আর একবার এক গোস্বামী এক মাতাল বাবুর কাছে বড় নাকাল হয়েছিলেন; সেকথাও না বলে থাকা গেল না। পূর্ব্বে এই সহরে বেনেটোলায় দীপচাঁদ গোস্বামীর অনেকগুলি বড়মানুষ শিষ্য ছিল। বারসিমলের বোসবাবুর প্রভুর প্রধান শিষ্য ছিলেন। একদিন আমতার রামহরিবাবু বোসজাবাবুরে এক পত্র লিখলেন যে, “ভেক নিতে আমার বড় ইচ্ছ, কিন্তু গুটিকতক প্রশ্ন আছে; সেগুলির যতদিন পূরণ না হচ্ছে ততদিন শাক্তই থাকবো।” বোসজী মহাশয় পরম বৈষ্ণব; রামহরিবাবুর পত্র পেয়ে বড় খুসী হলেন ও বৈষ্ণব-ধর্মের উপদেশ ও প্রশ্ন পূরণ করবার জন্যে প্রভু নদেরচাঁদ গোস্বামী মহাশয়কে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
রামহরিবাবুর সোণাগাছিতে বাস। দু-চার ইয়ার ও গাইয়ে বাজিয়ে কাছে থাকে; সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরোন—সকালে বাড়ী আসেন, মদও বিলক্ষণ চলে; দু-চারটা নিমখাসাগোচের দাঙ্গার দরুশ, পূলিসেও দুএক মোচলেকা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার পর সোণাগাছির বড় জাঁক; প্রতি ঘরে ধূনোয় ধোঁ, শাঁকের শব্দ ও গঙ্গাজলের ছড়ার দরুণ হিন্দুধৰ্ম্ম মর্ত্তিমন্ত হয়ে সোণাগাছি পবিত্র করেন। নদেরচাঁদ গোস্বামী, বোসবাবুর পত্র নিয়ে সন্ধ্যার পর সোণাগাছি ঢুকলেন। গোস্বামীর শরীরটি প্রকাণ্ড, মাথা নেড়া, মধ্যে তরমুজের বোঁটার মত চৈতনফক্কা সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপা, নাকে তিলক ও অদৃষ্টে (কপালে) একধাবড়া চন্দন। হঠাৎ বোধ হয় যেন কাগে হেগে দিয়েছে। গোস্বামীর কলকেতায় জন্ম, কিন্তু কখন সোণাগাছিতে ঢোকেন নাই (শহরের অনেক বেশ্যা সিমলের মা-গোঁসাইয়ের জুরিসডিক্সনের ভেতর)। গোস্বামী অনেক কষ্টে রামহরিবাবুর বাসায় উপস্থিত হলেন।
রামহরিবাবু কুঠী থেকে এসে পাত্র টেনে গোলাপী রকম নেশায় তর হয়ে বসেছিলেন। এক মোসাহেব বায়ার সঙ্গতে ‘অব হজরত যাতে লণ্ডনকো’ গাচ্ছেন, আর একজন মাথায় চাদর দিয়ে বাঈয়ানা নাচের উজ্জ্বগ কচ্ছেন; এমন সময় বোসবাবুর পত্র নিয়ে গোস্বামী মশাই উপস্থিত হলেন। অমন আমদের সময়ে একটা ব্রকোদ (বৃকোদর) গোঁসাইকে দেখলে, কার না রাগ হয়? মজলিসের সকলেই মনে মনে বড় ব্যাজার হয়ে উঠলেন; বোসজার অনুরোধেই কেবল গোস্বামী সে যাত্রা প্রহার হতে পরিত্রাণ পান।
রামহরিবাবু বোসজার পত্র পড়ে গোস্বামী মহাশয়কে আদর করে বসালেন। রামা, বামুনের হুঁকোটি জল ফিরিয়ে তামাক দিলে। (হুঁকোটি বাস্তবিক খাঁ সাহেবের) মোসাহেবদের সঙ্গে তার চোখ টেপাটিপি হয়ে গেল। একজন মোসাহের দৌড়ে কাছে দরজীর দোকান থেকে হয়ে এলেন। এদিকে গাওনা ও ইয়ারকি কিছু সময়ের জন্য পোষ্টপন হলো—শাস্ত্রীয় তর্ক হবার উজ্জুগ হতে লাগলো। গোস্বামী মহাশয় তামাক খেয়ে হুঁকো রেখে নানাপ্রকার শিষ্টাচার কল্লেন; রামহরিবাবুও তাতে বিলক্ষণ ভদ্রতা কল্লেন।
রামহরিবাবু গোস্বামীকে বলেন, “প্রভু! বষ্টমতন্ত্রের কটি বিষয়ে আমার বড় সন্দেহ আছে। আপনাকে মীমাংসা করে দিতে হবে। প্রথম কেষ্টর সঙ্গে রাধিকার মামী সম্পর্ক, তবে কেমন করে কেষ্ট বাধাকে গ্রহণ কল্লেন?”
