সমরভেকেশনে কলেজ বন্ধ হয়েছে, স্কুল-মাষ্টারেরা লোকের বাগানে বাগানে মাছ ধরে বেড়াচ্ছেন। পণ্ডিতেরা দেশে গিয়ে লাঙ্গল ধরে চাষবাস আরম্ভ করেচেন; (ইংরেজী ইস্কুলের পণ্ডিত প্রায় ঐ গেছেরি দেখা যায়) ধনুবাবু সন্ধ্যার পর দুই-চার স্কুল-ফ্লেণ্ড নিয়ে পড়বার ঘরে বসে আছেন। এমন সময়ে কলেজের প্যারীবাবু চাদরের ভিতর এক বোতল ব্রাণ্ডি ও একটা শেরি নিয়ে, অতি সন্তর্পণ ঘরের ভিতর ঢুকলেন। প্যারীবাবু ঘরে ঢোকবামাত্রই চারদিকের দোর-জানলা বন্ধ হয়ে গেল; প্রথমে বোতলটি অতি সাবধানে খুলে (বেড়ালে চুরি করে দুধ খাবার মত করে) অত্যন্ত সাবধানে চলতে লাগলো ক্রমে ব্রাণ্ডি অন্তর্ধান হলেন। এদিকে বাবুদের মেজাজও গরম হয়ে উঠলো; দেরি-জানালা খুলে দেওয়া হলো, চেঁচিয়ে হাসি ও গররা চলতে লাগলো। শেষে শেরীও সমীপস্থ হলেন, সুতরাং ইংরেজী ইস্পিচ ও টেবিল চাপড়ানো চল্লো; ভয় লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। এ দিকে ধনুবাবুর বাপ চণ্ডীমণ্ডপে বসে মালা ফিরুচ্ছিলেন; ছেলেদের ঘরের দিকে হঠাৎ চীৎকার ও রৈ রৈ শব্দ শুনে গিয়ে দেখলেন, বাবু্রা মদ খেয়ে মত্ত হয়ে চীৎকার ও হৈ-হৈ কচ্চেন, সুতরাং বড়ই ব্যাজার হয়ে উঠলেন ও ধনুবাবুকে যাচ্চেতাই বলে গালমন্দ দিতে লাগলেন। কর্ত্তার গালাগালে একজন ফ্রেণ্ড বড়ই চটে উঠলেন ও ধনুও তার সঙ্গে তেড়ে গিয়ে একটা ঘুষো মাল্লেন! কৰ্ত্তার বয়স অধিক হয়েছিল, বিশেষতঃ ঘুষোটি ইয়ং বেঙ্গালি (বাঁদরের বাড়া); ঘুষি খেয়ে কর্ত্তা একেবারে ঘুরে পড়লেন, বাড়ীর অন্য অন্ত পরিবারের হাঁ হাঁ! করে এসে পড়লো। গিন্নী বাড়ীর ভেতর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন ও বাবুকে যথোচিত তিরস্কার কত্তে লাগলেন। তিরস্কার, কান্না ও গোলযোগের অবকাশে ফ্রেণ্ডরা পুলিশের ভয়ে সকলেই চম্পট দিলেন। এদিকে বাবুর করুণা উপস্থিত হলে মার কাছে গিয়ে বলেন, “মা, বিদ্দেসাগর বেঁচে থাক, তোমার ভয় কি? ও ওল্ডফুল মরে যাক না কেন, ওকে আমরা চাই নে; এবারে মা এমন বাবা এনে দেবো যে, তুমি, নূতন বাবা ও আমি একত্রে তিনজনে বসে হেলথ ড্রিঙ্ক করবো, ওল্ডফুল মরে যাক, আমি কোয়াইট রিফরমড বাবা চাই।”
রামকালী মুখোপাধ্যায় বাবু সুপ্রিমকোর্টের মিসুয়ার্স, থিক রোগ এণ্ড পিকপকেট উকিল সাহেবদের আফিসে খাতাঞ্জী। অফিসের ফেরত রাধাবাজার হয়ে অসচেন ও দু’ধারি দোকান ফাঁক যাচ্ছে না। পাগড়ীটে এলিয়ে পড়েছে, ধুতি খুলে হুতুলি পুতুলি পাকিয়ে গেছে, পাও বিলক্ষণ টলচে, ক্রমে ঘোড়াসাঁকোর হাড়িহাটায় এসে একেবারে এড়িয়ে পড়লেন, পা যেন খোটা হয়ে গেড়ে গেল, শেষে বিলক্ষণ হবুচবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুরবাবুদের বাড়ীর একজন চাকর সেই সময়ে মদ খেয়ে টলতে টলতে যাচ্ছিল। রামবাবু তাকে দেখে “আরে ব্যাটা মাতাল” বলে টলে সরে দাঁড়ালেন। চাকর মাতাল থেমে জিজ্ঞাসা কলে, “তুই শালা কে, আমায় মাতাল বল্লি?” রামবাবু বল্লেন, “আমি রাম।” চাকর বল্লে, “আমি তবে রাবণ।“ রামবাবু “তবে যুদ্ধং দেহি” বলে যেমন তারে মাত্তে যাবেন, অমনি নেশার ঝোঁকে ধুপুস করে ধরে গেলেন। চাকর মাতাল তার বুকের উপর চড়ে বসলো। থানার সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব সেই সময় থানায় ফিরে যাচ্ছিলেন, চাকর মাতাল কিছু টিকে ছিল, পুলিসের সার্জ্জন দেখে রামবাবুকে ছেড়ে দিয়ে পালাবার উদ্যোগ কল্লে। রামবাবুও সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে দেখেছিলেন, এখন বাবণকে পালাতে দেখে, ঘৃণা প্রকাশ করে বল্লেন, “ছি বাবা! এখন রামের হনুমানকে দেখে ভয়ে পালালে? ছি!”
