করে নাচতে লাগলো। আর যেখানে তিনি পড়েছিলেন, জিভ দিয়ে সেইখানেই ধূলো চাটতে লাগলো!
হিন্দুধৰ্ম্মের বাপের পুণ্যে ফাঁকি দেখাবার মত ফিকির আছে, গোঁসাইগিরি সকলের টেক্কা। আমরা জন্মাবচ্ছিন্নে কখন একটি রোগা দুৰ্বল গোঁসাই দেখতে পাই নে! গোঁসাই বল্লেই একটা বিকটাকার, ধুম্বলোচন হবে, ছেলেবেলা অবধি সকলেরই এই চিরপরিচিত সংস্কার। গোঁসাইদের যেরূপ বিয়ারিং পোষ্টে আয়েস ও আহারাদি চলে, বড় বড় বাবুদের পয়সা খরচ করেও সেরূপ জুটে ওঠবার যো নাই। গোঁসাইরা স্বয়ং কেষ্ট ভগবান বলেই, অনেক দুর্লভ বস্তুও অক্লেশে ঘরে বসে পান ও কালীয়দমন, পূতনাবধ, গোবর্ধনধারণ প্রভৃতি কটা বাজে কাজ ছাড়া, বস্ত্রহরণ, মানভঞ্জন, ব্ৰজবিহার প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের গোছালো গোছালো লীলাগুলি করে থাকেন! পেটভরে মাল্লো ও ক্ষীর লেসেন ও রকমারি শিষ্য দেখে চৈতন্যচরিতামৃতের মতে—
“যিনি গুরু তিনি কৃষ্ণ না ভাবিও আন।
গুরু তুষ্টে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিবা প্রমাণ॥”
“প্রেমারাধ্যা রাধাসমা তুমি লো যুবতী।
রাখ লো গুরুর মান যা হয় যুকতি।”
—প্রভৃতি উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ সওয়ায় গোঁসাইরা অণ্ডরটেকরের (মুদ্দফরাস) কাজও করে থাকেন–পাঁচসিকে পেলে মন্ত্রও দেন, মড়াও ফেলেন ও বেওয়ারিস বেওয়া ম’লে এরা তার উত্তরাধিকারী হয়ে বসেন। একবার মেদিনীপুরে এক ব্রকোদ গোঁসাই খড় জব্দ হয়েছিলেন। এখানে সে উপকথাটিও বলা আবশ্যক।
পূর্ব্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রে গুরু-প্রসাদি প্রথা প্রচলিত ছিল—নতুন বিবাহ হলে গুরুসেবা না করে স্বামি-সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। বেতালপুরের রামেশ্বর চক্রবর্ত্তী পাড়াগাঁ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট লোক! সুবর্ণরেখা নদীর ধারে পাঁচবিঘা আওলাৎ ঘেরা ভদ্রাসন বাড়ী, সকল ঘরগুলি পাকা, কেবল চণ্ডীমণ্ডপ ও দেউড়ির সামনের বৈঠকখানা উলু দিয়ে ছাওয়া। বাড়ীর সামনে দু’টি শিবের মন্দির, একটি শাণ-বাঁধানে পুষ্করিণী, তাতে মাছও বিলক্ষণ ছিল। ক্রিয়েকৰ্ম্মে চক্রবর্ত্তীকে মাছের জন্যে ভাবতে হতো না। এ সওয়ায় ২০০ বিঘা ব্রহ্মোত্তর জমি, চাষের জন্য পাঁচখানা লাঙ্গল, পাঁচজন রাখাল চাকর, পাঁচজোড়া বলদ নিযুক্ত ছিল। চক্রবর্ত্তীর উঠোনে দুটি বড় বড় ধানের মরাই ছিল, গ্রামস্থ ভদ্রলোকমাত্ৰেই চক্রবর্ত্তীকে বিলক্ষণ মান্য কত্তেন ও তার চণ্ডীমণ্ডপে এসে পাশা খেলতেন। চক্রবর্ত্তীর ছেলেপুলে কিছুই ছিল না, কেবল এক কন্যামাত্র; সহরের ব্ৰকভানু চাটুষ্যের ছেলে হরহরি চাটুয্যের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বর-কনের বয়স ১০/১৫ বছরের বেশী ছিল না, সুতরাং জামাই নিয়ে যাওয়া, কি মেয়ে আনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। কেবল পাল-পার্ব্বণে পিঠে-সংক্রান্তি ও ষষ্ঠবাটায় তত্ত্ব তাবাস চলতো।
ক্রমে হরহরিবাবু কালেজ ছাড়লেন, এদিকে বয়সও কুড়ি-একুশ হলো, সুতরাং চক্রবর্ত্তী জামাই নেযাবার জন্য স্বয়ং শহরে এসে ব্রকভানুবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ কল্লেন। ব্রকভানুবাবু চক্রবর্ত্তীকে কয়দিন বিলক্ষণ আদরে বাড়ীতে রাখলেন, শেষে উত্তম দিন দেখে হরহরিরে সঙ্গে দিয়ে পাঠালেন। একজন দারোয়ান, একজন সরকার ও একজন চাকর হরহরিবাবুর সঙ্গে গেল।