দ্বিতীয়, “একজন মানুষ (ভাল দেবতাই হলো) যে, ষোলশত স্ত্রীর মনোরথ পূর্ণ করেন, এ কি কথা?”
তৃতীয়, “শুনেছি, কেষ্ট দোলের সময়ে মেড়া পুড়িয়ে খেয়েছিলেন। তবে আমাদের মটনচপ খেতে দোষ কি? আর বষ্টমদের মদ খেতেও বিধি আছে, দেখুন, বলরাম দিনরাত মদ খেতেন, কেষ্টও বিলক্ষণ মাতাল ছিলেন।” প্রশ্ন শুনেই গোস্বামীর পিলে চমকে গেল, তিনি পালাবার পথ দেখতে লাগলেন। এদিকে বাবুর দলের মুচকি হাসি; ইসরা ও রূপোর গেলাসে দাওয়াই চলতে লাগল। গোস্বামী মনের মত উত্তর দিতে পারলেন না বলে, একজন মোসাহেব বলে উঠলো, “হুজুর! কালীই বড়; দেখুন–কালীতে ও কেষ্টতে ‘ক’ পুরুষের অন্তর, কালীর ছেলে যে কার্ত্তিক, তার বাহন ময়ূরের যে ল্যাজ কেষ্টোর মাথার উপর; সুতরাং কালাই বড়।” এ কথায় হাসির তুফান উঠলো, গোস্বামী নিজ স্বভাবগুণে গোঁয়ারতিমোয় গরম হয়ে, পিট্টানের পথ দেখবেন কি, এমন সময় একজন মোসাহেব গোস্বামীর গায়ে টলে পড়ে, তার তিলক ও টিপ জিভ দিয়ে চেটে ফেলে; আর একজন ‘কি কর। কি কর।’ ব’লে টিকিটি কেটে নিলেন। গোস্বামী ক্রমে শ্রাদ্ধ গড়ায় দেখে জুতো ও হরিনামের থলি ফেলে, চোচাদৌড়ে রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়লেন! রামহরিবাবু ও মোসাহেবদের খুসীর সীমা রইলো না। অনেক বড়মানুষ এই রকম আমোদ বড় ভালবাসেন ও অনেক স্থানে প্রায়ই এইরূপ ঘটনা হয়।
কলকেতা সহরে প্রতিদিন নতুন নতুন মাতলামি দেখা যায়; সকলগুলি সৃষ্টিছাড়া ও অদ্ভুত! ঠকবাগানে ধনুকর্ণ মিত্তিরবাবুর বাপ, ন্যাট ড্রাইব মনকিসন কোম্পানীর বাড়ীর মুছুদ্দি ছিলেন, এ সওয়ায় চোটা ও কোম্পানীর কাগজেরও ব্যবসা কত্তেন। ধনুবাবু কালেজে পড়ে, একজামিন পাস করেছেন, লেকচার শোনেন ও মধ্যে মধ্যে ইংরজি কাগজে আর্টিকেল লেখেন। সহরে বাঙ্গালী বড়মানুষের ছেলেদের মধ্যে প্রায় অনেকে বিবেচনায গাধার বেহদ্দ; বুদ্ধিটা এমন সূক্ষ্ম যে, নেই বল্লেও বলা যায়; লেখাপড়া শিখতে আদবে ইচ্ছা নাই, প্রাণ কেবল ইয়ারকির দিকে দৌড়ায়, স্কুল যাওয়া কেবল বাপ-মার ভয়ে অষুদগেলা গোছ! সুতরাং একজামিন্ পাস করবার পূর্ব্বে ধনুকর্ণবাবু চার ছেলের বাপ হয়েছিলেন ও তাঁর প্রথম মেয়েটির বিবাহ পর্যন্ত হয়েছিলো। ধনুকর্ণবাবুর দু-চার স্কুলফ্রেণ্ডও সৰ্ব্বদা আসতেন যেতেন; কখন কখন লুকিয়ে-চুরিয়ে–চরসটা, মজমের বরফ খান, সিদ্ধিটে আসটাও চলতো; ইচ্ছেখানা, এক আদ্দিন শেরিটে, শ্যামপিটারও আস্বাদ নেওয়া হয়। কিন্তু কৰ্ত্তা স্বকলমে রোজগার করে বড়মানুষ হয়েছেন, সুতরাং সকল দিকে চোখ রাখেন ও ছেলেদের উপরেও সৰ্ব্বদা তাই করে থাকেন; সেই দব দবাতেই ইচ্ছেখানায় ব্যাঘাত পড়েছিল।