রবিবারটা দেখতে দেখতে গেল, আজ সোমবার। শেষ পূজোর আমোদ, চোহেল ও ফররর শেষ, আজ বাঈ, খেমটা, কবি ও কেত্তন।।
বাঈনাচের মজলিস চূড়ান্ত সাজানো হয়েছে, গোপাল মল্লিকের ছেলের ও রাজা বেজেন্দরের কুকুরের বিয়ের মজলিস এর কাছে কোথায় লাগে! চকবাজারের প্যালানাথবাবু বাঈ-মহলের ডাইরেক্টর, সুতরাং বাঈ ও খেমটা নাচের সমুদায় ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। সহরের নন্নী, নুন্না, মুন্নী, খন্নী ও টন্নী প্রভৃতি ডিগ্রী মেডেল ও সার্টিফিকেটওয়ালা বড় বড় বাজার ও গোপাল, শাম, বিধু, থুতু, মণি ও চুণি প্রভৃতি খেমটাওয়ালীরা, নিজ নিজ তোবড়া-তুবড়ি সঙ্গে করে আসতে লাগলেন। প্যালানাথবাবু সকলকে মা-গোঁসাইয়ের মত সমাদরে রিসিভ কচ্চেন, তাঁদেরও গরবে মাটিতে পা পড়ছে না।
প্যালানাথবাবুর হীরের ওয়াচগাৰ্ডে ঝোলানো আধুলির মত মেকাবী হন্টিঙের কাঁটা ন’টা পেরিয়েছে। মজলিসে বাতির আলো শরতের জ্যোৎস্নাকেও ঠাট্টা কোচ্চে, সারঙ্গের কোঁয়া কোঁয়া ও তবলার মন্দিরের রুণু ঝুনু তালে, “আরে সাঁইয়া মোরারে তেরি মেরা জানিরে” গানের সঙ্গে এক তরফা মজলিস রেখেছে। ছোট ছোট ট্যসল হামামা ও তাজিরা এ কোণ থেকে ও কোণ, ও চৌকি থেকে ও চৌকি করে বেড়াচ্চেন, (অধ্যক্ষদের ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে ও মেয়েরা) এমন সময়ে একখানা চেটে গুড় গুড় করে বারোইয়ারিতলায় ‘গড সেভ দি কুইন’ লেখা গেটের কাছে থামলো। প্যালানাথবাবু দৌড়ে গেলেন; গাড়ী থেকে জরি ও কিংখাপে মোড়া জড়ির জুতো শুদ্ধ একটা দশমুণী তেলের কূপো এ এক কুটে মোসাহেব নাবলেন; কুপোর গলায় শিকলের মত মোটা চেন, অঙ্গুলে আঠারটা করে ছত্রিশটা আংটী।
প্যালানাথবাবুর একজন মোসাহেব বড়বাজারের পচ্চুবাবু তূলোর ও পিসগুডসের দালাল, বিস্তর টাকা! “বেশ লোক” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন; পচ্চুবাবু মজলিসে ঢুকে মজলিসের বড় প্রশংসা কলে, প্যালানাথবাবুকে ধন্যবাদ দিলেন, উভয়ে কোলা কলি হলো; শেষ পচ্চুবাবু প্রতিমা ও মাথালো মাথালো সঙেদের (যথা—কেষ্ট, বলরাম, হনুমান্ প্রভৃতি) ভক্তিভরে প্রণাম কল্লেন; আর বাঈজীকে সেলাম করে দু’খানি আমেরিকান চৌকি জুড়ে বসলেন। দু’টি হাত, এককুড়ি পানের দোনা, চাবির থোলো ও রুমালের জন্য আপাততঃ কিছুক্ষণের জন্য আর দুখানি চৌকি ইজারা নেওয়া হলো : কুটে মোসাহেব পচ্চুবাবুর পেছন দিকে বলেন, সুতরাং তারে আর কে দেখতে পায়? বড়মানুষের কাছে থাকলে লোকে যে ‘পর্বতের আড়ালে আছ’ বলে থাকে, তাঁর ভাগ্যে ভাই ঠিক ঘটলো।